আবারও কি অঘটন? 'খুদে' সার্বিয়ার সঙ্গে টক্কর দিতে কতটা তৈরি ব্রাজিল
FIFA World Cup 2022: আরও চার বছর এই অপেক্ষাকে তাঁরা বাড়াতে চাইবেন না, ফলে নেইমার গোল করুন বা ভিনি, ব্রাজিল ভক্তদের আকাঙ্ক্ষা একটাই, বিশ্বকাপ!
ব্রাজিলের কিংবদন্তি ফুটবলার পেলে একবার বলেছিলেন, "ব্রাজিলিয়ানরা ফুটবল খায়, ফুটবল পান করে, ফুটবল ঘুমায়।" ব্রাজিল এমন একটি দেশ, যার কথা উঠলেই সবার আগে মনে পড়ে ফুটবলের নাম। ফুটবল ব্রাজিলিয়ানদের কাছে এতটাই ভালবাসার, যে মারাকানাজ্জো বা ১৯৫০ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে হারকে তারা হিরোশিমা-নাগাসাকির মতো বিপর্যয় বলে মনে করেছিল একটা সময়ে। কিন্তু, আজ ২০ বছর হয়ে গেল সেই ব্রাজিলের হাতেই নেই কোনও বিশ্বকাপ। শেষবার ২০০২ সালে রোনালদো নজারিও এবং রিভালদোদের জাদুকর এই মুহূর্তের পর আর কখনও ফাইনালে ওঠা হয়নি লাতিন আমেরিকার এই ফুটবল-পাগল দেশটির। কিন্তু, এবারও কি আগের বছরের মতোই অবস্থা হবে ব্রাজিলের? না কি শক্তিশালী দল নিয়ে এবার বিশ্বকাপ ঘরে তুলবেন নেইমাররা?
এখন সব থেকে বড় প্রশ্ন হলো, কাতারে ষষ্ঠ বিশ্বকাপ জয়ের মিশনে কেমন হবে ব্রাজিলের কোচ তিতের কৌশল? রাশিয়া বিশ্বকাপে চরম ব্যর্থতার পর নিজেদের কৌশলে অনেক পরিবর্তন এনেছিলেন ব্রাজিলের কোচ। কোপা আমেরিকা ফাইনালে আর্জেন্টিনার কাছে পরাস্ত হলেও, প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে দলের অনেক কিছু পরিবর্তন করেন এই কোচ। বলতে গেলে দলকে একেবারে পাল্টে ফেলেন তিনি। কোপা আমেরিকার স্মৃতিকে ভুলে কাতার বিশ্বকাপের জন্য নিজের দলকে প্রস্তুত করেন তিতে। সাম্প্রতিক অতীতে নিজের কৌশলে স্থির থেকে বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান তিনি। গত বছর থেকেই ইউরোপিয়ান ফুটবলে আলো-ছড়ানো বেশ কিছু নাম যুক্ত হয়েছে ব্রাজিলে। আর তিতে চেষ্টা করেছেন, তাঁদের সর্বোচ্চটা পরীক্ষা করে দেখতে। সবাইকে নিয়ে দলের একটি সমন্বিত এবং ঐক্যবদ্ধ রূপ দাঁড় করানো এখন তার কাছে সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ।
আরও পড়ুন: কাল আর্জেন্টিনা, আজ জার্মানি! এই বিশ্বকাপ কি অঘটনের
তিতে যেভাবে দলকে খেলান, তাদের ব্রাজিল দলের মধ্যে নানারকম বৈচিত্র্যময় বিষয়ের সমন্বয় ঘটে। ধরা যাক, কোনও একটি ম্যাচে ৪-৩-৩ ফর্মেশন নিয়ে খেলা শুরু করল ব্রাজিল। কিন্তু সব সময় যে এই ফর্মেশন থেকে যাবে, সেরকমটা বলা যায় না। কোচ যেভাবে ব্রাজিলের দল চালিয়ে থাকেন, তাদের খেলা চলাকালীন সময় বারবার এই ফর্মেশন বদল হতে থাকে। কৌশল সম্পর্কে জানতে হলে, আগে জানা দরকার, ব্রাজিলের দলটি কীরকমভাবে সাজানো রয়েছে। প্রথমত এই দলের ব্যাক লাইনে রয়েছেন দানিলো, থিয়াগো সিলভা, মার্কিনিওস এবং অ্যালেক্স সান্দ্রো। এঁরাই হবেন কোচের প্রথম পছন্দ। এছাড়াও ব্যাক লাইনের জন্য রিজার্ভ বেঞ্চে রয়েছেন অ্যালেক্স তেলেসও।
কোচ বেশি গুরুত্ব দেবেন দলের মাঝমাঠের ওপর, কারণ মাঝমাঠ থেকেই খেলা তৈরি হয় এবং শেষে উইং অথবা সেন্টার থেকে গোল হয়। তাই মাঝে মাঝে দুই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড তারকা ক্যাসেমিরো ও ফ্রেডের ওপরে ভরসা রাখছেন কোচ তিতে। এছাড়া মাঝমাঠ থেকে আক্রমণাত্মক খেলতে পারেন লুকাস পাকেতা। দুদিকে দুই উইং দিয়ে আক্রমণ তৈরি করার চেষ্টা সব সময় করে থাকেন ব্রাজিলিয়ান কোচ তিতে। সেই কারণে ব্রাজিলকে গোলের সুযোগ তৈরি করে দেওয়ার দায়িত্ব থাকবে ভিনিসিয়াস জুনিয়র এবং রাফিনিয়ার উপর। আর নেইমারের ভূমিকা হবে অনেকটা ফলস নাইনের মতো এবং তিনি খেলবেন একেবারে সেন্টার ফরওয়ার্ডে। দুই উইং থেকে আক্রমণের ঝড় তুলে ভিনি জুনিয়র ও তাঁর কাছে বল পাঠানোর চেষ্টা করবেন এবং পেনাল্টি বক্সের দিকে টার্গেট নেবেন। তবে গোল করার ক্ষেত্রে, কোচের আরেকজন ভরসা হতে পারেন রিচার্লিসন।
এবারের ব্রাজিলের দলটি আগেরবারের থেকে অনেকটাই শক্তিশালী। তাই দলের প্রয়োজনে নিশ্চিতভাবে বেশ কিছু পরিবর্তন তিনি নিয়ে আসবেন। সার্বিয়া বা এই ধরনের কিছু সহজ দলের বিরুদ্ধে ম্যাচে বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারেন তিনি। সেই সুযোগও রয়েছে কোচের কাছে। তবে ২০১৮ সালের দলের সঙ্গে তুলনা করলে ২০২২ সালের ব্রাজিল দল অনেক বেশি শক্তিশালী বলা চলে।
প্রথম থেকেই ব্রাজিল দলটি একটু আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলতে পছন্দ করে। বিশ্বকাপে খেলতে আসা অন্যান্য দলের তুলনায় প্রতি ম্যাচে বেশি গোল করার প্রবণতা রয়েছে ব্রাজিলিয়ান ফুটবলারদের মধ্যে। ব্রাজিলের আক্রমণভাগ সবসময় চঞ্চল থাকে এবং তাদের টার্গেট থাকে বিপরীত টিমের ডি বক্স। এই বক্সে যদি বল স্পর্শ করা যায়, তাহলে ৮৭.৮ শতাংশ বেশি গোল হয় ব্রাজিলের। তবে লং বলে খেলার প্রবণতা বিশেষ একটা নেই লাতিন আমেরিকার কোনও দলের। আর্জেন্টিনা হোক বা ব্রাজিল, লাতিন আমেরিকার দলগুলি বেশি লম্বা বলে ফুটবল খেলে অভ্যস্ত নয়। তবে কাতারে এই কৌশলটিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে ব্রাজিল। মাঠে বেশিরভাগ সময় বলের ওপরে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে জোন ধরে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে ব্রাজিল। আর সেটাই হয়তো সাফল্য এনে দেবে এই দলটিকে।
তবে মাঝমাঠ থেকে আক্রমণ উঠে আসতে হবে। মাঝমাঠ কতটা ভালো খেলে, তার ওপর নির্ভর করবে উইং এবং সেন্টার ফরওয়ার্ডের খেলা। মূলত ম্যাচে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে প্রতিপক্ষকে বল থেকে দূরে রাখার কাজটি করতে হবে মাঝেমাঠের খেলোয়াড়দের। যতক্ষণ তাদের পায়ে বল থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত বিপক্ষ দলটি নিজেদের মধ্যে পজিশন প্লে করার সুযোগ পাবে না। এমনিতেই বল পজিশন রাখার ক্ষেত্রে ব্রাজিল সবসময় সংগঠিত থাকে। তাই, প্রতিপক্ষের জন্য মাঠে থাকে খুবই কম জায়গা। এবারেও সেরকমই কৌশল নিতে পারেন ব্রাজিলিয়ান কোচ। এর ফলে প্রতিপক্ষ কোণঠাসা হয়ে পড়বে এবং বল দখলের লড়াই জারি রাখার জন্য আউট অফ দ্য বক্স কিছু একটা করবে। আর সেখানেই ফাঁদ পেতে রেখে বাজিমাত করবে ব্রাজিল।
মাঠে নিজেদের একটা আলাদা কাঠামো তৈরি করার জন্য বেশ কিছু উপায় ব্যবহার করে থাকেন ব্রাজিলের কোচ। তবে সেই সমস্ত বিষয় নির্ভর করে সেদিনের খেলায় খেলোয়াড়দের পারফরমেন্সের ওপর। লেফট ব্যাক থেকে থার্ড সেন্টার ব্যাক হিসেবে খেলে দিতে পারেন কেউ কেউ। আবার কখনও কখনও মাঝমাঠ থেকে নেমে এসে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের ভূমিকা পালন করে দেন কাসেমিরো। তাই যে-কোনও মুহূর্তে কৌশল বদল করে দেওয়া ব্রাজিলিয়ান কোচের পক্ষে খুব একটা নতুন বিষয় নয়। তবে, চমক দেওয়ার জন্য সবার আগে প্রয়োজন নির্দিষ্ট কৌশলের। আর এই সমস্ত পকেট কৌশল তৈরি করার জন্যই সারা বিশ্বে সমাদৃত তিতে। আর এর মাঝখান থেকেই চলতে থাকে পজিশনাল প্লে, যার মাধ্যমে মাঠের চারপাশে অনেক বড় জায়গা তৈরি করে ব্রাজিল। এর ফলে প্রতিপক্ষের রক্ষণদুর্গে একের পর এক হানা দেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়ে যায়। কখনও কখনও বিষয়টা বিপরীত দিকে ঘুরে গেলেও, বেশিরভাগ সময় সাফল্য পায় ব্রাজিল। কখনও প্রতিদ্বন্দ্বীদের এলোমেলো রক্ষণের সুযোগ নিয়ে, আবার কখনও নিজেদের শক্তিশালী ফরওয়ার্ড লাইন নিয়ে পেনাল্টি বক্সের দিকে এগিয়ে যান নেইমার-ভিনিরা। আর তৈরি হয় দারুণ সুযোগ।
এই ব্রাজিলিয়ান দলের সমস্ত কৌশলের মধ্যমণি এবারেও সেই নেইমার। ব্রাজিলের কোচ ঘোষণা করেছেন, এই বিশ্বকাপের প্রতিটি ম্যাচ নিজের শেষ ম্যাচ মনে করে খেলতে নামবেন তিনি। ফলে, প্রচেষ্টা থাকবে চরম। ব্রাজিলের জন্য এমনিতেই একটা বড় সুসংবাদ রয়েছে, নেইমারের দুর্দান্ত ফর্ম। এমনিতেই মরশুমের শুরু থেকে গোল করে চলেছেন এই ব্রাজিলিয়ান তারকা। পিএসজি দলেও নিজের একটা ভালো ছন্দের প্রদর্শন করেছেন নেইমার জুনিয়র। তবে শুধুমাত্র নেইমার একা নন, ভিনিশিয়াস এবং রাফিনিয়ারাও সমান ছন্দে রয়েছেন। সঙ্গে রক্ষণভাগে রয়েছে দাপট। বাছাই পর্বে ১৭টি ম্যাচে মাত্র ৫ গোল হজম করেছিল ব্রাজিল। ফলে ব্রাজিলের রক্ষণভাগ যে দারুণ ফর্মে রয়েছে, তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। তার সঙ্গে হালফিলের প্রেসিং ফুটবলেও দারুণভাবে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে ব্রাজিল। তাই বলা চলে, এবারের বিশ্বকাপে ব্রাজিল অন্যতম ফেভারিট।
সারা বিশ্বের কোটি কোটি ভক্ত ব্রাজিলের সেই স্বরূপ দেখার অপেক্ষায় রয়েছে দীর্ঘ কুড়ি বছর ধরে। একটা সময় ব্রাজিল এবং বিশ্বকাপ হয়ে উঠেছিল সমার্থক। কিন্তু, ২০০২ সালের পর কাকা হোক বা নেইমার, কারও হাতেই ওঠেনি বিশ্বকাপের সেই সোনালি ট্রফি। সেই অপেক্ষা কি এবার ফুরবে? সামর্থ্য এবং শক্তি, কোনও দিক থেকেই ব্রাজিল কোন অংশে কম নয়। তবে অনেক সময় ব্রাজিল ওভার প্লে করে ফেলে। অর্থাৎ, বেশি করতে গিয়ে সবকিছু গুলিয়ে দেয়। বিশ্বকাপে চাপের মুহুর্তে আবারও এরকম গোলানোর সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আর ব্রাজিলের আরও একটা সমস্যা হলো, নেইমারের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে থাকার বিষয়টা। আজকাল ব্রাজিল মানেই শুধুমাত্র নেইমার। ফলে নেইমারের ওপর চাপ থাকে অনেকটাই বেশি। আর্জেন্টিনা কিছুটা হলেও মেসি-নির্ভরতা কাটিয়ে বেরিয়ে আসতে পারলেও, ব্রাজিল এখনও নেইমারের ওপরে অনেকটা ভরসা করে থাকে, যা ব্রাজিলকে ভবিষ্যতে ডোবাতে পারে। তবে, ব্রাজিল সমর্থকদের প্রত্যাশা থাকবে এবারেও। এইসব ছোটখাটো প্রতিবন্ধকতা দূর করে বড় মঞ্চে আরেকবার জ্বলে উঠুন সাম্বা কিংরা, এটাই চাইবেন ব্রাজিল ভক্তরা। আরও চার বছর এই অপেক্ষাকে তাঁরা বাড়াতে চাইবেন না, ফলে নেইমার গোল করুন বা ভিনি, ব্রাজিল ভক্তদের আকাঙ্ক্ষা একটাই, বিশ্বকাপ!