স্বাধীনতার প্রথম স্বাদ: নেট-জেআরএফ, ফুল ফেলোশিপ পাওয়া

Independence Day : সেই টাকায় প্রথম আমি কিনেছিলাম একটা মেঠো গোলাপি রঙের লিপস্টিক। আর একটা সবুজ কালি ভরা কলম। আর একটা বই—সুকুমারী ভট্টাচার্যের লেখা।

আমার বয়স তখন মাত্র তেইশ। এম.এ. পাস করেছি সদ্য—বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা, স্বপ্ন ছিল গবেষণা করব, কলেজে পড়াব, নিজেকে সময় দেব। কিন্তু সব ভালো করে বুঝে ওঠার আগেই বিয়ে হয়ে গেল।

আমাদের দেশে বিয়েটা যত না স্বামী-স্ত্রীর তার চেয়ে বেশি পারিবারিক। অনেক মানুষ, অনেক মতামত, অনেক সিদ্ধান্ত, তার চেয়েও বেশি বাধ্যবাধকতা। নতুন বৌ-এর চুপ করে থাকাই ছিল রীতি এবং নীতি। আমি চুপ করে গিয়েছিলাম, কিন্তু লক্ষ্য ছাড়িনি।

বিয়ের পর জীবনের গতি একেবারে বদলে গেল। দিনগুলো শুরু হতো রান্নাঘর দিয়ে, শেষ হতো ঘরের কাজে। বাঙালি শ্বশুরবাড়িতে এটাই ছিল স্বাভাবিক, এটাই নাকি মেয়েদের জীবন। পুজো-আচ্চা, আত্মীয়-স্বজন, গল্প-গাছা, সিরিয়াল, শাড়ি-গয়নার মধ্যে সেই মেয়েটা, যে ক’দিন আগেও তত্ত্ব আর তথ্য নিয়ে উত্তেজিত হয়ে পড়াশোনার গল্প করত—সে কোথায় হারিয়ে গেল? মাঝে মাঝে কেউ কেউ বলত, “এই পড়ে কী হবে? চাকরি তো নেই, সংসারের দিকেই মন দাও।”

আরও পড়ুন- স্বাধীনতার গল্প : মিছিল

তাঁরা জানত না—আমার পড়াটাই ছিল বেঁচে থাকার শেষ আশ্রয়। রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে আমি আলো জ্বেলে পড়তাম। সেই নিঃশব্দ ঘরে শুধু বইয়ের পাতার শব্দ থাকত, আর থাকত আমার বুকের ভিতরের এক ঝলক আশা। চুপচাপ একদিন নেট-জেআরএফ-এর ফর্ম পূরণ করলাম। কারও সঙ্গে আলোচনা করিনি, বলার মতো জায়গা ছিল না। শুধু জানতাম—নিজের জন্য একটা পথ খুঁজে পেতে হবে।

তারপর একদিন—ভরদুপুর। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল। উল্টো দিক থেকে স্বামীর গলা—উত্তেজনায় কাঁপছে, বলল, “তুই নেট পেয়েছিস! নেট-জেআরএফ, ফুল ফেলোশিপ!” মাথার ভিতরটা যেন থমকে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল কেউ যেন অনেক বছর পরে এসে বলে গেল—“তুই পারিস। তোকে কেউ আটকাতে পারবে না।” ক'দিন পর মোবাইলে একটা মেসেজ, “INR 22,000 credited to your account.” তেমন কিছু নয়—কয়েকটা সংখ্যা, কয়েকটা ইংরেজি শব্দ। কিন্তু আমার কাছে সেটা ছিল ঘোষণা। একটা যুদ্ধের জয়। একটা জীবন ফিরে পাওয়া। সেই দিনটা ১৫ অগাস্ট ছিল না, কোনো জাতীয় উৎসবও ছিল না। তবু আমার কাছে সেটাই ছিল আমার স্বাধীনতা দিবস। কারণ সেদিনই প্রথম বুঝেছিলাম—আমি আর কারও মুখ চেয়ে চলতে বাধ্য নই। আমি নিজের জন্য ভাবতে পারি, নিজের স্বপ্নের দাম দিতে পারি।

আরও পড়ুন- স্বাধীনতার প্রথম স্বাদ : বন্ধুদের সঙ্গে প্রথম শান্তিনিকেতন ঘুরতে যাওয়া

সেই টাকায় প্রথম আমি কিনেছিলাম একটা মেঠো গোলাপি রঙের লিপস্টিক। আর একটা সবুজ কালি ভরা কলম। আর একটা বই—সুকুমারী ভট্টাচার্যের লেখা। অনেকের কাছে হয়তো তুচ্ছ জিনিস। কিন্তু আমার কাছে সেদিন সেগুলো ছিল নিজের অস্তিত্বের স্বীকৃতি। কারণ এই প্রথম, আমি কোনও কিছু কিনেছি নিজের জন্য, নিজের টাকায়, নিজের ইচ্ছেতে।

আজ আমি গবেষক, শিক্ষক, লেখক। বহু সম্মান পেয়েছি, অনেক বেশি আয় করি। তবু আজও যখন ব্যাঙ্ক থেকে কোনও মেসেজ আসে, আজও মনে পড়ে সেই প্রথম মেসেজের কথা। কারণ, ওটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম নীরব, অথচ প্রবল শক্তিশালী স্বাধীনতার বার্তা।

More Articles