হিন্দু শিব মন্দিরে মেলে জৈন ছোঁয়া, কীভাবে ‘বাঁকুড়া’ নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক্তেশ্বর?
Ektaeswar Temple Bankura : হিন্দু মন্দিরে মিশে যায় ভিন্ন ধর্মের আদল। জৈন ধর্মের ছবিটা মেলে বাংলার একটি শিব মন্দিরে, জানেন কোথায় রয়েছে এমন রহস্য?
“শিব ঠাকুরের আপন দেশে, নিয়ম কানুন সর্বনেশে...”, কবিতার ভাষ্য হলেও একথা যথার্থ। মানুষের পাতানো নিয়মের তোয়াক্কা করেন না শিব, তিনি রয়েছেন আপন খেয়ালে। তাই ধর্মের তোয়াক্কা করা তাঁকে মোটেই মানায় না। ফলে সঙ্গত কারণেই হিন্দু মন্দিরে মিশে যায় ভিন্ন ধর্মের আদল। জৈন ধর্মের ছবিটা মেলে বাংলার একটি শিব মন্দিরে, জানেন কোথায় রয়েছে এমন রহস্য?
আধুনিকতায় পাল্লা দিয়ে বহু কিছু বদল হলেও বাংলার ধর্মীয় ভক্তিভাবে বদল হয়নি আজও। ঠিক সেই কারণে আজও মন্দির এবং দেবতা নিয়ে হিন্দুদের মধ্যে একটা ভয়, ভক্তি অথবা আনুগত্যের মিশেলে অন্যরকম ভাব তৈরি হয়। দৈনিক পুজো আচ্চা থেকে শুরু করে তিথি মেনে বিশেষ পুজো সবই চলে নিয়ত। তেত্রিশ কোটি দেব দেবীকে নিয়ে বাঙালির একপ্রকার নাজেহাল অবস্থা। তবে এই এতো দেব দেবীর মধ্যে শিব নিয়ে একটা আলাদা করে প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। মাঘ মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশ তিথিতে পালন করা হয় শিবরাত্রি। শিবের মাথায় জল ঢেলে মনের মতো বর পাওয়ার সাধ পোষণ করেন অনেকেই। এই শিব নিয়ে বাংলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অজস্র নামজাদা মন্দির। আর তার মধ্যে অন্যতম হল বাঁকুড়ার এক্তেশ্বরের শিব মন্দির। এখানেই রয়েছে জৈন আদলের ছোঁয়া।
আরও পড়ুন - ‘আত্মা’ এখনও আসে ফিরে? পর্যটকদের কেন টানে ভৌতিক রহস্যে মোড়া সিকিমের বাবা মন্দির!
শাস্ত্র মতে, ইন্দ্রিয়বৃত্তিই অসুর। এই অসুরই বন্ধনের কারণ। আর এই বন্ধন থেকে মুক্তি অর্থাৎ, মোক্ষলাভের আকাঙ্ক্ষাতেই একেশ্বরের আরাধনা। বাঁকুড়া শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে দ্বারকেশ্বর নদের বাম তীরে অবস্থিত পশ্চিমবঙ্গের প্রাচীন মন্দিরগুলির অন্যতম এই শিবমন্দির। এটিই এক্তেশ্বরের মন্দির নামে পরিচিত। ল্যাটেরাইট এবং বেলেপাথর দিয়ে তৈরি সুগঠিত এই মন্দিরের উচ্চতা প্রায় ৪৫ ফিট। রয়েছে মন্দিরের গায়ে খোদাই করা দেব দেবীর অসাধারণ সব মূর্তি। গোটা বাঁকুড়া জেলা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে শতাধিক সব মন্দির, যেমন - মল্লেশ্বর, বহুলাড়াতে সিদ্ধেশ্বর, জয়পুরে গন্ধেশ্বর, ভুবনেশ্বর, পাত্রসায়রে কালঞ্জয় ইত্যাদি। তবে এই সবের মধ্যে এক্তেশ্বরের মন্দির যেন সঙ্গত কারণেই ব্যতিক্রম।
এক্তেশ্বর নামের মধ্যেই একতা শব্দের অভ্যাস মেলে, বাস্তবিকই এই একথার প্রমাণ মেলে এখানে। জৈন স্থাপত্য নিয়ে যাঁরা পড়াশোনা করেছেন তাঁরা অনায়াসে এই মন্দিরের স্থাপত্যের সঙ্গে মিল খুঁজে পাবেন জৈন ধর্মের। মন্দিরের কুণ্ডের মধ্যে যে শিবলিঙ্গটি রয়েছে, সেটি নাকি দেখতে অনেকটা মানুষের পায়ের মতো। জনশ্রুতি রয়েছে, বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজার সঙ্গে ছাতনার সামন্তভূমের রাজার রাজ্য সীমানা নিয়ে বিবাদ হলে, তার মীমাংসা করেন স্বয়ং শিব। দুই সীমানার সংযোগস্থলে একতার প্রতীক হিসেবে এই এক্তেশ্বর মন্দির স্থাপিত হয়।
আরও পড়ুন - ইন্দিরাকেও ফিরে যেতে হয়েছিল, কেন হিন্দু ছাড়া কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয় না জগন্নাথ মন্দিরে?
এখানেই শেষ নয়, শোনা যায় বাঁকুড়া জেলার নামের সঙ্গেও জড়িত রয়েছে এই শিবলিঙ্গের প্রসঙ্গ। বিদ্যানিধি মহাশয়ের মতে, এক্তেশ্বর মন্দিরের শায়িত শিবলিঙ্গ নাকি খানিক বাম দিকে চেপে অবস্থান করছে বলেই এই জায়গাটির নাম হয়েছে বাঁকুড়া। মতান্তরে বলা হয়, এই শিবলিঙ্গ নাকি বাঁকা ভাবে অবস্থান করছে বলে এই স্থানের নাম হয়ে থাকতে পারে বাঁকুড়া। আরও একটি মতের উল্লেখ মেলে বিদ্যানিধি মহাশয়ের কথায়। যদিও তার সঙ্গে বাস্তবের মিল পাওয়া যায় না। তবে এক কালে যে এখানে প্রাচীন জলধারার নিদর্শন ছিল তার উল্লেখ্য মেলে পুঁথি পত্র ঘেঁটে। বিদ্যানিধি মহাশয় বলেন, ‘বাম কুণ্ড’ (বাম দিকের ঝর্না জলধারা) শব্দের অপভ্রংশ হয়ে এই ভূমের নাম ‘বাঁকুড়া’ হয়েছে।
আবারও একটা শিবরাত্রি আসন্ন, এর মধ্যেই সেজে উঠেছে বাঁকুড়ার এই মন্দির। প্রতিবছর এই দিনে অসংখ্য মানুষের ঢল নামে এখানে। প্রথা মেনে পুজো হয় এই দিন। অথচ এই শিব নিয়ে পড়ে থাকা রহস্যের হদিশ করেন কজন? তিন প্রহরে জল ঢালা হয় শিবের মাথায়, রাতে ভক্তদের কণ্ঠে উচ্চারিত হয় এক্তেশ্বর নাগমণি মহাদেবের জয়ধ্বনি। আর এই শিবের মধ্যেই প্রকৃতির নিয়মে সযত্নে লালিত হয় একটা প্রাচীন ইতিহাস।