স্বাধীনতার প্রথম স্বাদ : বন্ধুদের সঙ্গে প্রথম শান্তিনিকেতন ঘুরতে যাওয়া

Independence Day: আমার কথা মেনে মা দায়িত্ব নিয়ে বাবা-সহ পরিবারের সকলকে রাজি করালো। এই অনুভূতি যেন আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অনুভূতি যা এনে দিল অফুরন্ত স্বাধীনতা আস্বাদ।

SD

মানুষের জীবন একটি নির্দিষ্ট চক্রের মধ্যে আবর্তিত। আর এই সময়ের মধ্যে দিয়েই প্রতিটি মানুষের আশা, আকাঙ্ক্ষা, চাহিদা, কিছু পাওয়া এবং কিছু না পাওয়ার অভিব্যক্তি ক্রমাগত প্রকাশ পায়। জীবন খুব ছোট এবং সীমিত। তবুও এই স্বপ্ন জীবনে সব কিছুর মধ্যেই যেন লুকিয়ে থাকে মানুষের বেঁচে থাকার নির্যাস। তাই ক্ষণিকের আনন্দের রসটুকুই প্রাণ ভরে আস্বাদন করে সে পরিতৃপ্ত হয়। এই পরিতৃপ্ত দৃঢ় হয়ে ওঠে যখন সে মুক্ত বিহঙ্গের মতো ডানা মেলে প্রথমবার স্বাধীনতার আকাশে উড়ে যায়, সে পায় মুক্তির আস্বাদ।

এই রকম একটি মুক্তির আস্বাদ আমিও পেয়েছিলাম। জীবনে প্রথমবার কয়েক বছর আগে সে আস্বাদ আমায় অজানাকে জানার, অচেনাকে চেনার এবং অদেখাকে দেখার মুক্তি এনে দেয়। এখনও সেই দিনটির কথা আমার মনে পড়ে। তখন আমি স্নাতকস্তরে বাংলা বিষয় নিয়ে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি। আমি ছিলাম লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের ছাত্রী। আর দিনটি ছিল পৌষ মাসের একটি রবিবার।

একদিন সকালবেলা মা ঘুম থেকে উঠে রান্নার তোড়জোড় শুরু করেছে। আগের দিন সারারাত আমি কেবল ভেবে গিয়েছি কীভাবে মা-কে বিষয়টি বলব। চিন্তায় এবং ভয়ে কিছুই বলে উঠতে পারছিলাম না। আসলে আমার বান্ধবীরা মিলে ঠিক করেছিল সবাই মিলে শান্তিনিকেতন ঘুরতে যাবে। আর আমি বিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই পরিবার ছাড়া কখনও দূরে কোথাও ঘুরতে যাইনি। যখন কলেজে উঠলাম, একা একা কলেজ যেতে পারার যে অনুভূতি তা যেন আনন্দের স্ফুলিঙ্গ রূপে শরীরে মনে বিদ্যুতের মতো প্রবাহিত হল। তার পর দ্বিতীয় বর্ষে কয়েক মাস পার হতেই বান্ধবীদের সঙ্গে ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা যেন মনে হল আমার এক দুঃসাহসিকতার পরিচয় জীবনে প্রথমবার বান্ধবীদের সঙ্গে ঘুরতে যাওয়ার আনন্দ যেন এক ছাই চাপা আগুনের উত্তেজনা স্বরূপ মনের ভেতর জ্বলতে থাকল। অন্যদিকে মায়ের কাছে অনুমতি চাওয়ার বিষয়টি যেন বারংবার আমার উত্তেজনার আগুনে জল ছিটিয়ে দিচ্ছিল।

আরও পড়ুন- নতুন ভারতে ‘গোলি মারো…’ বলার বাকস্বাধীনতা আছে, প্রশ্ন তোলার নেই

তবুও সাহস করে বলতে হবে। যা থাকে কপালে, এইভাবে একটু ইষ্টদেবতাকে প্রণাম করে মাকে বলে দিলাম- আমরা পাঁচজন বান্ধবী মিলে এক রাতের জন্য শান্তিনিকেতন ঘুরতে যাওয়ার কথা ভাবছি। জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি অনুমতি দেবে? হঠাৎ করে দেখলাম এই কথা শোনার পরই মায়ের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। একেই জীবনে প্রথমবার মা, বাবা ছাড়া অতদূরে ঘুরতে যাব। তার উপরে এক রাত বাইরে থাকার কথা বলে যেন আমি অসীম দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিয়ে ফেলেছি মনে হচ্ছিল আমার।

তবে শেষ পর্যন্ত আমার মা বান্ধবীদের অনেক অনুরোধে এবং আমার অনুনয়-বিনয় মিশ্রিত চোখের জলে কিছুটা নরম হলেন। আর তার মন নরম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা ঘুরতে যাওয়ার অনুমতি পেয়ে গেলাম।

আসলে আমি একটি রক্ষণশীল যৌথ পরিবারের একটি মাত্র মেয়ে।  কোনদিন একা সেভাবে কোথাও ঘুরতে যাইনি। তাই মায়ের মন সর্বদাই আশঙ্কিত ও ভয়ার্ত। তবে আমি মাকে আশ্বাস দিয়েছিলাম একটিবার সে সাহস করে আমায় যদি অনুমতি দেয়, তাহলে আমি প্রমাণ করে দেব যে আমি নিজের দায়িত্ব নিজে নিতে পারি।

আমার কথা মেনে মা দায়িত্ব নিয়ে বাবা-সহ পরিবারের সকলকে রাজি করালো। এই অনুভূতি যেন আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অনুভূতি যা এনে দিল অফুরন্ত স্বাধীনতা আস্বাদ। তবে পরিবারের সঙ্গে সব সময় ফোনে যোগাযোগ রাখব এই কথা শুনে তাঁরা হয়তো একটু চিন্তা মুক্ত হতে পেরেছিল।

আরও পড়ুন- স্বাধীনতার পর বাঙালির চরিত্র কীভাবে পাল্টে গেল, লিখে রেখেছিলেন মতি নন্দী

যেমন কথা, তেমন কাজ। তাই আর দেরি না করে ভোরবেলা মা তারা এক্সপ্রেস ধরার জন্য শিয়ালদহ স্টেশনে বান্ধবীদের সঙ্গে দেখা করলাম। সেই মুহূর্তে যুদ্ধ জয়ের মতো অনুভূতি হচ্ছিল। যে মুহূর্তে ট্রেন চলতে শুরু করল, বাইরের প্রকৃতির সৌন্দর্য আমি প্রাণভরে গ্রহণ করতে লাগলাম। বাড়ি থেকে প্রথমবার একা কোথাও পরিবার ছাড়া ঘুরতে যাচ্ছি, এটা ভেবে কিছুটা মন খারাপ করছিল ঠিকই, তবে জীবনে প্রথমবার এমন অভিজ্ঞতায় যেন শরীরের সমস্ত শিরা-উপশিরায় মুক্তির স্বাদ বইতে লাগল। বান্ধবীদের সঙ্গে হাসি মজায় মেতে উঠলাম। সঙ্গে ছিল অপূর্ব সুন্দর প্রকৃতি। নিজেকে সেই সময় মুক্ত পাখির মতো আকাশে মেলে ধরতে মন চাইছিল।

যথাসময়ে শান্তিনিকেতনে পৌঁছে মাকে ফোন করে দিলাম। তারপর সোনাঝুরির হাট, সৃজনী শিল্পগ্রাম, কঙ্কালীতলা এবং কোপাই নদীর তীর-সহ আরও অনেক জায়গায় আমরা ঘুরে দেখলাম। তারপর সাঁওতালি মেয়েদের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন-সহ সবার সঙ্গে খাওয়া দাওয়া আনন্দ মজা করার মধ্যে দিয়ে আমি যে বড় হয়ে গেছি এই ভাবনাটাই মর্মে মর্মে অনুভূত হতে লাগল।

আবার কবে এমন স্বাধীনতা পাব আমি জানিনা। তবে ওই সময়টুকুর মধ্যে অফুরন্ত মুক্তির আস্বাদ আমি গ্রহণ করেছি তা আমার কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই ছিল এক অসামান্য প্রাপ্তি। সেদিনই জীবনে প্রথমবারের মতো স্বাধীনতার স্বাদ আমি উন্মোচন করেছিলাম। তাই সেই দিনটিই ছিল আমার জীবনের একান্ত ব্যক্তিগত স্বাধীনতা দিবস।

More Articles