বিশ্বের ধনীতম ব্যক্তি এবার মার্কিন প্রশাসনে! যেভাবে বিশ্ব দখলের পথে এগোচ্ছেন মাস্ক
Elon Musk Life: মাস্কের যখন বছর আটেক বয়স, বাবা-মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে যায়।
গত মাসে, এনভিডিয়ার সিইও জেনসেন হুয়াং বলেছেন, টেক টাইটান এলন মাস্ক হচ্ছেন, 'অতিমানব'। বলেছেন কারণ, মাস্কের কোম্পানি xAI, দ্রুততম এআই-প্রশিক্ষণ সুপার কম্পিউটারগুলির মধ্যে অন্যতম একটি কম্পিউটার তৈরি করে ফেলেছে। 'অতিমানব' বলাটা বাড়াবাড়ি নয় যদিও। ৫৩ বছর বয়সেই এলন মাস্ক বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি হয়েছেন। টেসলা এবং স্পেসএক্সের মতো অভাবনীয় উদ্যোগ তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত। এতদূর অবধি তাঁর একটা ভূমিকা বিশ্বের কাছে স্পষ্ট ছিল। তিনি হচ্ছেন টেক জায়ান্ট। এবার মাস্ক নয়া ভূমিকায়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর প্রশাসনে মাসকে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে তুলে ধরেছেন। টেক জায়ান্ট থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতা, তাও আবার আমেরিকার মতো দেশে! ট্রাম্প ঘোষণা করে দিয়েছেন, এলন মাস্ক আর বিবেক রামাস্বামী এবার থেকে 'সরকারি দক্ষতা বিভাগ' সামলাবেন। তাঁদের কাজই হচ্ছে অযথা ব্যয় কমানো। তবে বিভাগটি সরকারের অংশ হবে না।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পকে জেতানোর পিছনে মাস্কের অবদান বিপুল। বিশ্বের ধনীতম ব্যক্তির এই ব্যাপক উত্থান নিয়ে কোনও এককালে ওয়েব সিরিজ হবে নিশ্চয়ই! হওয়ার মতোই কাহিনিও। হিংসা-কবলিত, বর্ণবাদ-বিধ্বস্ত দক্ষিণ আফ্রিকায় বেড়ে ওঠা মাস্কের। সেখান থেকে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি এবং এখন মার্কিন সরকারের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বে পরিণত হওয়ার এই সফর সিনেমার মতোই তো। এই মুহূর্তে মাস্কের মোট সম্পদ ৩৩৫ বিলিয়ন ডলার!
জন্ম দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়ায়। পরিবার ছিল গোড়া থেকেই নড়বড়ে। মাস্কের যখন বছর আটেক বয়স, বাবা-মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে যায়। তবে নিজে কিছু করে ফেলার উদ্যোগ ছিল মাস্কের প্রথম থেকেই। খুব ছোটবেলা থেকেই বাড়িতে তৈরি চকলেট, ইস্টার এগ বিক্রি করা শুরু করেছিলেন মাস্ক। মাত্র ১২ বছর বয়সে প্রথম কম্পিউটার গেম তৈরি করেছিলেন তিনি। মাস্ক একাধিকবার বলেছেন, তাঁর শৈশব কঠিন ছিল। কীভাবে তাঁকে স্কুলে বঞ্চিত করা হয়েছিল, কীভাবে তিনি লড়াই করেছেন, অ্যাসপার্গার্স সিন্ড্রোমের কারণে ছোট থেকেই নানাভাবে কঠিন সমস্যার সঙ্গে যুঝতে হয়েছে তাঁকে। ওয়াল্টার আইজ্যাকসন এলন মাস্কের জীবনীতে লিখেছেন, "শুরু থেকেই, তিনি জানতেন যন্ত্রণা কাকে বলে, তবে কীভাবে এর থেকে বাঁচতে হয় তাও জানতেন।"
আরও পড়ুন- ভোটারদের কোটি কোটি টাকা ‘পুরস্কার’! কেন ট্রাম্পের হয়ে সালিশি করছেন এলন মাস্ক?
প্রথমে কানাডায় এবং তারপরে উচ্চ শিক্ষার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাওয়ার পর মাস্কের জীবন নতুন বাঁক বদল করে। মাস্ক পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি এবং পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। তারপরে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য ক্যালিফোর্নিয়ায় যান তিনি কিন্তু তা সম্পূর্ণ করেন না। ১৯৯০-এর দশকের 'ডটকম বুম'-এর সময় থেকেই নিজেকে একজন উদ্যোক্তা হিসেবে বাজিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নেন।
মাস্ক একটি ওয়েব সফ্টওয়্যার ফার্ম (Zip2) এবং একটি অনলাইন ব্যাংকিং কোম্পানি সহ দু'টি স্টার্ট-আপ প্রতিষ্ঠা করেন যা পরবর্তীকালে PayPal হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে, ২০০২ সালে ১.৫ বিলিয়ন ডলারে তা eBay-কে বিক্রি করা হয়। PayPal বিক্রি করার আগেই মাস্ক তাঁর পরবর্তী পদক্ষেপ এবং লক্ষ্য সম্পর্কে ভেবে রেখেছিলেন। মহাকাশ অভিযানকে আরও সস্তা করা ছিল মাস্কের লক্ষ্য।
২০০২ সালের প্রথম দিকে, মাস্ক স্পেস এক্সপ্লোরেশন টেকনোলজিস, বা স্পেসএক্স নামে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন, PayPal বিক্রির থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলার দিয়ে। ছয় বছর পর, তিনি একটি নতুন বৈদ্যুতিক গাড়ি কোম্পানি, টেসলা প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০৮ কোম্পানির সিইও হন মাস্ক। ২০০৯ সালে স্পেসএক্স NASA এবং টেসলার সঙ্গে ১.৫ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করে এবং আরও অনেক বিনিয়োগকারীই তাতে বিনিয়োগ করতে চান। এরপরে, আর ফিরে তাকাতে হয়নি। মাস্ক ওপেনএআই, সোলারসিটি এবং দ্য বোরিং কোম্পানির মতো বেশ কয়েকটি উদ্যোগ প্রতিষ্ঠা করেন এবং কিনেও নেন।
আরও পড়ুন- ভোটে জেতানোর পুরস্কার! ট্রাম্পের প্রশাসনে যে দায়িত্ব পেলেন এলন মাস্ক
২০১৭ সালে, মাস্ক নিউরালিংক প্রতিষ্ঠা করেন। এই নিউরালিংক এমন ডিভাইস তৈরি করছে যা মানুষের মস্তিষ্কের মধ্যে বসানো করা যেতে পারে। সেই বছরই ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক শুরু। মাস্ক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ব্যবসায়িক উপদেষ্টা পরিষদে যোগ দেন ঠিকই কিন্তু তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেওয়াতে পদত্যাগ করেন।
এরপর মাস্কের সেই ব্যাপক চর্চিত পদক্ষেপ! ২০২২ সালের অক্টোবরে ৪৪ বিলিয়ন ডলারে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম টুইটার কিনে নেন মাস্ক। ২০২৪ সালে ৫৩ বছর বয়সি মাস্ক তিনজন সঙ্গীর সঙ্গে মিলে ১১ জন সন্তানের জন্ম দেন। নাসার মহাকাশচারী সুনিতা উইলিয়ামস এবং বুচ উইলমোরকে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে স্পেসএক্সকেই।
এহেন 'অতিমানব' মাস্ক এবার ট্রাম্প প্রশাসনের 'খাস লোক'! মাস্ক নিজে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ব্যক্তিগতভাবে সবচেয়ে বেশি টাকা অনুদান দিয়েছেন। ট্রাম্পের প্রচারাভিযান সিংহভাগটাই সম্ভব হয়েছে মাস্কের দয়ায়। মাস্ক সমর্থিত একটি পিটিশনে সই করলে আমেরিকা পিএসি একজন ভোটারকে প্রতিদিন ১ মিলিয়ন ডলার করে দিয়েছে! ভোটারদের প্রভাবিত করার জন্য এত বিপুল টাকা কেন ব্যয় করলেন মাস্ক? কী এমন লাভ পেতে চলেছেন মাস্ক? রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, মাস্ক এবং তাঁর ব্যবসাগুলির এবার প্রচুর লাভ হতে চলেছে। ট্রাম্পের সঙ্গে মাস্কের সম্পর্ক আর মাস্কের এই নতুন পদের ফলে বৈদ্যুতিক যানবাহন শিল্পে প্রভাব পড়বে। ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পরে আর মাস্ক খোদ সেই প্রশাসনের অংশ হওয়াতে মাস্কের নানা উদ্ভাবনের উপর নিষেধাজ্ঞা ও নিয়ন্ত্রণ লাঘব করা হবে। এর আগে মাস্ক একাধিকবার বলেছিলেন, অতিরিক্ত সরকারি নিয়ন্ত্রণে উদ্ভাবনী শক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যেমন অটোনোমাস ড্রাইভিংয়ের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা ছিল মার্কিন সরকারের। মাস্ক মঙ্গল গ্রহে যেতে চান। সেখানে তাঁর যা যা পরিকল্পনা, ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পরে সেসবের নিষেধাজ্ঞাও শিথিল হবে! প্রশাসন মাস্কের পকেটে। ফলে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে শক্তিশালী প্রভাব ফেলবেন মাস্ক। এ অবশ্য নতুন আর কী? ভারতে মোদি সরকারের নেপথ্যে আদানির বিপুল অর্থের কথা তো অজানা নয়। অজানা নয়, কীভাবে কোটি কোটি টাকা ঢেলে সমস্ত আইন, সমস্ত নিয়মকে কাঁচকলা দেখিয়ে চলছে 'উন্নয়ন', জমি হাতানো। টাকার পরিমাণে সামান্য হেরফের ছাড়া বিশেষ বদল নেই। যাহা মাস্ক, তাহাই আদানি!