ইটের বদলে পাটকেল! 'জ্বালাময়ী' মহুয়াকে যে ভাবে পাল্টা উত্তর দিলেন নির্মলা সীতারামন

Mahua Moitra slams BJP government : মহুয়া মৈত্র যে ক্ষমতাকে প্রশ্ন করেছিলেন, সেই ক্ষমতার উদাহরণকেই আরেক দফা ব্যবহার করলেন নির্মলা। এবার তাঁর অভিমুখ পশ্চিমবঙ্গ।

“পাপ্পু কে? আসল পাপ্পুর পরিচয় জেনে নিন”। সংসদের শীতকালীন অধিবেশনের মধ্যেই এমন প্রশ্ন তুলে ধরলেন সাংসদ মহুয়া মৈত্র। তারপরই ফাটিয়ে চললেন একের পর এক বোমা। কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি, দেশের অর্থনীতি নিয়ে টোপ দাগেন কৃষ্ণনগর লোকসভার তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ। সেখানে তাঁর মূল টার্গেট ছিলেন কেন্দ্রের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। দিল্লির শীতের মধ্যেও গরম আবহাওয়া সংসদ ভবনে। অবশ্য একপাক্ষিক বক্তৃতা হয়নি। মহুয়া মৈত্রের ‘জ্বালাময়ী’ ভাষণের পর আসরে নামেন নির্মলা সীতারামনও। তর্ক, পাল্টা উত্তরের মধ্যেই উত্তপ্ত হল সংসদীয় রাজনীতি।

ঘটনার সূত্রপাত ১৩ ডিসেম্বর। শীতকালীন অধিবেশন চলাকালীন কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ঘোষণা করে, এই মুহূর্তে বাজেটের নির্ধারিত হিসেব বেশ খানিকটা কম রয়েছে। মোদি সরকার বলছে, এখন বাজেটের বাইরেও সরকারের অতিরিক্ত ৩.২৬ লক্ষ কোটি টাকার প্রয়োজন। ঠিক এই তথ্যটি তুলে ধরেই পার্লামেন্টে কেন্দ্রীয় সরকার ও অর্থ মন্ত্রককে আক্রমণ করেন সাংসদ মহুয়া মৈত্র।

মহুয়ার বক্তব্য, প্রতি বছর বাজেট পেশের সময় আশ্চর্য সব স্বপ্ন দেখায় কেন্দ্রীয় সরকার। বিশ্বের সবথেকে বড়ো অর্থনীতির দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন দেখানো কিন্তু তার পরিপ্রেক্ষিতে কাজ কীরকম হচ্ছে, সেটা আসল কথা। মহুয়া বলছেন, প্রতি বছর বাজেট পেশের আট মাস পরই অতিরিক্ত টাকার প্রয়োজন হয়। কেন অতিরিক্ত টাকার প্রয়োজন? প্রশ্ন তুলেছেন তৃণমূল সাংসদ।

সেইসঙ্গে ঘুরছে ‘পাপ্পু’র প্রসঙ্গ। ২০১৪ সাল থেকেই বিজেপির রাজনৈতিক প্রচারের একটি অংশ হল ‘পাপ্পু’। রাহুল গান্ধীকে আক্রমণ করার জন্য বারবার এই শব্দটির ব্যবহার করেছে বিজেপি নেতৃত্ব। গেরুয়া শিবিরের মতে, পাপ্পু মানে যে বা যারা অযোগ্য। এবার সংসদে ভারতীয় অর্থনীতির অবস্থা বোঝাতে সেই ‘পাপ্পু’ই আশ্রয় মহুয়া মৈত্রের। তাঁর বক্তব্য, “কেন্দ্রীয় সরকার এবং শাসক দল (বিজেপি) বারবার ‘পাপ্পু’ শব্দটি ব্যবহার করেন। কাউকে হেয় করতে, কেউ অযোগ্য প্রমাণ করতে এই শব্দটি বারবার ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে যাবতীয় তথ্য, পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে – আসল পাপ্পু কে?”

এর ভিত্তিতে তিনি বেশ কিছু পরিসংখ্যান সামনে রেখেছেন। একবার সেদিকে নজর দেওয়া যাক। ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিক্যাল অফিসের তথ্য বলছে, অক্টোবরে ভারতে শিল্পে উৎপাদনের পরিমাণ আগের তুলনায় ৪ শতাংশ কমেছে। হিসেব করলে দেখা যাবে, গত ২৬ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। অথচ করোনার বীভৎসতা, লকডাউনের জেরে কারখানা বন্ধ, কোনওটাই এখন নেই। পাশাপাশি ম্যানুফেকচারিং সেক্টর বা কারখানায় উৎপাদন ক্ষেত্র কমেছে ৫.৬ শতাংশ। খেয়াল রাখতে হবে, শিল্পের মানচিত্রে উৎপাদন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায়। সেজন্য ম্যানুফেকচারিং ইন্ডাস্ট্রিরও প্রয়োজন আছে। এই জায়গাটি বাড়লে বাকি শিল্পও বাড়বে। কর্মসংস্থানও বাড়ে। সেই সেক্টরে মন্দা এলে সামগ্রিক ভাবেই অবস্থা খারাপ হবে।

মহুয়া মৈত্র পরিসংখ্যান দেখিয়ে বলেছেন, অন্তত ১৭টি শিল্পক্ষেত্রের সাম্প্রতিক রিপোর্টে উৎপাদন ‘নেগেটিভ গ্রোথ রেট’-এ। এক বছরে বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার কমেছে ৭২০০ কোটি ডলার। সম্প্রতি সংসদে দাঁড়িয়েই বিদেশ মন্ত্রী জানিয়েছেন, প্রায় দু’লাখ ভারতীয় নিজেদের নাগরিকত্ব ছেড়েছেন। ২০১৪-২০২২ গত আট বছরের হিসেবে সেই সংখ্যাটা সাড়ে ১২ লক্ষ ছাড়িয়ে গিয়েছে। যাঁদের টাকা আছে, তাঁরা পর্তুগাল, গ্রিসের মতো দেশে নাগরিকত্ব নেওয়ার জন্য কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করছেন। কেন?

এরকম নানা প্রশ্ন তোলেন মহুয়া মৈত্র। আজ নয়, এর আগেও সংসদের বহু অধিবেশনে তাঁর বক্তব্য, তাঁর প্রশ্ন ভাইরাল হয়েছে। চলতি বছরেই ২২ মার্চ পার্লামেন্টে বেসরকারিকরণ নিয়ে বক্তব্য রাখেন। কথায় কথায় উঠে আসে দেশের বিমান পরিষেবার কথা। এয়ার ইন্ডিয়া ফের টাটাদের হাতে চলে যাওয়ার পর এভিয়েশন মিনিস্ট্রি দরকার আছে কিনা, তার কথা বলেন। বিপুল টাকা খরচ করে একের পর এক বিমানবন্দর তৈরি না করে যেগুলো আছে সেগুলোর দিকেই নজর দেওয়ার কথা বলেন। বাগডোগরা, লেহ, শ্রীনগর ইত্যাদি বিমান বন্দরের পরিকাঠামো উন্নয়নের কথা বলেন।

আর এখন তাঁর মুখে উঠে এল অর্থনীতির প্রসঙ্গ। অবশ্য পুরো বক্তব্যের মধ্যেই একটি অংশ তুলে ধরা প্রয়োজন। এক জায়গায় এসে মহুয়া মৈত্র বলছেন, “প্রশ্ন এটা নয় যে ঘর কে জ্বালাল। প্রশ্ন এটা যে, পাগলের হাতে মশাল কে দিয়েছে।” কথার চালে আদতে বিজেপি সরকারের দিকেই বন্দুকের নলটি রাখলেন তিনি। বারবার মিথ্যে বলার পর সাধারণ মানুষও সেসব বিশ্বাস করে চলেন। সরকারের সেই মিথ্যাচারের প্রসঙ্গ তুলে একের পর এক কথা বলেন মহুয়া। এরপরই বিতর্কের রাশ নিজের হাতে নেন নির্মলা সীতারামন।

‘মশাল কার হাতে’, ‘কে জ্বালাল ঘরবাড়ি’ ইত্যাদি প্রশ্ন থেকেই নিজের বক্তব্যের প্রেক্ষাপট তৈরি করেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী। সরাসরি তাঁর জবাব, “কার হাতে মশাল আছে, সেটা প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন হল, সে ওই মশাল কীভাবে ব্যবহার করবে।” মহুয়া মৈত্র যে ক্ষমতাকে প্রশ্ন করেছিলেন, সেই ক্ষমতার উদাহরণকেই আরেক দফা ব্যবহার করলেন নির্মলা। এবার তাঁর অভিমুখ পশ্চিমবঙ্গ।

ক্ষমতা থাকলেই শাসকের স্বভাবই থাকে সমস্ত কিছুকে নিজের দিকে টেনে আনার। যা বিরুদ্ধ মত, তাকে দাবিয়ে রাখো। কিংবা বারবার মিথ্যা বলে যাও। মহুয়া মৈত্র এই প্রবণতার দিকেই ইঙ্গিত দিলেন। কিন্তু ভুলে গেলেন নিজের রাজ্যের কথা, পশ্চিমবঙ্গের কথা। ভুলে গেলেন একের পর এক দুর্নীতির প্রসঙ্গ। এখান থেকেই খেলা ধরলেন নির্মলা। ‘পাপ্পু’ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সাংসদ (মহুয়া মৈত্র) যদি নিজের দলের দিকে তাকান, তাহলেই পশ্চিমবঙ্গে কে পাপ্পু সেটা স্পষ্ট হয়ে যাবে। ইঙ্গিত কার দিকে? অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়? না স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা? কেন্দ্রের প্রকল্প রাজ্যের নামে চালানোর অভিযোগ বহুদিনের। সেই অভিযোগকেই ফের সামনে তুলে আনলেন নির্মলা?

সেইসঙ্গে তুলে আনলেন ক্ষমতার কথা। কে দিয়েছে মশাল (পড়ুন ক্ষমতা) এটা ইস্যু নয়। জন প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা দেয় জনগণ। তাঁদের ভোটের মাধ্যমেই ক্ষমতায় আসেন তাঁরা। সেই ‘কমন ম্যান’দেরই কি অপমান করলেন মহুয়া? রাজনীতির মোক্ষম চালে প্রশ্নের অভিমুখ ঘুরিয়ে দিলেন। তবে এসবের মাঝেও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ তুললেন তিনি। নির্মলা সীতারামন বললেন, আগুন কার হাতে, সে কীভাবে প্রয়োগ করবে সেটাই আসল কথা। সম্প্রতি গুজরাত নির্বাচন হয়ে গেল। বিপুল মার্জিনে বিজেপি জিতল। হিমাচল প্রদেশেও হয়ে গেল। ভোটের আগে, ভোটের পরে সেখানে কীরকম পরিস্থিতি ছিল? সরাসরি তোপ দাগলেন অর্থমন্ত্রী। শান্তিপূর্ণভাবে ভোট হল, নতুন সরকার গঠন হল।

এবার সরাসরি নিশানা পশ্চিমবঙ্গ এবং নির্বাচন নিয়ে। নির্মলা সীতারামন যে পয়েন্টটি ধরেছেন, তাঁকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার সাধ্য অন্তত সাম্প্রতিক সময় দেয় না। ইতিহাসও দেয় না। কেন? পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন মানে অবধারিত হিংসার ঘটনা। ছাপ্পা, বোমাবাজি, রক্ত, গুলি চালনা, এমনকী মৃত্যু – সবটাই দেখেছে রাজ্যবাসী। ভোট দিতে গেলে বাড়ি ফেরা যাবে কিনা, এই চিন্তায় ভোগেন সাধারণ মানুষ। স্রেফ এইজন্য অনেকে ভোট দিতেও যান না। ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার পরও ঘুরে বেড়ায় শাসকের ‘বাহিনী’। ভোটের আগে, ভোটের সময় এবং তার পরেও রক্তপাত যেন নিয়ম হয়ে গিয়েছে। প্রতিবারই কাঠগড়ায় উঠেছে তৃণমূল কংগ্রেস। উল্লেখ্য, পঞ্চায়েত ভোটের আর বেশি দেরি নেই। তার আগেই রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় পাওয়া যাচ্ছে তাজা বোমা। বল ভেবে বোমা হাতে তুলে নিয়েছে শিশু। মারাও গিয়েছেন কয়েকজন। বম্ব স্কোয়াডকে ডেকে আনতে হচ্ছে বারবার। নির্বাচনের আগেই এমন ছবি দেখলে, পরে কী হবে?

সংসদের বক্তব্যে এই কথাই তুলে ধরেন নির্মলা সীতারামন। অবশ্য ভারতের পড়ন্ত অর্থনীতি নিয়ে সেভাবে কিছু বলতে দেখা যায়নি। কিন্তু তার বদলে যে প্রসঙ্গ তুললেন, তাকেও ফেলে দেওয়া যায় না।

More Articles