নেইমার নেই || আজ ব্রাজিল পারবে না হারবে?
Neymar Jr Brazil: সমুদ্রের লোনাজলের সঙ্গিনীস্পর্শে নেইমার সেরে উঠছিলেন। দেশজুড়ে যখন বিশ্বকাপ থেকে বিদায়ের জন্য হাহুতাশ, তখন নেইমারের এই আচরণ দেশবাসীকে ক্ষুব্ধ করেছিল।
নেইমার গোড়ালিতে চোট পেয়ে বেরিয়ে গেলেন ৮০ মিনিটের মাথায়। বস্তুত চোট কিছুটা আগেও পেয়েছিলেন, কিন্তু যখন পান, সেটা যে মারাত্মক চোট তা বোঝা যায়নি। পরে যখন ড্রেসিং রুমে পায়ে আইসপ্যাক নিয়ে বসে রইলেন, তখন মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। আশঙ্কাকে সত্যি প্রমাণ করে, ব্রাজিল টিম ম্যানেজমেন্ট থেকে জানিয়ে দেওয়া হল, তাঁকে আর গ্রুপ লিগের ম্যাচে পাওয়া যাবে না চোটের কারণে। নেইমারের চোটপ্রবণতার কথা নিয়ে বিরক্তিপ্রকাশ করেছেন কাকা। ব্রাজিলের বিশ্বকাপজয়ী দলের এই নামী ফুটবলারের বক্তব্য, চোট থেকে যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি আরোগ্য লাভ করে ব্রাজিলের হয়ে গ্রুপের বাকি খেলাগুলিতেও খেলা। তা যদি না করেন তবে দেশের প্রতি অবিচার হবে। কিন্তু ভবি ভোলার নয়। তাঁকে যে নক আউট পর্বের আগে কোনও খেলায় পাওয়া যাবে না, এটা নিশ্চিত হয়ে গেছে।
২০১৪ সালের ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে কলম্বিয়ার বিরুদ্ধে পিঠে আঘাত পেয়েছিলেন নেইমার। মেরুদণ্ডের আঘাত এতটাই নাকি মারাত্মক ছিল যে স্ট্রেচারে করে তাঁকে মাঠ ছাড়তে হয়। স্ক্যান করে দেখা যায় তাঁর একটা ভার্টিব্রাতে ফ্র্যাকচার আছে। অস্থিবিশেষজ্ঞরা সকলেই একমত হন যে, অপারেশন ছাড়া গতি নেই। এই আঘাতের ফলে নেইমার বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে জার্মানির বিরুদ্ধে খেলতে পারেননি। সেই খেলায় জার্মানি ৭-১ গোলে পরাজিত করে ব্রাজিলকে। এই লজ্জাজনক হারের পর ব্রাজিল বিশ্বকাপের আসর থেকে সেবারের মতো বিদায় নেয়।
আরও পড়ুন- লজেন্স বিক্রি থেকে ফুটবলের ময়দান! রাতারাতি শিরোনামে ব্রাজিলের রিচার্লিসনের লড়াই আর কেচ্ছা
নেইমার কিন্তু অপারেশন করাননি। তিনি কনজার্ভেটিভ ম্যানেজমেন্টের দিকেই ঝুঁকলেন। বিশ্রাম, ফিজিওথেরাপি ও ব্যায়াম করে সারানোর চিরাচরিত প্রথার শরণাপন্ন হলেন। কেমন বিশ্রাম নিয়েছিলেন, সেই সময়ের সংবাদপত্রগুলিতে চোখ রাখলেই বোঝা যাবে। তাঁকে সমুদ্রসৈকতে বিকিনি পরা যুবতীদের সঙ্গে দেখা যেতে লাগল। বান্ধবীরা তাঁকে ঘিরে রাখত। যাই হোক, জলকেলি করে যে মেরুদণ্ডের ফ্র্যাকচার থেকে সেরে ওঠা যায়, তা ডাক্তারদের জানা ছিল না। হতে পারে নেচারোথেরাপি কাজে দিয়েছিল তাঁর। সমুদ্রের লোনাজলের সঙ্গিনীস্পর্শে তিনি আস্তে আস্তে সেরে উঠছিলেন। দেশজুড়ে যখন বিশ্বকাপ থেকে বিদায়ের জন্য হাহুতাশ, তখন নেইমারের এই আচরণ দেশবাসীকে ক্ষুব্ধ করেছিল। দেশের প্রতি দায়বদ্ধতায় কোথায় যেন ঘাটতি দেখা যাচ্ছিল নেইমারের আচার-আচরণে।
২০১৮-র বিশ্বকাপে কোয়ার্টাল ফাইনালে বেলজিয়ামের কাছে ১-২ ব্যবধানে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিতে হয় ব্রাজিলকে। যদিও নেইমার প্রিকোয়ার্টার ফাইনালে মেক্সিকোর বিরুদ্ধে গোল পেয়েছিলেন, তাঁর প্লে-অ্যাক্টিং বিক্ষুব্ধ করেছিল দর্শক ও সাংবাদিকদের। বিবিসি স্পোর্টসে তাঁর বদমেজাজ আর ক্রীড়া-অভিনয়ের তুমুল সমালোচনা করা হয়। ব্রজিলের সংবাদপত্রগুলিও ছিল নেইমারের সমালোচনায় মুখর। একটি প্রধান কাগজে লেখা হয়েছিল, "নেইমার হয়তো ব্রাজিল মাতাতে পারেন, তবে অবশিষ্ট বিশ্বের বিরক্তি ও ক্ষোভের কারণ তিনি।"
ফিরে যাওয়া যাক কলম্বিয়ার বিরুদ্ধে ২০১৪-র কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচে। কলম্বিয়ার খেলোয়াড় জুয়ান ক্যামিলো জুনিগার কড়া ট্যাকলে ভূপাতিত হওয়ার পর নেইমারের যন্ত্রণায় কাতরানিকে অনেকে প্লেঅ্যাক্টিংই ভেবেছিল প্রথমে। যাহোক স্ট্রেচারে করে তাঁকে মাঠ ছাড়তে হয়েছিল। তারপর অস্থি বিশেষজ্ঞদের নির্দেশ ছিল নেইমারের ভার্টিব্রাল কলামে যে ভার্টিব্রা-ফ্র্যাকচার হয়েছিল, অপারেশনের মাধ্যমে তা সারিয়ে তোলা। মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় নিজের ডাক্তারি অভিজ্ঞতায় দেখেছি, সুনীল ঠাকুরের মতো নামকরা অর্থোপেডিক সার্জন ও স্পোর্টসমেডিসিন বিশেষজ্ঞ এইসব ক্ষেত্রে অপারেশন করতে বিন্দুমাত্র দেরি করতেন না।
বছর কুড়ি আগে ডাক্তার কল্যাণ মুখোপাধ্যায় সচিন তেন্ডুলকারের মেরুদণ্ডের হাড়ে স্ট্রেস ফ্র্যাকচার নিয়ে লিখেছিলেন বিভিন্ন সংবাদপত্রে। ছবি এঁকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন অপারেশন ছাড়া কোনও গতি নেই রোগমুক্তির। ভারী ব্যাটই যে তাঁর লাম্বার ভার্টিব্রার ফ্র্যাকচারের কারণ তা তিনি জোর দিয়ে লিখেছিলেন। সচিনের টেনিস এলবো ও কাঁধের সমস্যা থেকেও মুক্তির নিদানও বাতলে ছিলেন তিনি। অপারশনের মাধ্যমেই যে তিনি সুস্থ হতে পারেন, তা জোর দিয়ে বলেছিলেন। একসময় চোটে আঘাতে জর্জরিত সচিন তেন্ডুলকারকে দীর্ঘ দেড়-দু'বছর ক্রিকেট থেকে ছুটি নিতে হয়। তারপর অপারেশন করিয়ে স্বমহিমায় ভারতীয় দলে ফিরে আসেন। যদিও তাঁকে কখনও দল থেকে বাদ পড়তে হয়নি, ডাক্তারের নির্দেশে মেডিকেল লিভেই ছিলেন। মোট তিনটি অপারশনের ধকল সইতে হয় তাঁকে। দেখা যাচ্ছে, ডাঃ কল্যাণ মুখার্জির মতো নামী অস্থিরোগ বিশেষজ্ঞ ও স্পোর্টস মেডিসিনের চিকিৎসক অনেক আগেই বলেছিলেন ভার্টিব্রার ফ্র্যাকচারে অপারেশনই একমাত্র নিদান।
আরও পড়ুন- ‘টিয়েন্টো’ থেকে ‘আল রিহালা’, ৯২ বছরে বিশ্বকাপের ফুটবলখানাই হয়ে উঠলো ‘হাইটেক’
কনজার্ভেটিভ ম্যানেজমেন্টে (প্লাস্টার, বিশ্রাম, ব্যায়াম, ফিজিওথেরাপি) হাড় জুড়লেও তা এলোমেলোভাবে জুড়বে। এতে পরবর্তীকালে দেখা দেবে অনেক নতুন সমস্যা। ঠিকভাবে না জোড়ার জন্যে মেরুদণ্ড কমজোরি হয়ে পড়ে। আঘাতপ্রাপ্ত ফুটবলারের মধ্যে মেরুদণ্ডকে বাঁচিয়ে খেলার প্রবণতা দেখা দেয়। মেরুদণ্ডকে বাঁচানোর প্রবণতার জন্য শরীরের অন্য অংশে আঘাত লাগার আশঙ্কা বেড়ে যায়।
নেইমার দ্য সিলভা সান্তোস জুনিয়র বা সংক্ষেপে নেইমার, তাঁর মধ্যে চোটআঘাত পাওয়ার প্রবণতা বেশি। যেভাবে ঈশ্বরদত্ত ফুটবল প্রতিভা তাঁর মধ্যে এসেছে, তাকে সঠিকভাবে লালনপালন করার নিয়মনিষ্ঠ চরিত্র তাঁর নেই। অনুশীলনে অনীহার জন্যে চোট আঘাত পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে গেছে।
মাংসপেশি ও লিগামেন্টের সহনশীলতা বা এনডিওরেন্স বাড়ে নিয়মিত জগিং, শরীরচর্চার মাধ্যমে। নেইমারের ধাতে সেসব নেই। রঙিন জীবনযাপনে অভ্যস্ত নেইমারকে ক্রিকেটের ব্রায়ান লারা, বিনোদ কাম্বলির সঙ্গে তুলনা করা যায়। রোনাল্ডো, মেসি, এমবাপের সঙ্গে একই ব্র্যাকেটে তাঁকে রাখা যাবে না, এই চোট আঘাতের প্রবণতা ও প্লে-অ্যাক্টিংয়ের জন্য।
এখন দেখা যাক তাঁর নক আউট পর্বের ম্যাচে খেলার সম্ভাবনা কতটা। মেরুদণ্ডকে বাঁচাতে গিয়ে পায়ের অ্যাঙ্কেল জয়েন্টে চোটটা ভালো রকমই। গোদা বাংলায় পা ফুলে ঢোল। কমছে আস্তে আস্তে। আইস প্যাকিং তো আর চিকিৎসার শেষ কথা নয়, আঘাতপ্রাপ্ত জায়গায় কর্টিসোন ইনজেকশনও নাকি দেওয়া হচ্ছে। সঙ্গে ওষুধবিসুদও চলছে। দশদিনের বিশ্রাম বলা হলেও, তা বেড়ে কুড়ি দিনও হতে পারে এসব ক্ষেত্রে। গ্রুপ লিগে সার্বিয়ার বিরুদ্ধে ব্রাজিল জয় পেয়েছে ২-০ গোলে। খেলা আছে আজ সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে। নেইমার যে এ খেলায় খেলছেন না, তা একশো শতাংশ নিশ্চিত। গ্রুপ লিগের পরের খেলাগুলিতে তিনি খেলবেন কিনা তা দেবা ন জানন্তি কুত মনুষ্যা। তিনি এই বিশ্বকাপে আর খেলবেন কিনা কেউ জানে না। অরণ্যদেবের স্টাইলে কিলাউয়ির সোনাবেলায় সি-বিচে ঘুরে বেড়াবেন, না প্রমোদবিহারে বেরোবেন, তা নেইমারই জানেন।