নৃশংসভাবে ৬৫০টি খুন করেছিলেন! পৃথিবীর প্রথম সিরিয়াল কিলারের গল্প হাড় হিম করে দেবে

World's First Serial Killer : জন্ম থেকেই খিচুনি আর মাইগ্রেনের শিকার সে। মাত্র তেরো বছর বয়সে তার সাথে ঘটে যায় এক চরম ন্যাক্কারজনক ঘটনা।

যুক্তরাজ্যের হোয়াইট চ্যাপেল অঞ্চল। ঘড়ির কাঁটা বলছে সময়টা মধ্যরাত। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি আর জোলো হাওয়ার যুগলবন্দি থার্মোমিটারের পারদকে নামিয়ে দিয়েছে বেশ কয়েক ডিগ্রি নীচে। প্রতিদিনের মতো সেদিনও রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমের দেশে পাড়ি দিয়েছে সমগ্র হোয়াইট চ্যাপেল ডিস্ট্রিক্ট। নাকি একটু ভুল বলা হলো? হ্যাঁ, ভুলই বটে- কারণ গোটা শহর ঘুমোলেও ঘুম নেই এই অঞ্চলের পতিতাদের চোখে। না, অন্যান্য রাতের মত পেটের তাগিদে নয়,এ জেগে থাকা যেন জীবনের তাগিদে। অন্যান্য রাতে যেমন বড়লোক বাবুরা তাদের ঘরে ঢোকে টাকার বিনিময়ে তাদের বিকৃত কামপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করতে ঠিক সেইরকমই গত কয়েকটা রাত ধরে ইনসমনিয়া যেন একদম অতর্কিতে সেঁধিয়ে যাচ্ছে হোয়াইট চ্যাপেলের এই রেডলাইট এলাকার প্রতিটা ঘরে। আসলে শহরে আবির্ভাব হয়েছে নতুন এক পাগলের। না, নারীমাংসের উপর তার লোভ নেই, লোভ নারীরক্তের উপর। বিশেষ করে পতিতারাই যেন তার সফট টার্গেট। এ কারণেই আতঙ্ক প্রতিরাতে তাড়া করে ফিরছে তাদের।

তবে শুধুমাত্র হোয়াইট চ্যাপেল অঞ্চলের দেহোপজীবিনীরাই নন। সে রাত্রে ঘুম ছিল না আরো দু'টি মানুষের চোখে। একজন সেই উন্মত্ত খুনীটা -রাতই তার শিকারের উপযুক্ত সময়। শিকার ধরার আশায় অন্ধকার তমসার বুক চিরে ছুটে চলে হিংস্র দুটি চোখ। তারপর কোন এক সময়ে রাতের নিস্তব্ধতা খানখান হয়ে যায় কোন এক হতভাগিনীর অমানুষিক আর্তনাদে। আর একজন? হোয়াইট চ্যাপেল থানার ডিউটি অফিসার। গতকাল রাত্রেই তার কাছে একটা অদ্ভুত চিঠি এসেছে। চিঠি না বলে বোধহয় তাকে স্বীকারোক্তি বলা ভালো। প্রেরকের নাম - জ্যাক দ্য রিপার।

তবে আমাদের আজকের এই গল্প জ্যাক দ্য রিপারকে নিয়ে নয়। তিনি এ গল্পের সূত্রধর মাত্র। গল্প শুরু হচ্ছে ১৬৫০ সালের ৭ই আগস্ট, হাঙ্গেরির মাটিতে। এই দিনটিতেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন এলিজাবেথ বাথোরি। কিন্তু কে এই এলিজাবেথ বাথোরি? ইতিহাসের পাতা উলটে খুঁজে নেওয়া যাক তার পরিচয়। হাঙ্গেরির ট্রানসিলভেনিয়ার বনেদি পরিবারের জন্মগ্রহণ করেন এলিজাবেথ। জন্ম থেকেই খিচুনি আর মাইগ্রেনের শিকার সে। মাত্র তেরো বছর বয়সে তার সাথে ঘটে যায় এক চরম ন্যাক্কারজনক ঘটনা। তেরো বছর বয়সেই এক সন্তানের জন্ম দিয়ে ফেলেন এলিজাবেথ। এই অনভিপ্রেত ঘটনায় কি নাবালিকা এলিজাবেথের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল?

আশ্চর্যের কিছু নেই, কারণ এই ঘটনার পর থেকেই এলিজাবেথ যেন আরো বেশি করে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠলো। সমাজ থেকে নিজেকে একপ্রকার বিচ্ছিন্ন করে নিল সে। পরিস্থিতি প্রতিনিয়তই আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছিল। বাড়ির প্রতিটি মানুষ এলিজাবেথের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন, মা-বাবা থেকে বাড়ির দাস-দাসী কেউ এর ব্যতিক্রম নন। এলিজাবেথের কারণে সমাজে মুখ দেখানো দায় হয়ে উঠেছে তার বাবা-মায়ের। বনেদি বংশের মানুষ তারা অথচ মেয়ের কারণে তাদের সামাজিক সম্মান আজ প্রশ্নের মুখে। শেষ পর্যন্ত একপ্রকার দায় ঝেড়ে ফেললেন এলিজাবেথের বাবা-মা। মাত্র পনেরো বছর বয়সে বিয়ে হয়ে গেল এলিজাবেথের।

আরও পড়ুন-পাঞ্জাব ভোটে কংগ্রেসের ঘরের শত্রু কংগ্রেসই!

ব্ল্যাক হিরো অফ হাঙ্গেরি- হ্যাঁ, এই নামেই হাঙ্গেরিতে অধিক পরিচিত ছিলেন এলিজাবেথের স্বামী ফেরেনস লডাসডি। হাঙ্গেরির ইতিহাসে সময়টা উত্তাল। অটোম্যান বন্দিদের উপর অত্যাচারের গ্রাফ প্রতিনিয়তই চড়ছে। আম আদমির জীবন হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ। এমনই এক অস্থির পরিস্থিতিতে এলিজাবেথ এলেন ফেরেন্সের ঘরণী হয়ে। লডাসডি ছিলেন হাঙ্গেরির প্রধান সেনাপতি; নতুন বিয়ের পর জীবনসঙ্গিনীর সঙ্গে যে কিছু মধুর মুহূর্ত উপভোগ করবেন সে গুড়ে বালি। বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই যুদ্ধে গেলেন লডাসডি। ফলে একাকিত্ব পুনর্বার ঘিরে ধরল এলিজাবেথকে। নাবালিকা অবস্থায় মা হওয়ার যন্ত্রণা এলিজাবেথের মনে যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল, তাতেই ঘৃতাহুতি করল দীর্ঘদিনের একাকিত্ব। এর ফল হলো মারাত্মক- একের পর এক অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ল এলিজাবেথ।

মাত্র তেরো বছর বয়সে সমাজের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিল এলিজাবেথ। সমাজ তার প্রতি সুবিচার করেনি কখনও। ফলস্বরূপ যত দিন গেল ততই সমাজের প্রতি বিতৃষ্ণা বাড়তে থাকল এলিজাবেথের। সেই বিতৃষ্ণার ফল ভোগ করতে থাকলো এলিজাবেথের বাড়ির প্রতিটি মানুষ। দাস-দাসীদের শরীরে সূচ ফোটানো বা শরীরের মাংস কেটে নেওয়ার মতো নৃশংসতাও পরিণত হল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায়। এলিজাবেথ নিজে ছিল অভিজাত পরিবারের প্রতিনিধি, আবার তার স্বামী হাঙ্গেরির সেনাপতি। ক্ষমতা ছিল এলিজাবেথের হাতের মুঠোয়। ফলে এলিজাবেথের বিরুদ্ধে মুখ খোলার কথা ভুলেও ভাবেননি কেউ।

এলিজাবেথের স্বামী ফেরন্স নিজেও ছিলেন প্রবল অত্যাচারী। অটোম্যান বন্দিদের কাছে তিনি ছিলেন একপ্রকার মৃত্যুর দূত। স্বামীর মৃত্যুর পর আরও অত্যাচারী হয়ে ওঠেন এলিজাবেথ। তার মনে এই সময় থেকেই এক ভ্রান্ত ধারণা জন্মায় - কুমারী মেয়ের রক্ত তাকে আরো সুন্দরী করে তুলবে এই ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে একের পর এক মহিলাকে হত্যা করতে শুরু করেন এলিজাবেথ। শুধু তাই নয়, হত্যার পর তাদের রক্ত পান করতেন তিনি- অর্থাৎ নৃশংসতার জঘন্যতম প্রতিরূপ। হত্যার পদ্ধতিও ছিল ভয়ঙ্কর। কুমারী মেয়েদের সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় ঠান্ডায় জমিয়ে মারা হতো, কেটে নেওয়া হতো তাদের শরীরের মাংস, বিশেষ পদ্ধতিতে শরীর থেকে বের করে নেয়া হতো সমস্ত রক্ত। নারকীয় হত্যাকাণ্ডের পর ভিকটিমের রক্তে স্নান করতো সে। উদ্দেশ্য একটাই - হয়ে উঠতে হবে ডাকসাইটে সুন্দরী।

সুন্দরী হবার প্রচেষ্টায় এলিজাবেথের কোন খামতি ছিল না, কিন্তু ওই যে বলে না ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। ঠিক একইভাবে একদিন শেষ হলো এলিজাবেথের মারণযজ্ঞের ইতিহাস। বেশ কিছুদিন থেকেই রাজা ম্যাথিয়ারের কাছে কিছু অভিযোগ জমা পড়ছিল এলিজাবেথকে কেন্দ্র করে। তারই ভিত্তিতে রাজা ম্যাথিয়ারের এক প্রতিনিধি দল তদন্তে নামে এলিজাবেথের বিরুদ্ধে। তদন্তে উঠে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। তদন্তকারী দল দাবি করে প্রায় ৫০-৮০ টি খুন করেছে এলিজাবেথ। যদিও ঐতিহাসিকদের মধ্যে এ বিষয়ে মতভেদ আছে - কারও কারও মতে ওই প্রতিনিধি দলের এক সদস্য ছিলেন এলিজাবেথের পারিবারিক বন্ধু। সেই বন্ধু পালিয়ে যেতে সাহায্য করে এলিজাবেথকে। যদিও শেষপর্যন্ত ধরা পড়ে এলিজাবেথ। পরবর্তী সময়ে জানা যায় ৫০-৮০টি নয়, প্রায় ৬৫০ টি খুন করেছে এলিজাবেথ। নির্বাসনে থাকা অবস্থায় মাত্র ৫৪ বছর বয়সে মারা যায় এলিজাবেথ।

আইনের চোখে এলিজাবেথ অপরাধী। কিন্তু কে অপরাধী  বানাল এলিজাবেথকে? সেই ধর্ষক? এলিজাবেথ যার বিকৃত মানসিকতার শিকার হয়েছিল মাত্র তেরো বছর বয়সে। নাকি এলিজাবেথের বাবা-মা? যারা প্রকৃত অর্থে কোনদিনই আশ্রয় হয়ে উঠতে পারেননি সেই ছোট্ট মেয়েটার কাছে। নাকি স্বামী? অর্ধাঙ্গিনী হবার পরেও এলিজাবেথ নয়, যুদ্ধ প্রাধান্য পেয়েছিল তার কাছে। নাকি এর জন্য দায়ী সেযুগের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ? যারা সেদিনের সেই একরত্তি মেয়েটাকে বোঝার চেষ্টাই করেনি কোনদিন। এলিজাবেথের কাজ সমর্থনযোগ্য না হলেও এই প্রশ্নগুলো কিন্তু উঠতেই থাকবে। বিচারের ভার রইল পাঠকের কাঁধে ...।

তথ্যসূত্র:-
১. "এলিজাবেথ বাথোরি,পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম নারী সিরিয়াল কিলার"-
সাখাওয়াত উল্লাহ সাকু
২. "এলিজাবেথ বাথোরি: ইতিহাসের প্রথম নারী সিরিয়াল কিলার!"- হেলাল আহমেদ ।

More Articles