এই নারীই ছিলেন দুনিয়ার প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার
সবাই ছকে বাঁধা জীবন যাপন করবেন, সেটা হয় না। কেউ কেউ এমনও থাকেন যাঁরা ছক ভেঙে নিজের মত করে জীবন যাপন করতে চান, তথাকথিত পুরুষদের বিষয় নিয়ে গবেষণা করতে চান। আজকে সে রকম একজন নারীর কাহিনি শোনাব।
তাঁর নাম আডা লাভলেস। লাভলেস হলেন বিশ্বের সর্বপ্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার। এখনকার দিনে একজন শিশুকে জিজ্ঞেস করলেও সে বলবে, কম্পিউটারের জনকের নাম স্যার চার্লস ব্যাবেজ। কিন্তু ব্যাবেজের এই অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিন তৈরির জন্য আসল মেধা খরচ করেছিলেন আডা লাভলেস। শুধুমাত্র একজন কম্পিউটার প্রোগ্রামার নয়, তিনি জনপ্রিয় রোমান্টিক কবি লর্ড বায়রনের পরিতক্ত কন্যাও বটে। শুধুমাত্র তাঁর পিতা নয়, তাঁকে সমাজও মনে রাখেনি। জন্মের ২০৬ বছর পরেও প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার হিসেবে তিনি কোনও শিরোপা পেলেন না।
কিন্তু তিনি যে অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিন তৈরি করার জন্য অংক করতেন সেরকম কিন্তু নয়। বরং বলতে গেলে তিনি, অংক কষতে অত্যন্ত ভালবাসতেন। অনেকেই এমন আছেন যারা গণিত বিষয়টিকে অত্যন্ত ভয় করেন, কিন্তু লাভলেস এরকম ছিলেন না। তিনি মাঝেমধ্যেই অংক কষতে কষতে একেবারে বিভোর হয়ে যেতেন। অনেক সময় এমন হয়েছে তিনি অংক কষতে কষতে নিজের ছেলে মেয়েকে স্কুল বাস থেকে নামাতে ভুলে গেছেন। তার যখন মাত্র ১২ বছর বয়স তখন তিনি পাখিদের সাথে আকাশে উড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু, মানুষ কেন উড়তে পারে না, সেই সমস্যাটিকে তিনি অংক কষে বুঝতে চেয়েছিলেন। পাখিদের পর্যবেক্ষণ করে, পালক, কাগজ সিল্কের মতো বিভিন্ন জিনিস ব্যবহার করে এবং সর্বোপরি পাখিরা কেন উড়তে পারে সেই নিয়ে গবেষণা করেছিলেন তিনি।
আডার জন্মের মাত্র ৫ মাসের মধ্যেই তার মা অ্যানাবেল বায়রন তাকে নিয়ে তার পিতা লর্ড বায়রনের থেকে আলাদা হয়ে যান। তার পিতা লর্ড বায়রন তার মা কে বিয়ে করেছিলেন কার্যত বাধ্য হয়ে। বিয়ের পর থেকেই তার অনেক মহিলার সঙ্গে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। মেয়ের ওপর যাতে তার বাবার কু প্রভাব না পড়ে, তার জন্যই তার মা অ্যানাবেল বায়রন মেয়েকে নিয়ে আলাদা হয়েছিলেন। প্রথম থেকেই লাভলেসের মা তাকে গণিত, বিজ্ঞান এবং যুক্তির মাঝেই বড় করেছিলেন। ছোটবেলা থেকেই আডা লাভলেসের মেশিনের প্রতি একটা আসক্তি ছিল। নিত্য নতুন মেশিন তৈরি করা, সেটার যন্ত্রপাতি খুঁটিয়ে দেখা, ফ্লাইং মেশিন তৈরি করা, বিভিন্ন ধরনের আকার আকৃতি তৈরি করা, সাইন্স ম্যাগাজিন পড়া, এই সমস্ত ছিল তার ছোটবেলার কিছু শখ এর মধ্যে অন্যতম।
১৯ বছর বয়সে তিনি উইলিয়াম কিং নামের একজন আরিস্টোক্রাটকে বিয়ে করেন। তারপরে, ১৮৩৮ সালে যখন উইলিয়াম কিং লাভলেস এলাকার আর্ল হিসেবে নির্বাচিত হন, তারপর থেকে আডার নাম হয়ে যায় লেডি আডা কিং, কাউন্টেস অফ লাভলেস। আদতে তারপর থেকেই আডা পরিচিত হতে শুরু করেন আডা লাভলেস হিসেবে।
তাঁর জীবনের মোড় ঘোরে যখন ১৮৩৩ সালে লাভলেসের মেন্টর, বিজ্ঞানী ম্যারি সোমারভিল তাকে চার্লস ব্যাবেজ এর সঙ্গে পরিচয় করান। ব্যাবেজ ছিলেন গণিতের লুকেসিয়ান অধ্যাপক যিনি নিজের অসাধারণ দার্শনিক দক্ষতা এবং গণিতের উপর অগাধ পান্ডিত্যের জন্য জনপ্রিয় ছিলেন। ব্যাবেজ এর সঙ্গে পরিচিত হয়ে আডা লাভলেস ব্যবজের পরিকল্পনা নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করেন। ব্যাবেজ সেই সময় একটি অত্যন্ত জটিল ইঞ্জিন তৈরি করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন, যার নাম ছিল বিখ্যাত অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিন। এই ধরনের ইঞ্জিন আগে কখনো তৈরি করা হয়নি, কিন্তু এই ইঞ্জিনটিতে আজকের যুগের কম্পিউটারের সমস্ত উপাদান মজুদ ছিল।
১৮৪২ সালে লাভলেস একটি ছোট আর্টিকেল লিখেছিলেন সেই বিখ্যাত অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিনের ব্যাপারে। ইতালির গণিতজ্ঞ লুইগী মেনাব্রিয়ার মাধ্যমে তিনি এই আর্টিকেলটি ইংল্যান্ডে প্রকাশ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। সেই আর্টিকেল প্রকাশের সময় চার্লস ব্যাবেজ তাকে ওই আর্টিকেলটির ব্যাপারে বিস্তারিত ভাবে ব্যাখ্যা করতে বলেন। এই আর্টিকেলটিতে কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের ব্যাপারে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা ছিল। সিম্বলের পরিবর্তিত ব্যবহার, সুর তৈরি থেকে শুরু করে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং এর আরো বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা ছিল এই আর্টিকেলে।
যদিও চার্লস ব্যাবেজ এবং তার সহকারীরা এই এনালিটিক্যাল ইঞ্জিন এর সমস্ত প্ল্যানিং আগেই তৈরি করে ফেলেছিলেন, কিন্তু লাভলেসের প্লানিং ছিল আরও সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করা এবং আরও গভীর। এই কারণেই চার্লস ব্যাবেজ নিজেদের প্ল্যান পরিবর্তন করে লাভলেসের প্ল্যান নিয়ে অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিন তৈরি করেছিলেন। এই কারণেই লাভলেস বিশ্বের সর্বপ্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার হিসেবে চিহ্নিত হন। চার্লস ব্যাবেজ নিজেও বারংবার লাভলেসের গণিতের প্রতি অসাধারণ পাণ্ডিত্যের প্রশংসা করেছেন। মেশিনের প্রতি তার ভালোবাসার এবং অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিন তৈরির জন্য পরিশ্রমের কথা বার বার উল্লেখ করেছেন চার্লস ব্যাবেজ।
মাত্র ৩৬ বছর বয়সে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে এই মহান গণিতজ্ঞের জীবনাবসান হয়। তার মৃত্যুর মাত্র বছর কয়েক আগেই প্রকাশিত হয়েছিল এনালিটিক্যাল ইঞ্জিন তৈরি নিয়ে লেখা সর্বপ্রথম বই 'স্কেচ অফ দা অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিন'। এই বইতে লাভলেস লিখে গিয়েছিলেন, কিভাবে বিশ্বের সর্বপ্রথম কম্পিউটার ইঞ্জিন তৈরি হয়েছিল এবং কিভাবে তিনি তৈরি করে ফেলেছিলেন বিশ্বের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রাম। লাভলেসের তৈরি করা এই এনালিটিক্যাল ইঞ্জিনের প্রোগ্রাম ব্যাবেজ এর সময় খুব একটা কাজে আসেনি। কিন্তু, ১৯৪০ সালে অ্যালেন টিউনিং যখন প্রথমবার আধুনিক কম্পিউটারের একটা ব্লু প্রিন্ট তৈরি করেন, তখন থেকেই বিশ্বের কাছে লাভলেসের কাজের গুরুত্ব প্রকাশিত হতে শুরু করে। লাভলেস হয়তো খুব একটা বেশি দিন বাঁচতে পারেননি। কিন্তু বিজ্ঞানের প্রতি তার আগ্রহ, প্রযুক্তির প্রতি তার অমোঘ আকর্ষণ, এবং দূরদর্শীতার কারণে তিনি হয়ে উঠেছিলেন প্রযুক্তির ইতিহাসে সবথেকে আধুনিক মহিলাদের মধ্যে একজন।