খুনের তদন্ত করে ফুল! ফিঙ্গার প্রিন্ট মুছে ফেললেও অপরাধীদের ধরিয়ে দেয় ফুলের রেণু?

Pollen Print: দার্জিলিংয়ে অপরাধ করে এসে, নদিয়াতে গা ঢাকা দিলে আপনি ফিঙ্গার প্রিন্ট থেকে উদ্ধার পেলেও পেতে পারেন, পোলেন প্রিন্ট থেকে পাবেন না।

১৯৫৯ সালে অস্ট্রিয়ায় এক ব্যক্তি রহস্যজনকভাবে হারিয়ে যান। ধরেই নেওয়া হয় তিনি খুন হয়েছেন। তবে তিনি যে খুনই হয়েছেন, তা জোর দিয়ে বলার মতো বিশেষ কোনও তথ্য প্রমাণ ছিল না কারুর কাছেই। তবে ছিল এক জোড়া কাদামাখা বুট। বুটের কাদায় আটকে রয়েছে কুড়ি মিলিয়ন বছরের পুরনো হিকরি ফুলের রেণু। সেই গাছ আর তখন অস্ট্রিয়ায় জন্মায় না। তার রেণুও পাওয়া যায় না আর। একমাত্র দানিয়ুব নদীর আশেপাশে খুব ছোট একটা অঞ্চলে তখনও পাওয়া যায় হিকরি ফুলের রেণু। আর সেই রেণুর সূত্র ধরেই সন্দেহভাজনকে পাকড়াও করেন তদন্তকারীরা। ফুলের রেণু আকৃতিতে অত্যন্ত ক্ষুদ্র হলেও, মজার বিষয় হল এগুলি খুব বেশিদূর ছড়িয়ে পড়তে পারে না।

“… if investigators are trying to locate a missing person or object, they can examine the pollen collected from a suspect’s clothing to create a unique location of the likely area where the crime may have occurred.” - Dr. Gabriella Pardee, Forensic Palynologist, University of Texus at Austin

ফিঙ্গার প্রিন্ট কাকে বলে তা তো সবাই জানি, কিন্তু পোলেন প্রিন্ট?

অস্ট্রিয়ার এই ঘটনার পর থেকেই ফরেন্সিক তদন্তের ক্ষেত্রে ফুলের রেণু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যপ্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা হয় পৃথিবীজুড়ে। প্যালিনোলজি কথার অর্থ ফুলের রেণুর চারিত্রিক বিশ্লেষণ করা। তাদের ভৌগোলিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক অবস্থান সম্পর্কে জানা।

আরও পড়ুন- বছরে একবার নিশুতি রাতে জন্ম নেয় ব্রহ্মকমল! হিমালয়ের ফুল ঘিরে রয়েছে নানা রহস্য

পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে আছে কয়েক লক্ষ প্রজাতির গাছ। আর গাছের প্রজাতি যেমন ভিন্ন ভিন্ন তাদের ফুলের রেণু কিংবা স্পোরও বিভিন্ন ধরনের হয়। একটি প্রজাতির গাছের স্পোর, অপরটির স্পোরের সঙ্গে মিলবে না। তারা ভিন্ন, স্বতন্ত্র। একটি প্রজাতির গাছের রেণুর আকার-আকৃতি, গড়ন অন্যটির থেকে আলাদা। তাদের একদম বাইরের আবরণের নকশাও ভিন্ন। মুশকিল হয় তখনই, যখন দু'টি ভিন্ন প্রজাতির গাছের রেণুর মধ্যে সহজে তফাৎ খুঁজে পাওয়া যায় না। আর সে জন্যই ডিএনএ মেটাবারকোডিংয়ের ধারণা চালু হচ্ছে। যাতে রেণুদেরকে বাহ্যিকভাবে আলাদা না করতে পারলেও, অন্তত জেনেটিক্যালি আলাদা করা যায়।

আবার প্রতিটি মানুষের যেমন ফিঙ্গারপ্রিন্ট আলাদা এবং অভিন্ন, ঠিক তেমনই প্রতিটি অঞ্চলের নির্দিষ্ট 'পোলেন প্রিন্ট' রয়েছে। একটি অঞ্চলের পোলেন প্রিন্ট আরেকটি অঞ্চলের থেকে আলাদা হবেই। কীভাবে একটি অঞ্চলের পোলেন প্রিন্ট ভিন্ন হয়?

ধরা যাক, পশ্চিমবঙ্গের গাঙ্গেয় উপত্যকা জুড়ে আম, জাম, কাঁঠাল, কলার মতো গাছই দেখা যায়। কিন্তু রাজ্যের একটি ভাগে হয়তো ২৫% আম, ২৫% জাম, ২৫% কাঁঠাল এবং ২৫% কলা গাছ দেখা যায়। আবার অন্য অংশে হয়তো ৩৫% আম গাছ, ২৫% জাম গাছ, ২০% কাঁঠাল ও ২০% কলা গাছ আছে। সেই গাছগুলির অনুপাতের উপর নির্ভর করেই তৈরি হবে ওই অঞ্চলের পোলেন প্রিন্ট।

অন্যদিকে ধরা যাক দার্জিলিংয়ের কথা। সেখানে পাইন, ওক, সাইকাস এবং নানান রকমের ফার্নের সমারোহ। অর্থাৎ দার্জিলিংয়ে অপরাধ করে এসে, নদিয়াতে গা ঢাকা দিলে আপনি ফিঙ্গার প্রিন্ট থেকে উদ্ধার পেলেও পেতে পারেন, পোলেন প্রিন্ট থেকে পাবেন না।

অপরাধের তদন্ত করবে পোলেন প্রিন্ট?

ফুলের রেণু বিষয়টা সবার কাছে খুব প্রীতিকর নয়। যাদের পোলেন অ্যালার্জি আছে তাঁদের জন্য তো বটেই, যারা অপরাধ করে, খুব কষ্ট করে অপরাধের তথ্যপ্রমাণ লোপাট করার চেষ্টা করেছেন, তাঁদের জন্যও। ফুলের রেণু জামাকাপড়, জুতো, চুল থেকে শুরু করে ব্যাগ বা নিজের সঙ্গে বয়ে বেড়ানো সমস্ত জিনিসে একবার লাগলে, তার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জো নেই। শতবার ডিটার্জেন্ট বা সাবান-শ্যাম্পু দিয়ে ধুলেও সে যায় না। আর যেহেতু এক একটি অঞ্চলের পোলেন প্রিন্ট একেবারেই আলাদা এবং স্বতন্ত্র, অপরাধ করে দূরে কোথাও চলে গেলেও সেই 'প্রিন্ট' কোথাও না কোথাও লেগেই থাকে- সে অপরাধীর গায়েই হোক কিংবা ভিক্টিমের গায়ে।

… investigators can place a suspect at the scene of the crime by matching the types of pollen found on his/her clothing with the flowering plant species present at the crime scene. Further, if investigators are trying to locate a missing person or object, they can examine the pollen collected from a suspect’s clothing to create a unique location of the likely area where the crime may have occurred These pollen grains can last for many years because they do not decompose due to their hard outer layer. This means that pollen can be perfectly preserved in amber thousands of years after it was released or be used to solve a crime many years after it was committed.” - Dr. Gabriella Pardee, Forensic Palynologist, University of Texas at Austin

আরও পড়ুন- মৃত্যুর চারশো বছর পরও কবর জোটেনি! রানিকে দেখতে এসে পর্যটকরা কেন খাবলে নিতেন হাড়?

বসনিয়ার যুদ্ধ ও গণহত্যা

২০০৪ সাল। ইউনিভার্সিটি অব এক্সেটারের ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ প্রফেসর টনি ব্রাউন হাতেনাতে দেখিয়ে দেন বসনিয়ার যুদ্ধে কী ধরনের অপরাধমূলক কাজ হয়েছে। সেখানেও সূত্র, গমের ফুলের রেণু। অবাক হলেন তো! বসনিয়ার যুদ্ধে গণহত্যার শিকার হয়েছিলেন হাজার হাজার মানুষ। প্রাথমিকভাবে তাঁদের দেহগুলি বিভিন্ন জায়গায় কবর দিয়ে রাখা হয়। আচমকা যেন গড়ে ওঠে একাধিক মাস গ্রেভইয়ার্ড বা গণকবরখানা (যদের বলা হচ্ছে 'প্রাইমারি বারিয়াল সাইট')। কিন্তু গণহত্যাই যে করা হয়েছে, সেই তথ্যপ্রমাণ লোপাটের জন্য আবার গণকবরগুলি খুঁড়ে মৃতদেহগুলিকে বের করা হয়। দেহগুলিকে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কবর দেওয়া হয় আবার (যে জায়গাগুলিকে বলা হচ্ছে 'সেকেন্ডারি বারিয়াল সাইট')। যাতে তামাম দুনিয়া জানতে পারে যুদ্ধের সময়ে খুন করা হয়েছিল বেশ কিছু মানুষকে, তবে তা গণহত্যা নয়।

কিন্তু সত্য বেশিদিন চাপা থাকেনি। ১৯৯৭ সাল থেকে টানা চারটি বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের নজরে থেকে প্রফেসর ব্রাউন ২০ টিরও বেশি স্থানে তদন্ত করেন। বিভিন্ন 'স্যাম্পেল সাইট'-এ তদন্ত চালাতে চালাতে এমন একটি কবরস্থান খুঁজে পান, যেখানে মৃতদেহের গায়ে লেগে আছে গমের রেণু। অথচ সেই জমির অন্যান্য জায়গায় গমের রেণুর চিহ্নমাত্র নেই। এদিকে দেহে লেগে থাকা মাটির গড়নও, সেই স্থানের নিজস্ব মাটির গড়নের থেকে একেবারেই আলাদা। অদ্ভুতভাবে আরেকটি অন্য স্যাম্পেল সাইটের পোলেন প্রিন্ট এবং মাটির গড়নের সঙ্গে তার হুবহু মিল খুঁজে পান প্রফেসর ব্রাউন। প্রফেসরের মাথায় তখন তড়িৎ খেলে যায় যেন! তিনি ততক্ষণে একটি কবরস্থানের সঙ্গে আরেকটি কবরস্থানের যোগসূত্র খুঁজে পেয়ে গিয়েছেন।

দেখা যায়, গণহত্যার পর প্রাথমিক একটি স্থানে অগুনতি মৃতদেহ কবর দেওয়া হয়েছিল, সেখানে আগে একটি গমের ক্ষেত ছিল। পরে প্রাথমিক স্থান থেকে দেহগুলিকে তুলে নিয়ে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু ততক্ষণে গমের রেণু আর সেই জমির মাটি লেগে গেছে মরদেহে। সেই সূত্র ধরেই বসনিয়ার যুদ্ধ অপরাধী র‍্যাডিস্লাভ কারস্টিককে অপরাধী সাব্যস্ত করা হয়। তিনি ১৯৯৫ সালে এই গণহত্যার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

 

More Articles