'ফেক নিউজ' তাড়া করেছিল স্বয়ং বিদ্যাসাগরকেও! যে গুজবে তোলপাড় হয়েছিল পুরনো কলকাতা

Vidyasagar: মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে শুধুমাত্র এমন পুরুষরাই ফিরবেন যাদের বিয়ে হয়েছিল।

বিস্কুট তৈরির উপকরণ কী কী? আটা, ময়দা এবং সাহেবদের সিগনি মিশিয়ে সেই মিশ্রণ মুসলিমরা পা দিয়ে মেখে তৈরি করে বিস্কুট! তাই বিস্কুট খেলেই হিন্দুদের 'জাত' যাবে। এসব কথা শুনে এখন গা ঘিনঘিন করতে পারে, কারও আবার তীব্র হাসি পেতে পারে। কিন্তু যেটা সবাই একবাক্যে বলবে, তা হলো, এসব মিথ্যা কথা। বাস্তবে বিস্কুটের উপকরণ এবং প্রস্তুত প্রণালী আলাদা। হাস্যকর হোক অথবা শুনতে যতই আজগুবি লাগুক না কেন, এমন একটা সময় ছিল যখন বাংলার বহু মানুষ এই কথা বিশ্বাস করত।

সোশ্যাল মিডিয়ার বাড়বাড়ন্তের সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ভুয়ো তথ্যের রমরমা। মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে 'ফেক নিউজ' শব্দবন্ধ। হালফিলে নয় স্রেফ, ইংরেজ শাসনামলেও ভুয়ো খবর এবং তথ্যের বেশ রমরমা ছিল। একটি ভুয়ো খবরের ফলে সৃষ্টি হওয়া পরিস্থিতি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকেও বিচলিত করেছিল। তার বহু উদাহরণ বিভিন্ন নথি থেকেও পাওয়া যায়। এই ক্ষেত্রে হয়তো শুধু বাঙালিকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। বহু জাতির মানুষই কোনও নতুন তথ্য অথবা খবর জানতে পারলে সেই বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়ে সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার আগেই অন্যদের সেই খবর জানানোর কথা বেশি প্রয়োজনীয় বলে মনে করে। সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে সেই প্রবণতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।

আরও পড়ুন- নীলদর্পণের সঙ্গে জড়িয়ে কলকাতার রাস্তা! জেমস লং সরণির নামকরণ হয়েছিল কার নামে?

যেকোনও তথ্য অথবা খবর যদি পরিবেশনের জন্য উপযুক্ত মুচমুচে বলে মনে হয় তাহলে কিছু অংশের মানুষ দ্রুত সেই খবর অন্যদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করে। আর সমাজের প্রচলিত ধ্যান ধারণার বিরুদ্ধে করা কোনও কাজের বিরুদ্ধে যদি কোনও তথ্য অথবা খবর প্রচলিত হয় তাহলে তো পোয়া বারো! দাবানলের মতো সেই খবর ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মধ্যে এবং সত্যতা যাচাই করার আগেই মানুষ নিজের মতামত জানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কোনও খবর অথবা তথ্য যাচাই না করে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার ফলাফল কী হতে পারে তা টের পেয়েছিল পুরনো কলকাতাও। তার মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো মৃত মানুষের ফিরে আসার ঘটনা।

বহু মানুষের ওজর আপত্তি সত্ত্বেও তখন কিছুদিন আগেই বিধবা বিবাহ আইন পাশ হয়েছে। নানারকম বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে হাতে গোনা হলেও কয়েকটি বিধবা বিবাহ আয়োজিত হয়েছে। এমন সময় নদিয়ার রামশর্মা আচার্য ঘোষণা করলেন, বাংলা বছরের আগামী ১৫ কার্তিক কিছু মৃত ব্যক্তি সশরীরে তাদের বাড়িতে ফিরে আসবেন। এ যেন ঠিক ভাওয়াল সন্ন্যাসীর গল্প। যদিও ভাওয়াল সন্ন্যাসীর ক্ষেত্রে জমিদারের মৃত্যু আসলেই হয়েছিল কিনা সেই ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে। তাছাড়া দু'টি ঘটনা আলাদা দুই শতাব্দীতে ঘটেছিল। নদিয়ার আচার্য মহাশয় আরও জানালেন, গণনা করে এই তারিখ তিনি জানতে পেরেছেন। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে শুধুমাত্র এমন পুরুষরাই ফিরবেন যাদের বিয়ে হয়েছিল। অন্য কোনও মৃত মানুষের ফিরে আসার ব্যাপারে আচার্য মহাশয় কিছু জানালেন না।

নদিয়া থেকে কলকাতা এবং অন্যান্য এলাকার দূরত্ব একপ্রকার ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে এই খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। এই খবর শুনে বহু পরিবারের সদস্যরা আশায় বুক বাঁধল। স্বজন হারানোর শোক থেকে মুক্তি পেতে মানুষ অনেকক্ষেত্রেই বিচার বিবেচনা করার অবকাশও খুঁজে পায় না। যেসব বিধবাদের বিয়ে হয়েছিল তারা এবং তাদের পরিবার চিন্তায় পড়লেন। যদি মৃত স্বামী ফিরে আসে তাহলে সেই বিধবা (যে সদ্য বিবাহিত) কী করবেন? একইসঙ্গে যুক্তি তর্ককে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে শুরু হলো বিভিন্ন ধরনের মশকরা। সেই মশকরার লক্ষ্য হলো নতুন বিবাহ করা বিধবা, তাদের পরিবার, বিধবা বিবাহের কর্মকাণ্ডে জড়িত মানুষ এবং সর্বোপরি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর!

আরও পড়ুন- দক্ষিণ কলকাতার ব্যস্ততম রাস্তা! হরিশ মুখার্জি রোডের নেপথ্যের মানুষকে চিনলই না বাঙালি

সমাজের প্রচলিত রীতিনীতির বিরুদ্ধে কাজ করার কারণে তাদের নিয়ে ব্যঙ্গ করতে তাদের স্বজাতিরাই মেতে উঠল। কিন্তু দিন এগিয়ে এল, নির্ধারিত দিনে কোনও মৃত ব্যক্তিই ফিরে এল না। যে কয়েকটা বাড়িতে কেউ ফিরেছে বলে শোরগোল উঠল পরে প্রকাশ পেল যে মৃত ব্যক্তির বদলে কিছু ভেকধারী প্রবঞ্চক সেই বাড়িতে এসেছিল। তারিখ পেরিয়ে যাওয়ার পরে বেশিরভাগ মানুষের এই প্রসঙ্গে কোনও উৎসাহ ছিল না কিন্তু যে স্বজনহারা পরিবাররা আশায় বসে রইল, যে সকল বিধবাদের বিধানের দোহাই দিয়ে ব্যঙ্গ শুনতে হলো, সর্বোপরি যারা বিধবাদের দুর্দশা দূর করার সংকল্প গ্রহণ করেছিলেন কেউ তাদের কাছে ক্ষমা চেয়েছিল বলে জানা যায়নি।

এই ঘটনা পড়ে কিছু ক্ষেত্রে অবাক হতেই হয় এই ভেবে যে, প্রায় দুই শতাব্দী পার করেও মানুষ আজও কত সহজেই ভুয়ো খবরের জালে জড়িয়ে পড়ে। আজও কোনও খবর মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার আগে খুব কম মানুষই ফলাফল সম্পর্কে চিন্তা করে। বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ বানচাল করতে ছড়িয়ে দেওয়া গুজব হোক বা একালের হোয়াটসঅ্যাপ তথ্যভাণ্ডার, ফেক নিউজ বহাল তবিয়তে ছিল, থাকবেও।

 


তথ্য ঋণ : হুতোম প্যাঁচার নক্সা - কালীপ্রসন্ন সিংহ, সেই সময় - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

More Articles