হেলায় মৃত্যু বহু ভারতীয় শ্রমিকের! শুরুতেই যেভাবে কলঙ্কিত কাতার বিশ্বকাপ
World Cup 2022: শুরুতেই বিতর্কের আহ্বানে ব্যতিব্যস্ত হল কাতার বিশ্বকাপ। প্রস্তুতিপর্ব থেকে প্রথম খেলা।
একদিকে আলো আর একদিকে কালো! তীব্র আনন্দের মধ্যেই দুঃখের বাতাবরণ। জাঁকজমকের বিপরীতেই কড়া নাড়ছে সমালোচনা! বিশ্বের সর্বাধিক খরচের ফুটবল বিশ্বকাপকে ঘিরে তৈরি হয়েছে এমনই সব বিতর্ক। বিরাট যজ্ঞের সঙ্গেই কাতারের বিশ্বকাপ আয়োজনের ত্রুটি ঘিরে ধরেছে উদ্যোক্তাদের। সঙ্গে পরিযায়ীদের আর্তনাদ প্রশ্নের মুখে ফেলেছে কাতার প্রশাসনকে।
একাধিক অব্যবস্থার মধ্যেই বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচ দেখা থেকে শুরু করে স্টেডিয়ামের বাইরে শ্রমিক হেনস্থা। ফের বিতর্কের সৃষ্টি করেছে বিশ্বকাপ ফুটবল। অভিযোগ, রবিবার সকাল থেকে প্রায় ৬ ঘণ্টা কড়া রোদে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে ভারতের ২০০ শ্রমিককে। সঙ্গে ফিলিপিন্সের ৩০ জন। ভারতের এই বাসিন্দারা হিসাবরক্ষক হিসেবে কাজ করবেন বলে চুক্তি হয়েছিল। আর ফিলিপিন্সের শ্রমিকরা স্টেডিয়ামের ভিতরে কেনাবেচার কাজ করবেন, চুক্তি ছিল এই মর্মেই। অভিযোগ, রবিবার সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চূড়ান্ত হেনস্থার শিকার হন এই কর্মীরা। কাতার স্টার সার্ভিসেস নামের একটি সংস্থার তরফে কাজের কথা বলা হলেও হেনস্থার শিকার হন তাঁরা।
শুধু এই ঘটনার পরেই কাতার বিশ্বকাপ ফের সমালোচনায় বিদ্ধ হলেও এই আয়োজনকে কেন্দ্র করেই পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর অকথ্য অত্যাচারের অভিযোগ উঠেছে বারবার। এমনকি মদ্যপান থেকে সমকামী বিতর্ক, বারবার শিরোনামে উঠে এসেছে কাতার। স্বয়ং সমালোচনায় সরব হয়েছেন ফিফা-র সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনো-ও।
আরও পড়ুন: নিরামিষ বিশ্বকাপ! বিশ্বের ফুটবলপ্রেমীদের জন্য কী কী চরম নিষিদ্ধ কাতারে?
কী করেছে কাতার?
২০১০ সাল। ডিসেম্বরের এক রাত। ঘোষণা হলো ২০২২-এর ফুটবল বিশ্বযুদ্ধ হবে কাতারে। কিন্তু কীভাবে! বালির দেশে বিশ্বকাপ নিয়ে প্রশ্ন উঠল তখন থেকেই। যে দেশে নেই কোনও স্টেডিয়াম, পরিকাঠামো শূন্য অবস্থায় থাকা দেশে এই মহাযজ্ঞ নিয়ে সমালোচনা হল বিস্তর। কিন্তু সময় রয়েছে হাতে। প্রবল আর্থিক ক্ষমতাকে অস্ত্র করে শুরু হল বিপুল কর্মযজ্ঞ। পরিকাঠামো তৈরির কাজ। আর এখানেই ডাক পড়ল পরিযায়ী শ্রমিকদের। ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা; এমনকী, পাশ্চাত্যের একাধিক দেশ থেকে গেলেন হাজার হাজার শ্রমিক। কাজের আশায়, ভালো আয়ের তাড়নায়।
কিন্তু আর পেলেন কই! বিভিন্ন সংস্থার হয়ে কাজের ক্ষেত্রে বাধল গোল। কাজ করে টাকা নেই তো ছিলই, সঙ্গেই চলে অকথ্য অত্যাচার। খাবার থেকে বাসস্থান, একে একে বিপদের সীমা অতিক্রম করেন বিদেশিরা। এখানেই শেষ হয়নি সবটা। বালির ওপরে বিশ্বজোড়া স্থাপত্যের কারিগরদের মৃত্যুও ঘটতে থাকে একের পর এক।
এই সংক্রান্ত অভিযোগের মধ্যেই চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে 'দ্য গার্ডিয়ান'-এর একটি প্রতিবেদন। সেখানে বলা হয়েছে, কাতার বিশ্বকাপের পরিকাঠামো তৈরির সময় মৃত্যু হয়েছে কমপক্ষে ৬ হাজার ৫০০ শ্রমিকের। এর মধ্যে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার মতো দেশের শ্রমিকের সংখ্যা বেশি। কাতারের উদ্দেশ্যে যখন ৩২টি দেশের ফুটবলাররা রওনা দিচ্ছেন, ঠিক সেই সময়ে এই তথ্য প্রকাশ্যে এনেছে 'দ্য গার্ডিয়ান'।
ওই প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, গত ১০ বছরে গড়ে ১২ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে প্রতি সপ্তাহে। প্রবল গরম আর চূড়ান্ত অব্যবস্থায় অকালে মৃত্যু হয়েছে শ্রমিকদের। যেখানে ফিলিপিন্স, নেদারল্যান্ডসের মতো দেশের শ্রমিক-মৃত্যুর পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। আবার পাকিস্তানের ৮২৪ জন শ্রমিক কাতারে মারা গিয়েছেন বলেও দাবি করা হয়েছে।
এই প্রশ্নের আবহেই কাতারের তরফে দাবি করা হয়েছে, মাত্র ৩৭ জন শ্রমিকের মৃত্যু ঘটেছে সে-দেশে। জানা যায়, ভারতের কেরল-সহ একাধিক রাজ্যের বাসিন্দারা কাতার যান। তাঁদের অনেকেরই মৃত্যু হয়েছে এই কাজ করতে করতেই।
কেন মৃত্যু?
বলা হচ্ছে, অধিকাংশ মৃত্যুর কারণ 'হিট স্ট্রোক'। সঙ্গে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে কাতারে। অতিরিক্ত কাজের চাপ আর নানান অত্যাচারের কবলে পড়ে আত্মঘাতী হয়েছেন বহু শ্রমিক। এর মধ্যে রয়েছে কাজ করতে করতে দুর্ঘটনার কবলে পড়ার বিষয়টিও। অর্থাৎ শুধুই প্রবল গরমের ফলে মৃত্যু নয়, সঙ্গে আত্মহত্যা, দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে বারবার। এই তথ্য প্রকাশ্যে আসতেই শোরগোল পড়ে। নেদারল্যান্ডসের মতো দেশের ফুটবল দল কাতারে পৌঁছেই তাদের দেশের শ্রমিকদের আমন্ত্রণ জানায় সাক্ষাতের জন্য। আর পরিযায়ী শ্রমিদের নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছে ভারতের মতো দেশগুলো। তেমনভাবে কাতারের বিরুদ্ধে মুখ খোলেনি কেউ।
অবাধ বিচরণে বাধা
শ্রমিক-মৃত্যুর বিতর্কের মধ্যেই কাতার বিশ্বকাপকে ঘিরে ধরেছে উদ্যোক্তাদের নানা বিধিনিষেধ। যেখানে মদ্যপান থেকে শুরু করে অবাধ যৌনতায় সীমাবদ্ধ থাকা, সমস্ত ক্ষেত্রেই নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছে মুসলমান রাষ্ট্র কাতার। এমনকি বিশ্বকাপ দেখতে আসা বিদেশিদের পোশাকের ক্ষেত্র নিয়েও রয়েছে বিধিনিষেধ। সমুদ্রের পাড়ে যাওয়ার বিষয়েও একাধিক নিয়মের বেড়াজাল সৃষ্টি করেছে কাতার প্রশাসন।
সমকামী বিতর্ক
সমকামী ফুটবলার এবং সার্বিকভাবে সমকামবিদ্বেষী মনোভাবের পথেই চলেছে কাতার। এমনকি এক্ষেত্রেও রয়েছে অঘোষিত নানা বিধিনিষেধ। যদিও সমকাম নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে জঙ্গি সংগঠন আলর কায়েদা-র একটি হুমকি ঘিরেও। কাতারে সমকামী ফুটবলার-নিষেধ এবং সমগ্র আয়োজন বন্ধ না করলে হামলা হবে, এমন জানিয়ে রেখেছে এই উগ্রপন্থী সংগঠন।
সমালোচিত ফিফা
বিশ্বের ফুটবল সংস্থার বিরুদ্ধে সরব হয়েছে বিশ্ব। কাতার বিশ্বকাপ নিয়ে একাধিক বিতর্কে সমালোচিত হয়েছে এই সংস্থাও। সমকাম থেকে মদ্যপান। শ্রমিক-মৃত্যু থেকে শুরু করে বিচরণে বিধিনিষেধ। কাতারের নানা পন্থায় বিপর্যস্ত হয়েছে ফিফাও। এতদসত্ত্বেও প্রশ্ন উঠেছে সেই তাদের ভূমিকা নিয়েই।
শুরুতেই বিতর্কের আহ্বানে ব্যতিব্যস্ত হল কাতার বিশ্বকাপ। প্রস্তুতিপর্ব থেকে প্রথম খেলা। সবকিছুতেই ফের সমালোচনার কেন্দ্রে উঠে এলো কাতার। যেখানে শ্রমিক অসন্তোষের দাবানলে উঠে আসল একাধিক অব্যবস্থার প্রশ্নও।