মাথা থেকে পা পচে যাওয়া, চোখে ঠুলি পরে মেনে নেওয়া আর কতদিন?
আমাদের ছিছিক্কারে সিন্ডিকেটের দাপাদাপি কমবে? আমরা গলা খুলে বলব যে, এসব অশিক্ষিত লুম্পেন আমার নেতা নয়, আমার নেতা দেশ স্বাধীন করতে আজীবন পথে-প্রান্তরে ঘুরে মরেছে, ত্যাগ করেছে জীবনের যাবতীয় সুখ? ঘুষ দেব না আর?
স্বাধীনতার ৭৫ বছরে পা রাখার ঠিক আগে আগে গোটা দেশ গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস দেখছে। আইপিএল ম্যাচের শেষ তিন ওভারের উত্তেজনায় টাকা গোনা দেখছে সকলে। কার টাকা? কেউ জানে না। জমি বিক্রি করে চাকরির জন্য দেওয়া টাকা? কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট না করিয়ে মেয়ের চাকরির জন্য দেওয়া টাকা? সারাজীবনের পিএফ-এর টাকা? পাড়ার মহাজনের থেকে চড়া সুদে ধার করে দেওয়া টাকা? কেউ জানে না।
বাংলা রত্নগর্ভা। ক্ষুদিরাম বসু, সুশীল ধাড়াদের জন্মভিটে। বাঙালির নেতাকে গোটা দেশ মায় সারা পৃথিবী নেতাজি বলে সম্বোধন করে। তোমার নেতা কে, এই প্রশ্নে যারা সুভাষ বসুর নাম নিয়েছে শ্রদ্ধায়, আবেগ-থরোথরো গলায়, তাদেরই সন্তান-সন্ততিদের কেউ কেউ বেছে নিয়েছেন এমন নেতাকে/নেতাদের, যাদের নামে এই কোটি কোটি টাকার কেলেঙ্কারির অভিযোগ।
অথচ এ-দেশে, স্বাধীনোত্তর পর্বে বেছে নেওয়ার মতো নেতার কোনও নমুনা একেবারেই ছিল না, এমন নয়। ছিল না পর্যাপ্ত ফুটেজ, ছিল না নিউজপ্রিন্ট। অরুণকুমার রায়ের কথা মনে পড়ছে এখনই, এই মুহূর্তে। খনি অঞ্চলের এই নেতা পাঁচবারের জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছিলেন। নিজের স্কুটারেই যাতায়াত করতেন। আজীবন শুতেন পার্টি অফিসের মেঝেতে। বিদ্যুৎ নিতে চাননি, কারণ তাতে বিদ্যুৎহীন অবস্থায় যারা বেঁচে আছে, তাদের অপমান করা হয়। লো কি লাইফ, বলার মতো নয়- এমন বেঁচে থাকাকে নিয়ে তেমন একটা হইচই হয়নি কখনও। একথা বলছি না, রাখিস মা রসেবশে, এমন প্রার্থনা কদাপি করিও না। বলছি না, ভালো ভাবে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা খুব খারাপ, পরার্থপর হতেই হইবে- এমনটাও হয়তো নয়। কিন্তু পরের দ্রব্যে না বলিয়া হাত দিও না- একথা যারা ক্লাসরুমে শেখাতে যাবে, তারা নিজেরাই যদি অপরের জোব্বা গায়ে চাপিয়ে থুড়ি অপরের চাকরি বাগিয়ে ক্লাসরুমে ঢোকেন, নির্লিপ্ত মুখে শিক্ষক-ছাত্র সংলাপ তৈরি করেন বছরের পর বছর, তখন বুঝতেই হবে নিউটনের নতুন সূত্র- দুর্নীতিই নীতি। ওপেন সিক্রেট হয়ে শাখে শাখে দোল খাওয়া- এমন ঘটনা কাকপক্ষীও জানে এবং মানে। অথচ খোদ রাজরাজেশ্বরে যদি বলেন, "আমাকে তো কেউ বলেনি", তখন বুঝতে হবে চোখে ঠুলি ব্যাগাটুলি চলছে চলবে। ঝটতিতে মনে আসে, ফেসবুকে চোরাগোপ্তা অন্তর্ঘাত চালায় যে মিম-সমাজ, তারা মাঝেসাঝেই নানা প্রসঙ্গে একটি বাক্যবন্ধ জুড়ে দেয়, "এটা তুমি আগে বলবা না?"
আরও পড়ুন: দ্রৌপদী মুর্মুকে সামনে রেখেই চলছে ইতিহাস পালটে দেওয়ার খেলা
ঠিক কত আগে বলতে হতো? কত আগে বললে পাঁচশো দিন ধরনায় বসা ছেলেমেয়েদের দাবির প্রতি সহমর্মিতা জ্ঞাপন সম্ভব হতো, এসব প্রশ্ন করা মানা। কারণ, ক্ষমতা প্রশ্ন পছন্দ করে না। ক্ষমতা তোমায় নীরবতার বিনিময়ে বাঁচতে দেবে, অন্যের চাকরি পাইয়ে দেবে, অন্যের বাড়ি হলে বখেরা বুঝিয়ে দেবে, ইট-বালি-সিমেন্টের বরাত পাইয়ে দেবে। এসব কিছু না হলে আছে লটারির দোকান। আছে ভাতা। বেকার ভাতা, চাকর ভাতা, দলদাস ভাতা। ভাতা-র ভাত খাও, কেন চাকরি নেই, কেন শিল্প নেই, কেন আমার জায়গায় মন্ত্রীর কাছের লোক- এসব প্রশ্ন কোরো না। তবু প্রশ্নরা থাকে। রাস্তা ঘোরে। কলম খোঁজে। নাকে ডাস্টবিন ঠুসে না দিলে যাঁরা গন্ধ পান না, তাঁরা আর কীভাবে জানবেন বেয়াড়া প্রশ্নের নেশা!
প্রশ্ন করতে শেখার প্রথম আখড়া স্কুল। সেই স্কুলে লেখাপড়ার বালাই চুকেছে। করোনা আসবে, চলে গেলে গরম আসবে, গরম চলে গেলে আবার অপেক্ষা পুজোর ছুটির। শূন্যপদ ভরাট হবে না। প্যারাটিচার কাজ চালিয়ে দেবে। অবশ্য এতেই তো চলে যায় বেশ। এমনিতে পাশ-ফেল নেই। তারপর অহেতুকের মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক পেরিয়ে কলেজের ফেনিল তরঙ্গে পৌঁছতে গিয়েই তুমি জানবে, সিট বিক্রি আছে। হাতে পাবে রেট চার্ট। শুরু হবে ঘুষ দেওয়া। নিচ্ছে কে? এই ক'দিন আগে যে ছাত্র ছিল। ওপেন সিক্রেট। শুধু ওপরওয়ালা বলবেন, এসব আমি জানি না তো! প্রথমবারে নিশ্চয়ই মনে হবে, আপনাকে এই জানা আমার ফুরোবে না। সিট বিক্রির টাকায় হবে ছামিয়া নাচ, মুম্বই থেকে উড়ে আসবে কোকিলকণ্ঠ। একেই বলে সভ্যতা। নিউ নরমাল। এসব জেনে, মেনে, বড় হতে হতে এই বিশ্বের মেধার দৌড় থেকে তুমি হাত ধুয়ে নিয়েছ। তোমার জন্যও অপেক্ষা করছে পুকুরচুরি, অথবা বঙ্গলক্ষ্মী লটারি। এসব কিছু না হলে সুইগি আছে, রেস এগেইনস্ট টাইম।
কোনও কাজ ছোট নয়, কিন্তু সকল কাজের অভিমুখ যদি মেধাবিযুক্ত শ্রমদানই হয়, তখন বুঝতেই হয়, বিসমিল্লায় গলদ। শিক্ষার শ-ও জোটেনি, ব্যবস্থা পচে গেছে। শাসক বলবে, আমার আমলে শিক্ষার হার আগের আমলের চেয়ে বেশি। কিন্তু সই করে সেই যদি লটারি টিকিট বেচি, সই করে কী বা হবে সই গো!
শুরু থেকে শেষ সাফল্যের শর্টকাট মেথড দেখে চোখ সয়ে গেছে যে তরুণ-তরুণীদের, তারা নিশ্চয়ই বলবে, আমি কিছুই হতে চাইনি। শুধু চেয়েছি কোনওমতে বেঁচে থাকাটা যেন আশ্চর্য প্রদীপের ছোঁয়ায় বদলে যায়। ভক্তিতে পাথর গলে, চাওয়ার মতো করে যারা চেয়েছে, মানত করেছে, মাজারে দক্ষিণা দিয়েছে- তারা পেয়েছে অন্যের চাকরি, অথবা পাড়ার দখলদারি। এসব চাঁদের পাহাড়ে একদিন যদি লিক হয়ে যায়, তবে রাজা বলবেন, আমায় আগে বলবে না! আগে বললে কি নরক থেকে লিফটে চড়ে স্বর্গে যেতাম জাঁহাপনা?
টিভি সিরিয়ালের টিআরপি পড়তির দিকে। লোকে লাইভ শো-তে যে নাটক দেখছে, তা সিরিয়াল জোগাবে কী করে? দাঙ্গাবাজ আর দুর্নীতিবাজের মল্লযুদ্ধ, মধ্যবিত্তর পিকনিক। ফেসবুকে উনিশ শতকীয় 'বাবুর মাগ পোষা' নিয়ে টিকাটিপ্পনী, যেন বাসে উঠে কন্ডাকটরের নির্দেশে ক্রমাগত পিছনের দিকে এগিয়ে চলা। এই যে দূরন্ত ঘূর্ণির বনবন পাক, শত শত নিউজপ্রিন্ট, লাইভ, টাকার পাহাড় অভিযান, এসব শেষ হলে তারপর কী? নিস্তরঙ্গ জীবনে ঢিল পড়েছে, দ্রুত লয়ের কাহারবা বাজছে। এরপর কী? সমে এসে সব ঠিক হয়ে যাবে? জীবনের দেউলিয়া জার্নাল লেখা থামবে? আমাদের ছিছিক্কারে সিন্ডিকেটের দাপাদাপি কমবে? আমরা গলা খুলে বলব যে, এসব অশিক্ষিত লুম্পেন আমার নেতা নয়, আমার নেতা দেশ স্বাধীন করতে আজীবন পথে-প্রান্তরে ঘুরে মরেছে, ত্যাগ করেছে জীবনের যাবতীয় সুখ? ঘুষ দেব না আর? কেউ ঘুষ চাইলে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াব? ৫০০ দিন ধরে রাস্তায় বসে থাকা ছেলেমেয়েদের হাত ধরে বলব, আমি তোমাদের পক্ষে? শিক্ষাঙ্গনে নৈরাজ্যর বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শেখাব সন্তানকে? না কি আসলে অনৈতিকতার কার্নিভাল চলছে আর আমি টিভির সামনে বসে উদযাপন করছি? ভাবছি, ইশ আমার জন্য এমন ফূর্তি কেন বরাদ্দ নয়!