ইতিহাস বই থেকে বাদ গুজরাত দাঙ্গা, সিলেবাস বদলে যে সত্যি আড়াল করছে বিজেপি
শুধুই গুজরাত দাঙ্গা ছেঁটে ফেলা নয়, একইসঙ্গে সিবিএসই-র একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং ইতিহাসের সিলেবাস থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে মুঘল দরবার, কোল্ড ওয়ার, অ্যাফ্রো-এশিয়ান ইসলামিক সাম্রাজ্য-সহ আরও একাধিক বিষয়।
মোদি-শাহ চাননি গুজরাত-দাঙ্গার কথা আগামী প্রজন্মের নজরে আসুক। এনসিইআরটি বা রাষ্ট্রীয় শৈক্ষিক অনুসন্ধান এবং প্রশিক্ষণ পরিষদ দ্রুত সেই ইচ্ছাপূরণ করে দিল।
সিবিএসই-র একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির সিলেবাস থেকে মুছে ফেলা হলো ২০০২ সালে গুজরাতে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক কালের বীভৎসতম সাম্প্রদায়িক হানাহানির ইতিহাস। তবে এই উদ্যোগ অনেকটা কাকের খাবার লুকিয়ে রাখার মতোই। কাক যখন কোনও খাবার লুকিয়ে রাখে, তখন নিজের চোখ বন্ধ করে নেয়৷ বায়সকূল বিশ্বাস করে, চোখ বন্ধ থাকায় তারা যখন দেখতে পায়নি কোথায় খাবার লুকিয়ে রাখা হলো, তখন দুনিয়ার কেউই দেখতে পায়নি। কাক-পথ অনুসরণ করেই মোদি-শাহ পড়ুয়াদের পাঠ্যক্রম থেকে লুকিয়ে দিল গুজরাত দাঙ্গা। বিজেপি-র ধারণা, সিলেবাসে যখন ওই পরিকল্পিত গণহত্যার কথা থাকছে না, তখন তা আর কেউ কখনওই জানতে পারবে না।
শুধুই গুজরাত দাঙ্গা ছেঁটে ফেলা নয়, একইসঙ্গে সিবিএসই-র একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং ইতিহাসের সিলেবাস থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে মুঘল দরবার, কোল্ড ওয়ার, অ্যাফ্রো-এশিয়ান ইসলামিক সাম্রাজ্য-সহ আরও একাধিক বিষয়। সিলেবাস থেকে এই বিষয়গুলি কেন বাদ দেওয়া হলো তার কারণ হিসেবে ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিংয়ের ছোট্ট উত্তর, এই বিষয়গুলি অপ্রাসঙ্গিক। বলা হয়েছে, কোভিড অতিমারীর প্রেক্ষিতে পড়ুয়াদের ওপর চাপ কমাতেই সিলেবাসে এই বদল। ওদিকে এনসিইআরটি-র নির্দেশ পাওয়ামাত্রই সিবিএসই বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানিয়েছে, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং ইতিহাসের সূচি থেকে ঠিক কী কী বাদ গিয়েছে।
আরও পড়ুন: বেছে বেছে বাদ যিশু থেকে টিপু সুলতান, কর্নাটকের বিকৃত সিলেবাস চেনাচ্ছে বিজেপির ‘জাত’
সিবিএসইর নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলন, ঠান্ডা লড়াই, মুঘল দরবারের ইতিহাস, এই ধরনের বিষয় ফাইনাল পরীক্ষায় আসবে না। কৃষির ওপর বিশ্বায়নের প্রভাব বা আফ্রিকায় মুসলিম সাম্রাজ্যের প্রসারের মতো বিষয়গুলিও এক খোঁচায় বাদ দেওয়া হয়েছে। ওদিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান সিলেবাস থেকে গণতন্ত্র ও বৈচিত্র্য এবং দশম শ্রেণির সাহিত্যে ফৈয়াজ আহমেদ ফৈয়াজের দু'টি কবিতার অনুবাদও বাদ দেওয়া হয়েছে। এনসিইআরটি বলেছে, কিছু কিছু বিষয় আগেই নিচু শ্রেণিতে পড়ানো হয়ে গিয়েছে। প্রসঙ্গত, শুধুই সিবিএসই স্কুলগুলিতে নয়, দেশের একাধিক রাজ্য বোর্ডও এই এনসিইআরটির বই পড়ায়। ফলে সিবিএসই ছাড়াও অন্য বোর্ডের পড়ুয়ারাও এই সব বিষয় আর পড়তে পারবে না।
এনসিইআরটি যে বিজ্ঞপ্তি বৃহস্পতিবার প্রকাশ করেছে, তাতে বিশেষভাবে বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট পাঠ্য বইয়ের ১৮৭ থেকে ১৮৯ নম্বর পৃষ্ঠায় গুজরাত দাঙ্গার যে অধ্যায় রয়েছে, তা বই থেকে সরানো হচ্ছে। ওইসব পৃষ্ঠায় গত ২০০২ সালের ১ মার্চ তারিখের একটি সর্বভারতীয় সংবাদপত্রে প্রথম পাতার প্রকাশিত একটি ছবিও রয়েছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যে ৩ পৃষ্ঠা সরানো হয়েছে তার একটিতে লেখা আছে, “গুজরাত দাঙ্গা দেখিয়েছে সরকারি প্রশাসনও সাম্প্রদায়িক আবেগের প্রতি সংবেদনশীল হয়ে উঠেছে। ২০০২ সালে গুজরাতে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে যেভাবে ধর্মীয় অনুভূতি ব্যবহার করা হয়েছিল, তার বিপদ সম্পর্কে আমাদের সতর্ক করেছে। ওই ঘটনা গণতান্ত্রিক রাজনীতির পথে বাধা সৃষ্টি করেছে।” প্রসঙ্গত, গুজরাত দাঙ্গার সময় ওই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
এখানেই শেষ নয়, সপ্তম শ্রেণির সিলেবাস থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে একাধিক দলিত লেখকের কিছু লেখাও। প্রসঙ্গত, কিছুদিন আগে গুজরাতের শিক্ষামন্ত্রী বিধানসভায় জানিয়েছিলেন, স্কুলের সিলেবাসে গীতা পড়ানো হবে। ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যসূচিতে ঢুকেছে গীতা। চলতি শিক্ষাবর্ষ থেকেই পড়ানো হচ্ছে। একই সঙ্গে 'নকশাল আন্দোলনের ইতিহাস' এবং 'জরুরি অবস্থা সম্পর্কিত বিতর্ক' সিলেবাস থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
মোদি সরকার ইতিমধ্যেই দেশের ঐতিহাসিক বহু জায়গার নাম বদলে দিয়েছে। বদলাচ্ছে আরও অনেক নাম। এই নাম বদলের মাধ্যমে কেন্দ্র শুরু করেছে ইতিহাস বদলের পালা। ইতিহাস বলছে, হলদিঘাট যুদ্ধে সম্রাট আকবরের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন মেবারের রাজপুত রাজা রানা প্রতাপ সিং। কিন্তু এখন মেবারের সরকারি পাঠ্যপুস্তকে ওই যুদ্ধে আকবরের পরাজয়ের কথা দেখা যাচ্ছে, তা দেখে অনেকে হতবাক। সাম্প্রতিক অতীতে, পাঠ্যপুস্তকের ইতিহাসের পাতা থেকে মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস লোপাট হয়েছে। একাদশ শ্রেণির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বইয়ে কংগ্রেসকে ব্রিটিশদের লালিত সন্তান বলে উল্লেখ করা হয়েছে। দ্বাদশ শ্রেণির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বইয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নোট বাতিলের সিদ্ধান্তকে 'কালো টাকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ' বলে উল্লেখ করা হয়েছে। নোট বাতিলের মাহাত্ম্য বোঝাতে অর্থনীতির বইয়ে আলাদা একটি অধ্যায়ও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস থেকে বিদেশি লেখকদের বই বাদ দেওয়া হয়েছে। বিরোধীদের বক্তব্য, ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে হিন্দুত্বকে আরও বেশি করে প্রচারে রাখার জন্য মোদির দল ভারতের বিভিন্ন স্থানের ঐতিহাসিক নাম মুছে পূর্ব নামে ফিরিয়ে আনছে, সিলেবাস থেকে বিজেপির পক্ষে অস্বস্তিকর ইতিহাস ঢালাও বাদ দেওয়ার কার্যক্রম চালু করেছে।
ওদিকে দিনকয়েক আগে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ রাজপুতানার ইতিহাস সম্পর্কিত একটি বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ভারতীয় ইতিহাসবিদদের কাছে শুধু মুঘল শাসকরাই গুরুত্ব পেয়েছেন। উপেক্ষিত হয়েছেন অন্য রাজবংশের গুরুত্বপূর্ণ শাসকেরা। সুলতানি ও মুঘল শাসকদের বিরুদ্ধে রাজপুতানা, অহম বা অসম-সহ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের রাজাদের লড়াইকে ‘সংস্কৃতি, ভাষা এবং ধর্ম রক্ষার যুদ্ধ’ বলেও চিহ্নিত করেছেন শাহ। একই সঙ্গে হুমকির সুরে অমিত শাহ বলেন, ‘‘আমাদের সত্য লেখা থেকে কেউ এখন আটকাতে পারবে না। আমরা এখন স্বাধীন। আমরা আমাদের ইতিহাস নিজেদের মতো করে লিখতে পারি।’’ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন মন্তব্যে ইতিহাসের গেরুয়াকরণের বার্তা স্পষ্ট বলেই মনে করছে বিরোধীরা।
সিলেবাস থেকে গুজরাত দাঙ্গার অংশ সরিয়ে এ কোন সত্য প্রকাশ করতে উদ্যোগী হয়েছে নরেন্দ্র মোদি- অমিত শাহর সরকার, প্রশ্ন উঠছে দেশজুড়েই।