পুরুষদের সমান বেতন! ভারতে মহিলাদের ক্রিকেট কতটা অক্সিজেন পাবে

Women's cricket: পুরুষ এবং মহিলা ক্রিকেটাররা এবার থেকে একই পরিমাণ টাকা পাবেন প্রতি ম্যাচে।

ভারতীয় ক্রিকেটে এবার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। পুরুষ এবং মহিলা ক্রিকেটাররা এবার থেকে একই পরিমাণ টাকা পাবেন প্রতি ম্যাচে। ২৭ অক্টোবর বিসিসিআই সচিব জয় শাহ ট‍্যুইট করে এই ঘোষণা করার পরেই খুশির হাওয়া মহিলা ক্রিকেট শিবিরে। বোর্ডে রদবদল হওয়ার পর এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সকলকে রীতিমতো চমকে দিলেন বোর্ড-কর্তারা। পাশাপাশি, ভারতের পথে হেঁটে ইংল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ডও তাদের মহিলা ক্রিকেটারদের বেতন পুরুষ ক্রিকেটারদের সমান করার ঘোষণা করেছেন।

২৭ তারিখ সকালে জয় শাহ ট‍্যুইট করে বলেন, "বৈষম্য দূর করতে আজ প্রথম পদক্ষেপ নিল বিসিসিআই। যে সমস্ত মহিলা ক্রিকেটাররা বোর্ডের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ, আমরা তাঁদের সমান বেতন দিতে চলেছি। পাশাপাশি মহিলা এবং পুরুষ ক্রিকেটারদের এবার থেকে সমপরিমাণ ম্যাচ ফি দেওয়া হবে। আমরা ক্রিকেটে লিঙ্গ সাম্যের একটা যুগ তৈরি করতে চাই।" কিন্তু ভারতের মতো দেশ, যেখানে ক্রিকেটকে সবচেয়ে বড় খেলা হিসেবে গণ্য করা হয়, সেখানে কি শুধুমাত্র ম্যাচ ফি বাড়িয়ে দিয়ে মহিলা ক্রিকেটের উন্নতিসাধন সম্ভব?

'সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল' বললেও, ভারতে গড অফ গেমস কিন্তু সেই ক্রিকেটই। মিডিয়া, এজেন্সি, স্পনসর, ফ্যান, সবদিক থেকেই ভারতীয় ক্রিকেট সব থেকে উন্নত। তবে, এই সবকিছুই কিন্তু ভারতীয় পুরুষ ক্রিকেটের জন্য। মহিলা ক্রিকেট এখনও পর্যন্ত সেই জায়গায় পৌঁছতে পারেনি ভারতে। মহিলা ক্রিকেটের প্রতি এখনও ভারতে কিছুটা অনীহা কাজ করে। সেই কারণেই হয়তো ফেসিলিটি, সঠিক প্রোমোশন স্ট্র্যাটেজি, সব দিক থেকেই মহিলা ক্রিকেট এখনো পর্যন্ত অনেকটাই পিছিয়ে। ক্রিকেট ময়দানে বিভিন্ন জায়গায় এখনও বঞ্চনার শিকার হতে হয় ভারতীয় মহিলা দলকে, কিন্তু কেন মহিলা ক্রিকেটের প্রতি ভারতের এত অনীহা?

আরও পড়ুন: ক্রিকেট-দুনিয়ায় আজও বিতর্কিত ‘মানকরিং’ আউট! কোন ইতিহাস রয়েছে আড়ালে

মানসিকতা
প্রত্যেক ক্রিকেটারের স্বপ্ন কী? বিশ্বের ময়দানে তাদের দেশের প্রতিনিধিত্ব করা এবং বিশ্বের সবথেকে জনপ্রিয় মাঠে একটা বিশাল জনতার সামনে ভালো পারফরম্যান্স করা। কিন্তু, মুখে বললেই তো আর কাজটা হয়ে যায় না। ২০১৭ এবং ২০২০ বিশ্বকাপে লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ড এবং মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে ফাইনাল খেলার সুযোগ পেয়েছিল ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দল। তবে, খেলার ফলাফল ভারতের দিকে যায়নি। যদি ভারতীয় ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড বিসিসিআই মহিলা ক্রিকেট নিয়ে আরও সচেতন হতো, তাহলে হয়তো ফলাফল ভারতের দিকে গেলেও যেতে পারত।

শুধুমাত্র, ভারতের পিচে খেলে হঠাৎ বড় মাঠে ভালো প্রদর্শন করা যায় না। এই বিষয়টা সকলকেই একটু হলেও বুঝতে হবে। যদি বিসিসিআই এই বিষয়টি সহজভাবে না গ্রহণ করতে পারে, তাহলে ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের বিদেশ ভীতি কোনও দিনই কাটবে না। তাই মহিলা ক্রিকেটের উন্নতির জন্য বিসিসিআইকে অবশ্যই বিভিন্ন ফরম্যাটের উপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

সম্পদের অভাব
বিশ্বের মঞ্চে ক্রিকেট খেলা মানে কিন্তু ব্যাপারটা শুধুমাত্র ক্রিকেটারের মধ্যে সীমিত থাকে না। এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে ক্রিকেট বোর্ড, বিভিন্ন বিনিয়োগকারীর ভাগ্য এবং আরও অনেক কিছু। বিনিয়োগকারীরা এমন খেলোয়াড়দের ওপরেই এই বিনিয়োগ করেন, যাদের ক্ষেত্রে তা লাভজনক হবে বলে তাঁরা মনে করেন। এবং সেই কারণেই ভারতীয় পুরুষ ক্রিকেট দলের বিনিয়োগকারী সংখ্যা অনেক বেশি। তুলনায় মহিলা ক্রিকেট দলে বিনিয়োগ করতে বলা হলে অধিকাংশ বিনিয়োগকারী হাত তুলে নেন। সামনে আনেন একাধিক অজুহাত, যেগুলির মধ্যে সবথেকে বেশি ব্যবহৃত অজুহাতটি হলো, মহিলারা পুরুষদের মতো অত ভালো ক্রিকেট খেলতে পারেন না। বিশ্বজুড়ে নারী ক্রিকেটের অনুরাগীর সংখ্যা অনেক কম। সেই কারণেই বিনিয়োগকারীরা খেলোয়াড় এবং টুর্নামেন্টে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করা থেকে বিরত থাকেন। ফলে তহবিলের অভাবের কারণে খেলোয়াড়রাও খুব একটা আগ্রহী থাকেন না।

মহিলাদের নির্দিষ্ট সরঞ্জামের অভাব
চাহিদা কম থাকার কারণে যে কোনও দোকানে নারী ক্রিকেটের সরঞ্জাম পাওয়া অত্যন্ত কঠিন। এটি নারী ক্রিকেটারদের নিরুৎসাহ করে তোলে। মহিলা ক্রিকেটারদের অপেক্ষাকৃত হালকা ওজনের ক্রিকেট ব্যাট ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু সাধারণ খেলার দোকানে যে-সমস্ত ক্রিকেট ব্যাট পাওয়া যায় সেগুলি মূলত পুরুষদের জন্য তৈরি। পুরুষ ক্রিকেটের নিম্ন ক্রমাঙ্কের ব্যাটগুলিকেই মহিলা ক্রিকেটের জন্য ব্যবহার করা হয়। কিন্তু সেটা ঠিক নয় কোনও ভাবেই। মহিলা ক্রিকেটের জন্য বিশেষ কাস্টম-মেড ইংলিশ উইলো কাঠের ব্যাট প্রয়োজন। তাঁদের জন্য বিশেষভাবে এই ব্যাট তৈরি করতে হয়। ভারতের খুব একটা বেশি দোকানে এই ধরনের ব্যাট পাওয়া যায় না। আর পাওয়া গেলেও এই ব্যাটের দাম সাধারণ পুরুষদের ব্যাটের থেকে অনেক বেশি। ভালো ক্রিকেট খেলতে গেলে এবং ক্রিকেটে ভবিষ্যৎ তৈরি করতে গেলে প্রিমিয়াম মানের ক্রিকেট কিট প্রয়োজন। তাই, উন্নত ক্রিকেট কিটের অপ্রতুলতার কারণে অনেক মহিলাই ক্রিকেট থেকে পিছিয়ে আসেন।

উদ্যোগের অভাব
ভারতীয়রা মনে করেন, নারী ক্রিকেটের ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়ার থেকে বড় দল এই মুহূর্তে বিশ্বে আর কোনওটিই নয়। ওমেন্স বিগ ব্যাশ লিগের সময়েও এই বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে। ওমেন্স বিগ ব্যাশ লিগের দ্বিতীয় সিজনের খেলা চলাকালীন সময়ে পুরুষ ক্রিকেটের শিডিউল ঘোষণা করেছিল অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট বোর্ড। ফলে, সিডনি থান্ডার্স এবং মেলবোর্ন রেনিগেডসের ম্যাচে দশকের সংখ্যা পৌঁছেছিল ৬ লক্ষ-তে। আর সেই ম্যাচে হতাশাজনক পারফরম্যান্স করে দু'টি দলই। এখান থেকেই বোঝা যায়, নারী ক্রিকেট কেন এতটা উন্নতির মুখ দেখতে পায় না।

নারী ক্রিকেটে সাধারণত এত বেশি টুর্নামেন্ট হয় না। তাই এত বড় জনতার সামনে খেলতে গিয়ে প্রত্যেক ক্রিকেটার কিছুটা ভীত হয়ে পড়েন। পারফরম্যান্স কীভাবে ঠিক হবে, সেই চিন্তা করতে গিয়ে অনেকেই সেই মুহূর্তে নিজের স্বাভাবিক খেলা ভুলে যান এবং ভুল করে বসেন। ২০১৭ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপের ফাইনালেও এরকমই একটি ঘটনা ঘটেছিল। সেই সময় তৎকালীন ভারত অধিনায়ক মিতালী রাজ বলেছিলেন, "ম্যাচটা ছিল ফাইনাল ম্যাচ, আর অনুষ্ঠিত হয়েছিল লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ডে। এত বড় সংখ্যক জনতার সামনে খেলতে গিয়ে আমরা সবাই ভীত হয়ে পড়েছিলাম। আমরা সকলেই নিজের স্বাভাবিক খেলা ভুলে যাই সেই বিশেষ মুহূর্তে। হয়তো সেই কারণেই ওই ম্যাচে আমরা নিজেদের সেরাটা দিতে পারিনি।"

এই বিষয়টির দিকে বিসিসিআইয়ের নজর দেওয়া উচিত। যদি আরও বেশি দ্বিপাক্ষিক ম্যাচ আয়োজন করা যায়, আরও বেশি মহিলা ক্রিকেটের দিকে নজর দেওয়া যায়, তাহলে ভারতের মহিলা ক্রিকেট পাল্টাবে। তবে তার পাশাপাশি, ভারতের সাধারণ মানুষেরও কিন্তু যোগদান প্রয়োজন। যদি ভারতের দর্শক ভারতের মেয়েদের পাশে না থাকে, তাহলে চেষ্টা করেও বিসিসিআই পরিস্থিতি পরিবর্তন করতে পারবে না।

লিঙ্গবৈষম্য দূর করতে কী করা যেতে পারে

সচেতনতা বৃদ্ধি
আজকের দিনে বারবার প্রমাণিত হয়েছে, মহিলারা কিন্তু পুরুষদের থেকে কম নন। কর্পোরেট জগৎ হোক কিংবা ক্রিকেট বা ফুটবলের ময়দান সব ক্ষেত্রেই মহিলারা পুরুষদের টেক্কা দিচ্ছেন। হরমনপ্রীত কৌর, স্মৃতি মান্ধানাদের খেলা বারবার প্রমাণ করেছে, ভারতের মহিলা ক্রিকেট দলও কারওর থেকে কম না। বিশ্বের ময়দানে ভারতের এই খেলোয়াড়দের ভালো খেলা অত্যন্ত প্রয়োজন। না হলে ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটের প্রতি সচেতনতা বাড়বে না।

সম্প্রসারণ
ভারতের সবথেকে জনপ্রিয় স্পোর্টস মিডিয়া চ্যানেলগুলি মহিলা ক্রিকেট সম্প্রসারণ করতে ততটা ইচ্ছুক থাকে না কখনওই। শুধু কিছু কিছু ওটিটি প্ল‍্যাটফর্মে এই ম্যাচ দেখা গেলেও, অনেকেই এমন থাকেন, যাঁরা এই ধরনের প্ল‍্যাটফর্মের সাবস্ক্রিপশন গ্রহণ করেন নি। ফলে তাঁরা সেই ম্যাচ দেখতে পারেন না। এই বিষয়টা পরিবর্তন হওয়া দরকার। ‌যদি কোনও ম্যাচ সম্প্রসারণ না হয়, তাহলে ভারতীয় দর্শক সেই ম্যাচ দেখবেন কী করে। তাই ভারতীয় স্পোর্টস চ্যানেলগুলিকেও মহিলাদের ম্যাচ সম্প্রসারণ করা উচিত।

বিসিসিআই-এর ভূমিকা
ভারতের ক্রিকেটের সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে বিসিসিআই-এর একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। শুধুমাত্র মহিলাদের ম্যাচ ফি পুরুষদের সঙ্গে সমান করে দিয়ে তাঁরা হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারেন না। যদি মহিলা ক্রিকেটের জনপ্রিয়তাই না বৃদ্ধি হয়, তাহলে আর অতিরিক্ত ম্যাচ ফি দিয়ে লাভ কি। তাই বিসিসিআই-এর উচিত, আরও বেশি দ্বিপাক্ষিক ম্যাচ আয়োজন করা। ভারতীয় ময়দানের পাশাপাশি বিদেশের মাটিতেও যাতে ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দল ভালো পারফরম্যান্স করতে পারে, সেই দায়িত্বও বিসিসিআই-কে নিতে হবে। সব ধরনের ম্যাচ টিভিতে সম্প্রচার করার জন্য মিডিয়া চ্যানেলগুলিকে জোর দিতে হবে বিসিসিআই-কে।

তার পাশাপাশি টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে যাতে ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দল ভালো করতে পারে, তার জন্য মহিলা আইপিএলের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করতে হবে। এতে একদিকে যেমন ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দল টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে, তেমনই ভারতে মহিলা ক্রিকেটের দর্শক বাড়বে।

সরকারের ভূমিকা
ভারতের মহিলা ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে সরকারেরও একটা ভূমিকা আছে। রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকার মহিলা ক্রিকেটের জনপ্রিয়তাকে বৃদ্ধি করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। রাজ্য ক্রিকেট বোর্ডগুলি মহিলা ক্রিকেটারদের জন্য আলাদা ট্রেনিং ক্যাম্প করতে পারে। যথাযথ পরিকাঠামো প্রদান এবং সারা দেশে উন্নত প্রশিক্ষণ শিবিরের ব্যবস্থা করে সেরা প্রতিভাদের চয়ন করতে পারে বিভিন্ন সরকার। এতে যেমন মহিলা ক্রিকেটের উন্নতি হবে, ‌ তেমনই অনেক মহিলাই ক্রিকেট খেলার প্রতি আকৃষ্ট হবেন।

More Articles