কোন পথে কীভাবে বাংলাদেশ যায় এ-দেশের গরু! রইল আসল তথ্য
Cattle Smuggling: সিবিআই সূত্রে খবর, এই পাচারচক্রের জাল সারা দেশে বিস্তৃত।
গরুপাচার মামলায় বিগত ১১ অগাস্ট অনুব্রত মন্ডলকে গ্রেফতার করেছে সিবিআই। সীমান্ত পার করে গরু পাচার মামলায় অনুব্রত মন্ডলকে জেরা করে তথ্য তুলে আনা এই মুহূর্তে সিবিআইয়ের প্রধান লক্ষ্য। পরপর দু'বার জামিনের আবেদন খারিজ হয়ে আসানসোলের বিশেষ সংশোধনাগারে এই মুহূর্তে বন্দি অনুব্রত মন্ডল। ইতিমধ্যেই সিবিআই এই গরুপাচার মামলা নিয়ে বেশ কিছু তথ্য জোগাড় করতে পেরেছে। সায়গল হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদের পাশাপাশি বিএসএফ জওয়ানের গ্রেফতারি, সিবিআইয়ের হাতে ইতিমধ্যেই চলে এসেছে গরুপাচারের সে বিশেষ পথের খোঁজ।
তবে, গরুপাচার মামলা যে শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গেই সীমিত, সেটা কিন্তু নয়। পশ্চিমবঙ্গের গোবলয়টিও এই গরুপাচার মামলার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত রয়েছে। এরই মধ্যে পুরুলিয়ার ঝাড়খণ্ড বর্ডারের কাছাকাছি জায়গায় আমুল দুধের কোম্পানির একটি গাড়ি থেকে উদ্ধার হয়েছে বেশ কয়েকটি গরু। সূত্রের খবর, এই গরুগুলিকে ভিনরাজ্যে পাচারের জন্যই এই গাড়ি করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। চাঞ্চল্যকর বিষয়টি হলো, এই গাড়িটি কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের রেজিস্ট্রিকৃত গাড়ি নয়, বরং গাড়িটির রেজিস্ট্রেশন উত্তরপ্রদেশের।
সিবিআই সূত্রে খবর, এই পাচারচক্রের জাল সারা দেশে বিস্তৃত। গরুপাচার মামলার মূল অভিযুক্ত এনামুল হককে জেরা করে তদন্তকারীরা যে তথ্য পেয়েছেন, তাতে স্পষ্ট, উত্তর এবং পশ্চিম ভারত অর্থাৎ পাঞ্জাব, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ এবং রাজস্থান থেকে সরাসরি গরু আসত বীরভূমে। আর সেখান থেকেই গরুপাচারকারীদের পরিচিত বেঙ্গল করিডর দিয়ে বাংলাদেশে পাচার হয়ে যেত সেই গরু।
আরও পড়ুন: অনুব্রত মন্ডলের বেনামি সম্পত্তির আড়ালে আসলে তিনি, কে এই আবদুল লতিফ?
বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে এই মুহূর্তে ৪,০৯৬ কিলোমিটারের সীমান্তরেখা রয়েছে। আর এর মধ্যে ২,২১৭ কিলোমিটার রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে। এছাড়া অসমের সঙ্গে রয়েছে ২৬২ কিলোমিটারের সীমান্ত, ত্রিপুরার সঙ্গে রয়েছে ৮৫৬ কিলোমিটারের সীমান্ত, মিজোরামের সঙ্গে রয়েছে ১৮০ কিলোমিটারের সীমান্ত এবং মেঘালয়ের সঙ্গে রয়েছে ৪৪৩ কিলোমিটারের সীমান্তরেখা। এই কারণেই পাচারকারীদের সব থেকে উপযুক্ত পথ এই বেঙ্গল করিডর।
কী ধরনের গরু নিয়ে আসা হতো? যাদের সন্তান প্রজনন ক্ষমতা নেই, অর্থাৎ সেই সমস্ত বয়স হয়ে যাওয়া বলদ পাচারকারীদের প্রথম পছন্দ। ভিনরাজ্য থেকে এই সমস্ত বলদ নিয়ে আসা হতো বীরভূমে। বীরভূমের ইলামবাজারে বসে এই বিরাট গরুর হাট। আর সেই হাটেই পাচারের সমস্ত পরিকল্পনা করা হতো বলে উঠে আসছে সিবিআইয়ের তদন্তে। সিবিআই সূত্রের খবর, এনামুল এবং অন্যান্যদের জেরা করে তাদের হাতে এই পাচারকারীদের ব্যাপারে বেশ কিছু তথ্য উঠে এসেছে। ইলামবাজারের গরুর হাটের ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ একটা সময় ছিল আবদুল লতিফের হাতে। এই মুহূর্তে আবদুল লতিফ ফেরার থাকলেও, এই মামলায় তার কিন্তু নাম শামিল।
ইলামবাজারের ওই গরুর হাট ছিল পুরোপুরি অনুব্রত মন্ডলের নিয়ন্ত্রণাধীনে। সেখান থেকে ট্রাকে করে গরু চলে আসত বীরভূমের ফুটিসাঁকো বা বাদশাহি রোড ধরে মুর্শিদাবাদ সীমান্তবর্তী একাধিক গ্রামে। সেই গ্রামের বিভিন্ন ঘাটালে এই সমস্ত গরুগুলিকে রাখা হতো পাচার করার আগে পর্যন্ত। তারপর অপেক্ষা করা হতো বিএসএফ জওয়ান এবং কাস্টম অফিসারদের সবুজ সংকেতের। এই জায়গাতেই বিএসএফ জওয়ানদের দেওয়া হতো একটা মোটা টাকা ঘুষ। আর সেই ঘুষের লোভেই তারা অনুমতি দিত পাচারের।
ইতিমধ্যেই কাস্টমস অফিসার এবং বিএসএফের শীর্ষকর্তাদের একাংশের তালিকা হাতে এসেছে সিবিআইয়ের। জানা যাচ্ছে, বিএসএফের শীর্ষ কর্তাদের একাংশর সঙ্গে এনামুল হকের সিন্ডিকেটের একটি সরাসরি যোগাযোগ ছিল। পাচারের পরিভাষায় এই যোগাযোগটিকে বলা হয়- লাইন খোলা। নির্দিষ্ট দিনে শুধুমাত্র এক ঘণ্টা বা দু'ঘণ্টার জন্য খুলে দেওয়া হতো সীমান্তের একটি চোরাপথ। এবং সেই পথের মাধ্যমেই পাচার করা হতো গরু। বাংলাদেশ থেকেও আসত পাচারকারীরা। তারা সরাসরি এই গরু নিয়ে চলে যেত বাংলাদেশে।
তবে, বেঙ্গল করিডর ছাড়াও পাচারকারীদের কাছে আরও একটি করিডোর রয়েছে, যেটি আকারে ছোট হলেও, এই রাস্তা দিয়েও পাচার হয়ে থাকে। সেটি হলো উত্তর-পূর্ব করিডর। এক্ষেত্রে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির সীমানা ব্যবহার করা হয়ে থাকে গরুপাচারের ক্ষেত্রে। এই পথের অন্যতম নোডাল পয়েন্ট হিসেবে কাজ করে পশ্চিমবঙ্গ-বিহার সীমান্তের কিষানগঞ্জ নামের জায়গাটি। এই করিডর দিয়ে পাচার হয় রাজস্থান, হরিয়ানা, পাঞ্জাব এবং মধ্যপ্রদেশ এলাকার গরু। এই পথে উত্তর ভারত থেকে জাতীয় সড়কের মাধ্যমে কিষানগঞ্জে এসে পৌঁছায় গরু। তারপর সেই গরু হস্তান্তর হয়ে যায় পাচারকারীদের হাতে। এবার তারা দার্জিলিং এবং জলপাইগুড়ি জেলা হয়ে সোজাসুজি সেই গরু নিয়ে বেরিয়ে যান উত্তর-পূর্বে। অসম, মেঘালয় এবং ত্রিপুরা রাজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশে পৌঁছয় ওই গরু।
এই পথের মাধ্যমে পাচার হলে অসমের ধুবড়ি জেলা, অসম, মেঘালয় এবং বাংলাদেশের ত্রিমুখী জংশনের মানকচর জেলার সীমানা দিয়েই বাংলাদেশে চলে যায় গরু।
শুধু স্থল-সীমান্ত নয়, কিছু সংখ্যক গরু জল-সীমান্ত ধরেও পারাপার করা হতো। বাজারে যাতে কোনওরকম বাধা না আসে, তার জন্য একটা সুনির্দিষ্ট চ্যানেল কাজ করত এবং সেই চ্যানেলের মাধ্যমে সুসংহত পথে এগিয়ে যাওয়া যেত বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে। ভিনরাজ্য থেকে গরু এনে মুর্শিদাবাদ থেকে জলপথে বাংলাদেশে পাচার করা হতো সারি সারি গরু। ভিন্ন রাজ্য থেকে গরু আনার সময় যে সমস্ত থানার ওপর দিয়ে এই গরু পাচার হতো, সেখানকার থানার কর্তা এবং স্থানীয় নেতারা একটা মোটা অঙ্কের টাকা পেতেন। সিবিআই জানতে পেরেছে, এই টাকাও মুর্শিদাবাদ এবং বীরভূম জেলার একজন প্রভাবশালী নেতার কাছ থেকেই যেত।
সিবিআই সূত্রে খবর, এনামুল বয়ানে জানিয়েছেন, গোটা সিস্টেমকে চালু রাখার জন্য মোটা টাকার ঘুষ দেওয়া হতো। একাধিক কমান্ড্যান্ট পর্যায়ের আধিকারিক, ডিআইজি বা আইজি স্তরের একাধিক অফিসার এই পুরো বিষয়টার সঙ্গে জড়িত। তাঁরাও আর্থিকভাবে সুবিধা পেয়েছেন বলে বয়ানে জানিয়েছেন এনামুল হক। ইতিমধ্যেই দু'জন বিএসএফ জওয়ান সতীশ কুমার এবং জেডি ম্যাথিউকে গ্রেফতার করা হয়েছে, বেআইনি পাচারের অভিযোগে। তবে, এই সিন্ডিকেট জাল এখনই শেষ নয়। বিভিন্ন জায়গায় অত্যন্ত গভীরে ছড়িয়ে রয়েছে এই সিন্ডিকেটের সংযোগ। যে দামে গরু কেনা হতো, তার থেকে প্রায় ৮ থেকে ১০ গুণ দামে বাংলাদেশে পাচার হতো ওই গরু। আর পকেট ভরত অনুব্রত মন্ডলের মতো রাঘববোয়ালদের।