ফাতিমা সানা: পুরুষতান্ত্রিক পাকিস্তানে মহিলা ক্রিকেট বিপ্লবী
Fatima Sana: আশেপাশের লোকজন অবাক হয়ে দেখত, আবার কেউ ঠাট্টা করত, মেয়ে মানুষ হয়ে ক্রিকেট? সীমিত সুযোগ আর পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বাধা পেরিয়ে, বাবা-মায়ের ছত্রছায়ায় নিজের এক আলাদা আকাশ বানিয়েছেন তিনি।
সূর্যের দাপটে উত্তপ্ত কলম্বোর আকাশ। মাঠে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে বেড়াচ্ছে পোকা। এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল খেলা। কেউ ব্যাট নামিয়ে চোখ ঢাকছে, কেউ রুমাল দিয়ে পোকা তাড়াচ্ছে। আর সেই বিশৃঙ্খলার মধ্যে শান্তভাবে এগিয়ে এলেন এক তরুণী। হাতে স্প্রে, চোখে অনাড়ম্বর শান্তি— ফাতিমা সানা, পাকিস্তান মহিলা ক্রিকেট দলের অধিনায়ক।
করাচির নাজিমাবাদের এক চিলতে গলি। সেই গলির মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছোট্ট ফাতিমা— হাতের ব্যাটটা যেন তাঁর জীবনের একমাত্র অস্ত্র। আশেপাশের লোকজন অবাক হয়ে দেখত, আবার কেউ ঠাট্টা করত, মেয়ে মানুষ হয়ে ক্রিকেট? সীমিত সুযোগ আর পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বাধা পেরিয়ে, বাবা-মায়ের ছত্রছায়ায় নিজের এক আলাদা আকাশ বানিয়েছেন তিনি। বড় ভাই শেখরোজ সানা-উল-হক, তাঁর বোনের প্রতিভা বুঝেছিলেন। তাঁর দাদাই তাঁকে অ্যাকাডেমিতে ভর্তি করেন। বয়স সবে তখন এগারো বছর, ক্লাব লেভেলের খেলায় অংশ নিয়ে প্রথম বলেই নজর কেড়েছিল ছোট্ট ফাতিমা। সে জানত, ক্রিকেট শুধু একটা খেলা নয়, জীবনদর্শন। প্রতিটি ওভারের শেষে তাঁর হাসি যেন বলে,‘‘আমি থামিনি, হার স্বীকার আমার অভিধানে নেই।’’ চারপাশের কেউ তখন বিশ্বাস করেননি, এই মেয়ে একদিন পাকিস্তানের মহিলা ক্রিকেট দলের অধিনায়ক হয়ে উঠবেন। বয়স মাত্র ২৩ বছর, অভিজ্ঞতা যেন পুরনো সৈনিকের মতো। বল হাতে তাঁর নিখুঁত সুইং, ব্যাট হাতে আত্মবিশ্বাসী ছোঁয়া সবটা নিয়ে অদম্য ইচ্ছাশক্তি। বিশ্বকাপের আগে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, সামনে অনেক পথ কিন্তু তাঁরা ভয়ের নয়, স্বপ্নের দলে।
২০১৯ সালে পাকিস্তান জাতীয় দলে ডাক এল। মাত্র ১৭ বছর বয়সে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে অভিষেক। মাঠে প্রথম বল ফেলতেই যেন সময় থেমে গিয়েছিল, যে মেয়ে করাচির রাস্তায় খেলে বড় হয়েছে, এখন সে দেশের জার্সি গায়ে! তারপর আর থেমে থাকা নয়। একে একে টি-২০, ওয়ানডে, আর ২০২১ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে প্রথমবার পাঁচ উইকেটের কীর্তি। সেই বছরই আইসিসির “বর্ষের উদীয়মান খেলোয়াড়” পুরস্কার জিতে নিল সেই ছোট্ট মেয়েটি। ২০২৩, তাঁর অধিনায়কত্বে প্রথমবারের মতো সুপার ওভারে জয় পাকিস্তানের। কিন্তু তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় লড়াইটা খেলাধুলায় নয়, ছিল জীবনের সঙ্গে।
আরও পড়ুন- চাকদহ থেকে মহিলা ক্রিকেট দলের অধিনায়ক, ঝুলন গোস্বামী অনুপ্রেরণার অন্য নাম
২০২৪ সাল বিশ্বকাপের ঠিক আগে, বাবাকে হারালেন, খেলার মঞ্চ থেকে দেশে ফিরে আসা, আর সেখানেই ক্রিকেট জীবনের এক মোড়। ফাতিমার মা জানান, তাঁর বাবা হাসপাতালে। ডাক্তারকেও একটাই কথা বলতেন তাঁর মেয়ে দেশের জন্য খেলে। ফাতিমা অনুভব করতেন, এর পর অনেকেই বিশ্বাস করেছিল তিনি খেলতে পারবেন না, কিন্তু পরিবারের বিশেষ করে মায়ের বোঝানো এবং বাবার স্মৃতি তাঁকে ফিরিয়ে এনেছিল মাঠে। ফিরতি ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে প্রথম খেলাটিই ছিল অন্যরকম। ফাতিমা এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন— জাতীয় সংগীত চলার সময় তিনি জানতেন যে তাঁর বাবা খেলা দেখছে না। এই প্রথমবার ফাতিমার খেলা দেখেননি তাঁর বাবা। এই পরিস্থিতির পর তাঁর মনোবল ডিভাইনকে হতবাক করে। এই সময় হোয়াইট ফার্নেসের অধিনায়ক সোফি ডিভাইন বলেছিলেন, "মহিলাদের খেলার ভবিষ্যৎ ফাতিমা"। এই বিশ্বকাপেই ফাতিমার হাত ধরে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ৩০ রান এবং ২ উইকেট নিয়ে জয় পেল পাকিস্তান।
১৭ বছর বয়সে পাকিস্তানের জাতীয় দলে ডাক এল। দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে অভিষেক, তারপর টি-২০, ওয়ানডে, এবং ২০২১ সালে পাঁচ উইকেটের কীর্তি। আইসিসির “বর্ষের উদীয়মান খেলোয়াড়” পুরস্কার। ২০২৩ সালের অধিনায়কত্বে প্রথম সুপার ওভারের জয়। তবে তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় লড়াই খেলার মাঠের বাইরে।
যেখানে পাকিস্তানের মহিলা ক্রিকেট এখনও উন্নয়নের প্রাথমিক স্তরে, পর্যাপ্ত কোচ নেই, টুর্নামেন্টের সুযোগ সীমিত, আর পারিশ্রমিক নগণ্য। অভ্যন্তরীণ কাঠামোতেও রয়েছে ঘাটতি। বহু বিশ্লেষক বলেছেন, অধিনায়ক যতই সাহসী হোক, প্রশাসনের পূর্ণ সমর্থন আর কাঠামো ব্যবস্থা না থাকলে লড়াইটা হয়ে ওঠে একার। খেলার মাঠে নামার আগে দলের যাতায়াত, প্র্যাকটিস ভেনু, এমনকি খাবার ব্যবস্থা সমস্যা সবটাই দেখতে হয় ফাতিমাকে। এক সাক্ষাৎকারে ফাতিমা বলেছিলেন— শুধু মাঠে নয়, লড়াইটা শুরু হয় প্রশাসনের ভিতর থেকেই। তাঁর কথাতে ছিল দৃঢ়তার সুর। সবটা নিয়ে জয়ই যেন প্রশাসনিক ব্যর্থতার মুখে তাঁর এক প্রতিবাদ।
বিশ্বকাপের আগেই পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের সমস্যা, ব্যবস্থাপনায় গাফিলতি প্রকাশ্যে এসেছে। তবু ফাতিমার চোখে আগুন। ক্রীড়া মহলের এক বিশ্লেষকের মন্তব্য, “যে মেয়ে প্রশাসনের অন্ধকারে থেকেও দলকে এগিয়ে নিয়ে যায়, তাঁর নেতৃত্বই পাকিস্তানের আসল আলো।” আসলেই, ফাতিমার গল্প শুধু একজন ক্রিকেটারের নয়, বরং এক ক্ষীণ ব্যবস্থার ভিতর থেকে আলো জ্বালানোর, এক সাহসের গল্প। এক প্রজন্মের মেয়েদের সাহসের নামই হয়তো 'ফাতিমা'।
Whatsapp
