গুগলেও মেলে না সঠিক হদিশ, আসলে কারা ছিলেন স্টুয়ার্ট সাহেব এবং অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি

Fogeteble history of hindu Stuart and Antony firingi : ইতিহাস বিমুখতার ফলে যেই সব অধ্যায় এবং চরিত্রকে আমরা প্রায় ভুলতে বসেছি তাদের নাম করতে গেলে কবিয়াল অ্যান্টনি ফিরিঙ্গী এবং হিন্দু স্টূয়ার্ট-এর প্রসঙ্গ

হিন্দু স্টুয়ার্ট ঠিক করেছিলেন যে তিনি অবিভক্ত বাংলায় একটা মন্দির নির্মাণ করবেন। যদিও সেই সময়ে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাবাহিনীর অনেকেই স্টুয়ার্টের আচরণের সঙ্গে পরিচিত ছিল তবুও স্টুয়ার্টের মন্দির নির্মাণের পরিকল্পনা শুনে তাদের বেশিরভাগ জনই ভ্রু কুঁচকে ছিলেন। চার্লস স্টুয়ার্ট ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাবাহিনীর অনুগত সেনা ছিলেন। সেনাবাহিনীর প্রতি আনুগত্য এবং কাজের প্রতি নিষ্ঠার মাধ্যমে তার পদোন্নতি হয়েছিল। তার ফল স্বরূপ এই আইরিশ যুবক ক্রমে কোম্পানির সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল পদে আসীন হয়েছিলেন। সেনাবাহিনীর কাজের প্রতি নিষ্ঠা থাকলেও আরও একটি ব্যাপারে স্টুয়ার্ট যথেষ্ঠ নিষ্ঠাবান ছিলেন। তিনি ভারতে আসার পর থেকেই হিন্দু ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন এবং হিন্দু ধর্ম সহ ভারতের বহু রীতিনীতি মেনে চলতেন।

স্টুয়ার্ট যখন উত্তর ভারতে কোম্পানির অন্যতম বড় অশ্বারোহী বাহিনীর দ্বায়িত্বে ছিলেন তখন তাঁর সহকারী ছিলেন উইলিয়াম গার্ডনার। তাঁর লেখা বিভিন্ন চিঠি এবং অন্যান্য নথিপত্রে চার্লস স্টুয়ার্টের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেই সকল নথির মধ্যে অনেক জায়গায় তিনি স্টুয়ার্টকে জেনারেল পণ্ডিত অথবা পণ্ডিত স্টুয়ার্ট বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর লেখা থেকেই জানা যায় যে চার্লস স্টুয়ার্ট স্বল্পাহারী ছিলেন। রোজ গঙ্গা স্নান করতেন, মানুষের সঙ্গে দেখা হলে ‘জয় সীতারামজী’ বলে সম্বোধন করতেন। সেই সময়ের নথি থেকে জানা যায় যে গার্ডনারকে একবার স্টুয়ার্টের দায়িত্ব সামলাতে হয়েছিল কারণ স্টুয়ার্ট কাজ থেকে ছুটি নিয়ে কুম্ভ মেলায় যোগদান করতে গিয়েছিলেন। গার্ডনারের লেখা এবং অন্যান্য বিভিন্ন নথি থেকে জানা যায় যে স্টুয়ার্ট রোজ হিন্দু দেব-দেবীর পুজো করতেন। ভারতীয় পোষাক থেকে নাগড়াই জুতো, পিকদানি থেকে হুঁকো সবকিছুই ছিল তাঁর সংগ্রহে। ব্রিটিশ কোম্পানির সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী এক আইরিশ সেনার এইরকম আচরণের কারণেই ব্রিটিশ এবং ভারতীয় উভয়ের কাছেই তিনি চার্লস স্টুয়ার্টের বদলে হিন্দু স্টুয়ার্ট নামে পরিচিত হয়েছিলেন।

আরও পড়ুন - খ্রিস্টধর্মকে করে তুলতে চেয়েছিলেন ভারতীয়! ব্রিটিশদের চক্ষুশূল ছিলেন ব্রহ্মবান্ধব উপাধ‍্যায়

হিন্দু স্টুয়ার্টের কলকাতার উড স্ট্রিটের বাড়িতে বহু হিন্দু দেব-দেবীর মূর্তি ছিল। কথিত আছে যে, চার্লস সেগুলো ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। যদিও বিপরীত মত অনুযায়ী চার্লস স্টুয়ার্ট এই বিভিন্ন মূর্তি ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে চুরি করেছিলেন। হিন্দু স্টুয়ার্টের মৃত্যুর পরে তাঁর সংগ্রহে থাকা সব মূর্তি ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মৃত্যুর পরে চার্লস স্টুয়ার্টকে পার্ক স্ট্রিটের গোরোস্থানে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। ভারতীয় রীতিনীতির প্রতি অনুরাগ, হিন্দু ধর্মের প্রতি আকর্ষণ এবং লোকের মুখে ছড়িয়ে পড়া তাঁর হিন্দু স্টুয়ার্ট নামের কারণেই তাঁর সমাধি এমনভাবে তৈরী করা হয়েছিল যা আজ অবধি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। চারিদিকে বিভিন্ন উঁচু স্মৃতিস্তম্ভের মাঝে মন্দিরের অনুকরণে তৈরি হয়েছিল হিন্দু স্টুয়ার্টের সমাধি। যেই মন্দির বানানোর স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, মৃত্যুর পরে সেইরকম এক মন্দিরের অনুকরণে বানানো সমাধিতেই তিনি আশ্রয় পেয়েছিলেন। হিন্দু স্টুয়ার্টের মৃত্যুর প্রায় দুশো বছর পরে তার নাম বেশিরভাগ মানুষ ভুলতে বসেছে। তার সমাধি কখনও মূল্যবান জিনিসের লোভে কখনও আবার নিছক অবোধ মানুষের অদ্ভূত মজার খেলায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। ২০১৮ সালে তাঁর সমাধিতেই খোদাই করা একটি ফুলের নকশা কেউ অথবা কারা ভেঙে নিয়ে যায়। সেই ভাঙা অংশের কিছু টুকরো পরেরদিন মাটিতে পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল। যদিও বর্তমানে সুরক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি হওয়ার পরে এইরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়নি। তবে ইতিহাস বিমুখ এই জাতির মানুষ হয়তো এইভাবেই ইতিহাস থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকবেন। ইতিহাসের প্রতি আকৃষ্ট না হওয়ার কারণেই বাঙালি বর্তমানে নিজের পরিচয় ভুলতে বসেছে। তার সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে একের পর এক ইতিহাসের পাতা এবং সেই পাতাগুলোয় লেখা কিছু মানুষের গল্প।

আরও পড়ুন - মাদার টেরেসা: কতটা আলো আর কতটা কালো? উন্মোচিত সবটা

ইতিহাস বিমুখতার ফলে যেই সব অধ্যায় এবং চরিত্রকে আমরা প্রায় ভুলতে বসেছি তাদের নাম করতে গেলে কবিয়াল অ্যান্টনি ফিরিঙ্গীর নাম বলতেই হয়। দুটো বাংলা সিনেমা, কিছু গান এবং বউবাজার এলাকায় একটা কালী মন্দির না থাকলে হয়তো তাঁর কথা বর্তমান প্রজন্ম জানতেও পারতো না। কিন্তু আসলে কে ছিল এই অ্যান্টনি? তাঁর ব্যাপারে খুব বেশি জানা যায় না। তাঁর সম্পর্কে আজ অবধি যা কিছু লেখা হয়েছে তার অনেকটাই পরস্পর বিরোধী। সর্বজ্ঞানী গুগলও সেই সম্পর্কে নিশ্চুপ। অ্যান্টনির খোঁজ করলে সে অ্যান্টনির জীবনের কিছু শোনা গল্পের উপর ভিত্তি করে তৈরী হওয়া কাল্পনিক সিনেমার ব্যাপারে বলতে থাকে। আসলে তারও দোষ নেই। অ্যান্টনি যেন আসলে মরীচিকা। তাঁর বাস্তব অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও সে যেন রূপকথার গল্প। তার প্রতিদ্বন্দ্বি ভোলা ময়রাকে উদ্দেশ্য করে কলকাতাবাসী একটা রাস্তার নাম রেখেছে কিন্তু ফিরিঙ্গীকে যেন নিজেই নিজের অস্তিত্বের প্রমাণ দিতে হয়েছে সবসময়। সেই পর্তুগিজ সাহেব কি আদৌ পর্তুগালে জন্মেছিলেন নাকি এই দেশেই তার জন্ম? সতীর চিতা থেকে বাঁচানো সৌদামীনীকে তিনি কি বিবাহ করেছিলেন নাকি তাঁকে বাঁচানোর পরে তিনি এবং সৌদামীনী শুধু এক বাড়িতে থাকতেন মাত্র? পারিবারিক নুনের ব্যবসায় কি তাঁর সঙ্গে বঞ্চনা করা হয়েছিল নাকি শাস্ত্র জ্ঞান লাভের সময়ে তিনি ব্যবসার প্রতি অবহেলা করেছিলেন, যার ফলে তাঁর ব্যবসায় লোকসান হয়। তাঁকে নিয়ে পরস্পর বিরোধী লেখার কারণে হয়তো আমরা প্রকৃত অ্যান্টনিকে চিনতে পারি না। আমরা শুধু জানি তাঁর আগমনীর গান, এবং কবিগানের লড়াইয়ের গল্প। আমরা দেখি তাঁর বানানো মন্দির যাকে আমরা ফিরিঙ্গী কালী বাড়ি বলে চিনি। এ যেন নিজের কাজের মধ্যে দিয়েই বলে যাওয়া যে, বিশ্বাস করো আমি ছিলাম। আমি ছিলাম বাংলার এক রক্ত মাংসের কবিয়াল। তাঁকে নিয়ে তৈরী হওয়া দুটো বাংলা সিনেমার পরে আজও তিনি যেন বাঙালির কাছে কেবল এক ট্র্যাজিক হিরো। বাঙালি বাকি সবকিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে থাকতে চায়। তাই তাঁর জীবনের শোনা গল্পের উপর ভিত্তি করে তৈরী হওয়া একটি কাল্পনিক সিনেমার সংলাপ ধার নিয়ে বলা যায় যে, অ্যান্টনিকে খুঁজলে অত সহজে পাওয়া যাবে না। কেন যাবে না? কারণ আমরা খুঁজতে চাই নি অথবা বলা ভালো খুঁজতে চাই না।


তথ্য ঋণ : দ্যা টাইমস অফ ইন্ডিয়া, পিপল ট্রি, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস।

More Articles