কাল্পনিক নাকি বাস্তব, পার্লে-জি বিস্কুটের প্যাকেটের ওই বাচ্চা মেয়েটি আসলে কে?

Parle-G biscuits : আট দশকেও বদল হয়নি বিস্কুটের প্যাকেটের ওপরে থাকা বাচ্চা মেয়েটির ছবি, কিন্তু কী আসল রহস্য?

প্যাকেটের দাম মাত্র তিন টাকা, তাতেই গুনে গুনে সাতটা বিস্কুট, আজও গরিবের বন্ধু পার্লে-জি। আধুনিক কোকো, কুকিজের ভিড়ে হলদে রঙের প্যাকেটের ঐতিহ্য আজও অটুট। এদেশে প্রথম পার্লে কোম্পানির পথ চলা শুরু হয় আজ থেকে প্রায় আট দশকেরও বেশি সময় আগে। পরাধীন ভারতবর্ষের স্মৃতি আজও লেগে রয়েছে প্যাকেটের গায়ে। শুধু স্মৃতিই নয়, লেগে রয়েছে নস্টালজিয়াও। চায়ের সঙ্গে দুটো পার্লে-জি বিস্কুটের মতো এমন সঙ্গত আর কেই বা করতে পারে! 

কিছুদিন আগে নিজেদের টুইটার হ্যান্ডেলে সংস্থা জানিয়েছে, ২০২০ সালের মার্চ, এপ্রিল এবং মে, এই তিন মাসে গত আট দশকের মধ্যে সর্বাধিক বিক্রি হয়েছে পার্লে জি-র। একদিকে লকডাউনের ক্লান্তি, অন্যদিকে ঘরবন্দি জীবনের একঘেয়েমি কাটাতে সবার সঙ্গী ছিল এক এবং একমাত্র পার্লে জি-ই। শুধু ভারতই নয়, সারা বিশ্বেই ব্যাপক মাত্রায় এর জনপ্রিয়তা। এই বিষয়ে আরও একটি সমীক্ষা বলছে, পার্লে জি বিশ্বের সর্বাধিক বিক্রিত বিস্কুট। এবং বিক্রির ক্ষেত্রে এই বিস্কুটের পরিসর বয়স-স্থান-কাল-পাত্রের মধ্যে আবদ্ধ নয়। এর আবেদন সর্বজনীন।

আরও পড়ুন - দুই বিশ্বযুদ্ধ থেকে করোনা মহামারি, দেড়শ বছর পেরিয়ে এসেও জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ‘হরলিক্স’
 

সময়টা, ১৯২৯ সাল। ভারতের বাজারে প্রথম পথ চলা শুরু করল পার্লে জি। এই সময়, ভারতে বহাল ইংরেজ শাসনকাল। তাই সে সময় ব্রিটেন থেকে আমদানি করা হতো ক্যান্ডি এবং বিস্কুট। ভারতীয় বাজারে সেগুলি বিক্রি হত চড়া দামে, যা সাধারণ ভারতবাসীর কাছে ছিল সাধ্যের অতীত। তাই ১৯২৯ সালে ভারতের সাধারণ মানুষের জন্য প্রথম দেশীয় বিস্কুট নিয়ে আসেন পার্লে কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা মোহনলাল দয়াল। যদিও বিস্কুটের ব্যবসায় তাঁর এর আগে বিশেষ অভিজ্ঞতা ছিল না, তিনি ছিলেন মূলত রেশম ব্যবসায়ী। এই সময় বিদেশি পণ্যের পরিবর্তে দেশীয় পণ্য ব্যবহার করার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছিল, জানা যায়, মোহনলাল দয়ালও এর ব্যতিক্রম নন। তিনিও স্বদেশি চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েই বেকারির ব্যবসা শুরু করেন। জার্মানি থেকে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ শেষে সেই সময় ৬০ হাজার টাকা খরচ করে ক্যান্ডি মেশিন কিনে দেশে ফেরেন মোহনলাল।মুম্বইয়ের ইরলা ও পারলা নামে দুই গ্রামের মাঝে একটি পুরনো কারখানা কিনে ১২ জন পরিবারের সদস্য নিয়ে শুরু করেন ব্যবসা। মজার বিষয় হল, এই জায়গার নাম খানিক বদলেই কোম্পানির নাম রাখা হয় পার্লে। ভারতের মাটিতে এই কোম্পানির প্রথম পথ চলা শুরু হয় অরেঞ্জ ক্যান্ডি দিয়ে। যদিও সময়ের সঙ্গে চৌকো গমের বিস্কুটই ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।

বয়স বুড়িয়েছে ঠিকই তবে বদল হয়নি এই বিস্কুটের স্বাদের। এমনকী আশি বছর আগেকার সেই প্যাকেজিংও একই রকম রয়ে গিয়েছে। সাদা, হলুদ ডোরা কাটা প্যাকেটের ওপর লাল সাদা হরফে ইংরেজিতে লেখা বিস্কুটের নাম আর সেই সঙ্গে জনপ্রিয় একটি মিষ্টি বাচ্চা মেয়ের মুখ। তার ভিতরে থরে-থরে সাজানো বিস্কুট। চা, দুধ, এমনকী, জলে ডুবিয়েও সেই বিস্কুট খাওয়া যায়। স্বাদ একইরকম অতুলনীয়। কিন্তু জানেন কি এই এত বছর ধরে বাজার ধরে রাখা বিস্কুটের প্যাকেটের ওপর ওই যে মেয়েটির ছবি, সে আসলে কে?

মেয়েটিকে নিয়ে আজও রয়েছে ধোঁয়াশা। মাঝে ফেসবুকে একটু পোস্ট খুবই ভাইরাল হয়েছিল। সেখানে একদিকে ছিল পার্লে জি বিস্কুটের সেই মেয়েটির ছবি, আর তার ঠিক পাশেই ছিল জনপ্রিয় লেখিকা তথা সমাজসেবী সুধা মুরথির ছবি। ওই পোস্টটিতেই দাবি করা হয় যে, বিস্কুটের প্যাকেটের ওপর থাকা ওই বাচ্চা মেয়েটি আসলে আজকের সত্তোর্রদ্ধা সুধা মুরথি। শুধু তাই নয়, এও বলা হয় যে প্রথম ছবিটি যখন তোলা হয়, যখন তার বয়স ছিল ৪ বছর ৩ মাস। যদিও এ বিষয়ের সত্যতা নিয়ে যথেষ্ট দ্বিমত রয়েছে।

আরও পড়ুন - রান্নাঘরে যাত্রা শুরু, আজ ঠাঁই লাখো দেশবাসীর হৃদয়ে, ভিকো-র লড়াইটাকে স্যালুট

ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই বিভ্রান্তি ছড়ায়। সেই মতো শুরু হয় অনুসন্ধানও। এই বিস্কুটের নিজস্ব একটি ফেসবুক পোস্ট খুঁজে পাওয়া যায়। ২০১৬ সালের করা ওই পোস্টে পার্লে জির তরফ থেকে মেয়েটির ছবি নিয়ে বিভ্রান্তি দূর করার উদ্দেশ্যে ইন্ডিয়া টাইমস ওয়েবসাইটের একটি প্রতিবেদনের লিংক পোস্ট করা হয়। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী,  মেয়েটাকে নিয়ে যা কিছু রটনা তার সবটাই গুজব। অন্যদিকে, পার্লে জি গ্রুপের প্রোডাক্ট ম্যানেজার মায়াঙ্ক শাহ একটি সাক্ষাৎকারে এই প্রশ্নের উত্তরে জানান, এই বিস্কুটের প্যাকেটের ওপর থাকা বাচ্চা মেয়েটির ছবির সঙ্গে বাস্তবের কোনও যোগাযোগ নেই। মুখটি সম্পূর্ণরূপেই কাল্পনিক। এটি ১৯৬০ সালে এভারেস্ট ক্রিয়েটিভ কোম্পানির সৃষ্টি, বাস্তবে কোনও সত্যিকারের মেয়ের ছবি মোটেই নয় সেটি। ফলে কোম্পানির পক্ষ থেকে এই বার্তাকে এক প্রকার সঠিক ধরে নেওয়াই যায়। 

আসলে বিস্কুটের জনপ্রিয়তা এতটাই বেশি যে তা নিতে কৌতূহল মাথাচাড়া দেবে সেটাও স্বাভাবিক। তার ওপর চারপাশের এই বদলে যাওয়া সময়ের ধাক্কায় যে জিনিসের কোনও বদল হয়নি, যে ছবিতেও কোনও পরিবর্তন আসেনি সেই ছবি ঘিরে রহস্য যে ঘনীভূত হবে, সে কথাও বলাই বাহুল্য। ফলে পার্লে জি বিস্কুটের মিষ্টি বাচ্চা মেয়ের মুখটিকে ঘিরে আজও প্রশ্ন উঁকি দেয়। তবে এই মেয়েটি কাল্পনিক হলেও এর যে আকর্ষণ অনেকখানি তা অস্বীকার করা যায় না মোটেই।

More Articles