আজও সেরা ছবির তালিকায় 'পথের পাঁচালী', 'শোলে'! কতটা ক্ষতি হচ্ছে ভারতীয় সিনেমার
FIPRESCI List: আশ্চর্যের বিষয় এই যে, কেবল এই দশটি ছবিই বেশি ভোট পেয়েছে। মানে, দশ নম্বর তালিকায় থাকা 'শোলে'-কে টপকাতে পারেনি অন্যান্য অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ ছবিও!
সর্বকালের সেরা দশটি ভারতীয় ছবি বেছে নিতে 'ফিপ্রেস্কি-ইন্ডিয়া'-র সদস্যরা মিলে সম্প্রতি একটি গোপন পোলের আয়োজন করেছিলেন। ৩০ জন সদস্য মিলে যে-যে ছবিগুলিতে ভোট দিয়েছিলেন, সেগুলির মধ্যে থেকে সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়ার নিরিখে দশটি ছবির একটি তালিকা দিনদুয়েক আগে প্রকাশিত হয়। সেই তালিকায় কোন কোন ছবি জায়গা করে নিতে পেরেছে, একবার দেখে নেওয়া যাক।
প্রথমেই আছে একমেবদ্বিতীয়ম 'পথের পাঁচালী'। সেরা ভারতীয় ছবির তালিকা, অথচ সেখানে সত্যজিৎ রায় থাকবেন না, এমনটা বাস্তবে হতেই পারে না। দ্বিতীয় স্থানে আছে ঋত্বিক ঘটকের 'মেঘে ঢাকা তারা'। তৃতীয়, মৃণাল সেনের 'ভুবন সোম'। চতুর্থ, আদুর গোপালকৃষ্ণনের 'এলিপ্পাথায়াম'। পঞ্চম, গিরিশ কাসারাভাল্লির 'ঘটশ্রাদ্ধ'। ষষ্ঠ, এমএস সথ্যুর 'গরম হাওয়া'। সপ্তম, সত্যজিৎ রায়ের 'চারুলতা'। অষ্টম, শ্যাম বেনেগালের 'অঙ্কুর'। নবম, গুরু দত্তর 'পিয়াসা'। দশম, রমেশ সিপ্পির 'শোলে'।
উপরিউক্ত এই তালিকা থেকে একটা ব্যাপার পরিষ্কার, ভারতের সিনে সোসাইটি-র দিকপাল সদস্যরা এখনও সত্যজিৎ রায়ের 'সুপ্রিমেসি' থেকে বের হতে পারেননি। বিগত পঞ্চাশ-ষাট বছর ধরে কতবার যে 'পথের পাঁচালী' এরকম সর্বসেরা ছবির খেতাব জিতে নিয়েছে, তার কোনও সীমা-পরিসীমা নেই। ধরে নিতেই হয় যে, সাতষট্টি বছর আগে মুক্তি পাওয়া এই ছবিটির পরে এখনও অবধি ভারতে এই পর্যায়ের বা এই পর্যায়কে ছাপিয়ে যাওয়া চলচ্চিত্র তৈরিই হয়নি। 'পথের পাঁচালী' ছবিটির গুরুত্ব অপরিসীম, স্বাভাবিকভাবেই সকলের ধন্য ধন্য করাই উচিত, কিন্তু এর দরুন আমরাই আমাদের চলচ্চিত্রের ইতিহাসের অনেক ক্ষতিসাধন করে ফেলেছি, খানিকটা অজান্তেই।
আরও পড়ুন: মানুষের গল্প বলে তাঁর ছবি! অসমিয়া চলচ্চিত্রকে একাই বদলে দিয়েছেন জাহ্নু বড়ুয়া
বাংলায় সত্যজিৎ, মালয়ালমে আদুর, হিন্দিতে বেনেগালের আধিপত্যের চাপে ঢাকা পড়ে গেছে অসাধারণ সব ফিল্মমেকারদের অবদান এবং তাঁদের অবাক করে দেওয়ার মতো সব ছবি। বাংলাতেই সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণালের পরিসরের বাইরে থেকে গেছেন বারীন সাহা, রাজেন তরফদার, তপন সিনহা, তরুণ মজুমদার, গৌতম ঘোষ, উৎপলেন্দু চক্রবর্তী, নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায় ও আরও অনেকে। তাঁরা যেন অনেকাংশেই ফিল্ম সোসাইটির উন্মুক্ত প্রাঙ্গনে অচ্ছুতের মতো। কোথাও কোনও গবেষণামূলক কাজই হয়নি এতদিন, হচ্ছেও না। মালয়ালম ছবি বলতেই যেন কেবলই আদুর! আদুরের ছবিগুলো, বিশেষত 'এলিপ্পাথায়াম', 'মুখমুখম', 'মাথিলুকাল' ইত্যাদি খুব আশ্চর্য মানের ছবি, কিন্তু কেন আদুর-ব্যতীত গোবিন্দন অরবিন্দন, জন আব্রাহাম, শাজি করুনদের নিয়েও কথা বলা হবে না! আদুরের 'এলিপাত্থায়াম'-এর সমান গুরুত্ব রাখে অরবিন্দনের 'পক্কুভেইল' অথবা আব্রাহামের 'আম্মা আরিয়ান'। খোদ আদুরের শ্রেষ্ঠ কাজটিই হলো 'মাথিলুকাল', বরং 'এলিপ্পাথায়াম' কিছুটা হলেও অ্যামেচারিশ একটি কাজ― রূপক বেশিমাত্রায় ব্যবহৃত হওয়ায় বক্তব্য বেশি উচ্চকিত হয়ে উঠেছে। কন্নড় ভাষায় কাসারাভাল্লির 'ঘটশ্রাদ্ধ' মনে রাখা হয়, অথচ সথ্যু-ই যে কন্নড়েও বেশ কিছু ছবি বানিয়েছিলেন, সেগুলোর গুরুত্ব বিচার্য হয় না। এন লক্ষ্মীনারায়ণ, শঙ্কর নাগ, টি এস নাগবরণ? শ্যাম বেনেগাল খুবই বাজার-মাতানো ফিল্মমেকার ছিলেন, তাঁর ছবিতে গভীরতার উত্থান-পতন লেগে থাকলেও দর্শকদের সেসব ছবি ছুঁতে পেরেছিল। তাই বলে বেনেগালের থেকে অনেক-অনেক এগিয়ে থাকা সৈয়দ আখতার মির্জা, মণি কাউল, কুমার সাহানি, কমল স্বরূপের ছবিগুলো, অথচ সেসব নিয়ে বিগত তিরিশ-চল্লিশ বছরে কোথাও কোনও চর্চাই নেই যেন! কমল স্বরূপের 'ওম দরবদর' ছবিতে থাকা ছুরির ফলার মতো তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ তো বেনেগালের মাঝারি মানের সোশিও-পলিটিক্যাল ছবিগুলোতেও নেই! '২৭ ডাউন' নামের একটি মাত্র ছবিতে এমারজেন্সির আগে-পরে ভারতীয় পুরুষদের দ্বিধা-দ্বন্দ্বের যে অসামান্য চিত্রায়ন অবতার কৃষ্ণ কাউল করেছিলেন, তার জুরি মেলা ভার। অথচ ছবিটার উল্লেখ প্রায় কোথাওই হয় না।
সিনে সোসাইটি-র আরেকটি সমস্যা হলো, তাঁরা মনে করেন (এবং বিশ্বাসও করেন) যে, আটের দশকের পরে ভারতে আর চলচ্চিত্র তৈরিই হয়নি কোনও। নয়তো যে হারে বছর বছর 'প্রিভিলেজ কালচার'-এর প্রতীক সত্যজিৎ ও তাঁর মতো আরও কিছু প্রথিতযশাদের নিয়ে বই বের হয়, সেই তুলনায় নয়ের দশক থেকে এখনও অবধি বিভিন্ন ভাষার ভারতীয় ছবি নিয়ে কোনও বইপত্রই প্রকাশিত হয়নি প্রায়। মাতব্বর চলচ্চিত্র-গবেষকরা হয় নাম-না-জানা কোনও ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে এসব থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকেন, আর নয়তো নতুন যুগের নতুন ধারার ছবিকে পাত্তা দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন না। যে কারণে 'পথের পাঁচালী' থেকে খুব বেশি দূর আমরা এগোতে পারিনি এতগুলো বছর পার করার পরেও। উত্তর-পূর্ব ভারতের ছবিগুলোকে স্বীকৃতি দিইনি। প্রত্যন্ত ভাষায় নির্মিত ভালো কাজগুলোর ডকুমেন্টেশন করে উঠতে পারিনি।
'ফিপ্রেস্কি ইন্ডিয়া'-র গুটিকয়েক সদস্যদের ভোটের ভিত্তিতে বানানো এই তালিকা নিয়ে আমার ব্যক্তিগত কোনও ক্ষোভ নেই। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, কেবল এই দশটি ছবিই বেশি ভোট পেয়েছে। মানে, দশ নম্বর তালিকায় থাকা 'শোলে'-কে টপকাতে পারেনি অন্যান্য অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ ছবিও! আরও আশ্চর্যের, এই তালিকায় আটের দশকের মাঝামাঝি থেকে সাম্প্রতিক সময় অবধি কোনও ছবিই জায়গা করে নিতে পারেনি! এছাড়াও আশ্চর্যের, খোদ সত্যজিতেরই দু'টি ছবি এই তালিকায় রয়েছে! প্রশ্ন ওঠেই যে, সেরা কি কেবল এগুলিই?
ভারতীয় চলচ্চিত্রে দেবতা-স্বরূপ সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল বা আদুর-বেনেগালদের সমসময়ে ও পরবর্তীতে অসংখ্য প্রণিধানযোগ্য কাজ হয়েছে। স্বতন্ত্র সব স্বর মিলেই গোটা দেশের চলচ্চিত্রকে উত্তীর্ণ করতে পারে। যুগ বদলালে স্বরও বদলাবে এবং সেটাই কাম্য। অথচ আমাদের এখানে যুগ-অনুযায়ী স্বরগুলিকে প্রাধান্য দেওয়া হয় না। কোনও এক কালে এক মহীরুহ বাংলার গ্রাম্য জীবনের চিত্রায়ন করেছিলেন! সেই অভিভূত হয়ে যাওয়া প্রজন্মের দাগ এখনও আমাদের মননে লেগে। সেখান থেকে খুব বেশি দূর এগোনো হয়নি। ব্যাপারটা ভয়ের, আতঙ্কের।