তিন তিনবার বিশ্বকাপ জয়! ফিরে দেখা 'হ্যাট্রিকের রাজা' পেলের জীবনের সেরা ম্যাচগুলি

Pele Passes Away: মাত্র ১৭ বছর ২৪৯ দিন বয়সে টুর্নামেন্টে ছয়টি গোল করে সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন পেলে।

জীবনাবসান হলো বিশ্ব ফুটবলের প্রথম মহাতারকা পেলের। মৃত্যুকালে এই কিংবদন্তির বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। তিনবারের বিশ্বকাপ জয়ী বিশ্বের একমাত্র ফুটবলার প্রয়াত হলেন ২০২২ কাতার বিশ্বকাপের ঠিক পরেই। তিনি বহুদিন ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন বলে পরিবার সূত্রে খবর। ২০২১ সাল থেকেই অন্ত্রের ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন পেলে। কাতার বিশ্বকাপের সময় শারীরিক অবসর অবনতি হওয়ায় ২৯ নভেম্বর তাঁকে সাও পাওলোর অ্যালবার্ট আইনস্টাইন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ বছরের বিশ্বকাপ ফুটবল তিনি হাসপাতাল থেকেই দেখেছিলেন। বিশ্বকাপ ফাইনালে মেসির বিশ্বজয় দেখে শুভেচ্ছা বার্তাও পাঠিয়েছিলেন তিনি। সঙ্গে স্মরণ করেছিলেন আরেক কিংবদন্তি দিয়েগো মারাদোনাকেও।

তবে গত ২২ ডিসেম্বর ক্যান্সারের প্রকোপ হঠাৎ বেড়ে যায়। ডাক্তারদের পরামর্শ মেনে আর বাড়ি ফেরা হয়নি। বড়দিনে এবছর হাসপাতালেই কাটিয়েছিলেন পেলে। বিছানায় অসুস্থ বাবাকে জড়িয়ে ধরে গণমাধ্যমে ছবি পোস্ট করেছিলেন পেলের কন্যা কেলি। পাশাপাশি, গত শনিবার হাসপাতালে পৌঁছে গিয়েছিলেন তাঁর ছেলে এডিসন। গত কয়েকদিন ধরে পরিবারের লোকজন হাসপাতালে তাঁর পাশে ছিলেন সবসময়। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলো না। ডাক্তাররা আর সুস্থ করে তুলতে পারলেন না ফুটবল সম্রাটকে। ক্যান্সারের প্রভাবেই ৩০ ডিসেম্বর ভারতীয় সময় রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চিরনিদ্রার দেশে চলে গেলেন পেলে।

ফিফা ম্যাগাজিনের পাঠক এবং ফিফার জুরি বোর্ডের বিচারে তিনি হলেন বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ফুটবলার। সাধারণ ফুটবলপ্রেমীরা অবশ্য মারাদোনার দিকে ভোট দিলেও, ফিফার বিচারে অবশ্যই পেলে এগিয়ে। শেষ পর্যন্ত দু'জনকেই শতাব্দীর সেরা ঘোষণা করা হয় ফিফার পক্ষ থেকে। মারাদোনা ২০২০ সালে ৬০ বছর বয়সে প্রয়াত হন। আর ৮২ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন পেলে। তাঁর মৃত্যুতে গভীরভাবে শোকাহত ফুটবল বিশ্ব। মেসি, নেইমার থেকে শুরু করে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো সকলেই সামাজিক মাধ্যমে জানিয়েছেন শ্রদ্ধার্ঘ্য। ইনস্টাগ্রামে পেলের মেয়ে লিখেছেন, "আমরা যা কিছু হয়েছি, সেটা তোমার জন্য। তোমায় অপরিসীম ভালোবাসি। শান্তিতে ঘুমাও।"

আরও পড়ুন- স্তব্ধ হল শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়ের জীবন! যে কারণে পেলে আসলে অমর…

পেলের জন্ম

১৯৪০ সালের ২৩ অক্টোবর ব্রাজিলের ট্রেস কোরাসোয়েসে জন্মগ্রহণ করেছিলেন পেলে। এই শব্দটির অর্থ, তিনটি হৃদয়। জন্মের সময়ে তাঁর বাবা পেলের নাম দিয়েছিলেন এডসন আরন্তেস দি নাসিমেন্তো। সে নামে অবশ্য বিশ্ব তাঁকে চেনেনি। বাবার থেকেই রক্তে ফুটবল এসেছিল ফুটবল সম্রাটের। পেলের বাবা আধা পেশাদারি ফুটবল লিগে খেলতেন বহু বছর ধরে। তবে হাঁটুর চোটের কারণে খেলা বন্ধ করতে হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু বাবা সব সময় চেয়েছিলেন নিজের ছেলেও ফুটবলারই হোক।

ফুটবল বিশ্বে আবির্ভাব

পেলের বয়স যখন মাত্র ১৫ বছর, তখন ব্রাজিলের ক্লাব স্যান্টোসে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। এই ক্লাবে দীর্ঘ ১৮ বছর কাটিয়েছিলেন পেলে। জিতেছিলেন সমস্ত ট্রফি। তার মধ্যেই স্যান্টোসে যোগ দেওয়ার কারণে পেলের প্রতিভা জাতীয় দলের নজরে পড়তে শুরু করেছিল। ব্রাজিলের জাতীয় দলের কোচ নিজেই পেলেকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই ব্রাজিলের জার্সিতে ফুটবল বিশ্বকাপে খেলেছিলেন পেলে। বয়সের কারণে দলের এক মনোবিদ তাঁকে না খেলানোর কথা বলেছিলেন। তবে, সেই ১৯৫৮ বিশ্বকাপেই পেলে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, কোন প্রতিভাকে আগামীতে সেলাম করবে বিশ্ব।

পেলের সেরা ম্যাচ

১. ১৯৫৮ ফিফা বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল, ব্রাজিল ৫-২ ফ্রান্স

মাত্র ১৭ বছর বয়সে ১৯৫৮ বিশ্বকাপে আবির্ভাব ঘটেছিল ব্রাজিলের এই মহাতারকার। সুইডেনের মাটিতে সে বছরের বিশ্বকাপে পেলে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি শিশু নন। তাঁর সঙ্গে যারা খেলতে আসছেন, তাঁদেরকেও ঘোল খাইয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন তিনি। সেমিফাইনালে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিক করে সকলকে একেবারে অবাক করে দিয়েছিলেন পেলে। সেই সেমিফাইনালে পেলের প্রথম দু'টি গোল ক্লোজ রেঞ্জ থেকে এলেও, তৃতীয় গোলটি ছিল একেবারে বিশ্বমানের।

গোলপোস্টের ১৮ গজ দূর থেকে তেকাঠির একেবারে বটম লেফট কর্ণারে মেপে শট নেওয়া সহজ কাজ নয়। বিশেষ করে যখন ফ্রান্সের মতো একটি রক্ষণশীল ফুটবল খেলা দল উল্টোদিকে খেলছে। কিন্তু, অবলীলায় সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেন পেলে। তিনি নিজের জীবনে সাতটি হ্যাটট্রিক করেছেন ব্রাজিলের জন্য। তবে এটাই ছিল তাঁর জীবনের প্রথম হ্যাটট্রিক, যার দৌলতে তিনি সেলেকাওদের ফাইনালে নিয়ে গিয়েছিলেন।

২. ১৯৫৮ ফিফা বিশ্বকাপ ফাইনাল ব্রাজিল ৫-২ সুইডেন

সেমিফাইনালে দুর্দান্ত প্রদর্শনের পর, স্বাভাবিকভাবেই পেলের উপরে ভরসা জন্মে গিয়েছিল ব্রাজিলের সমর্থকদের। তবে, সেমিফাইনাল ছিল শুধু ট্রেলার। আসল সিনেমা পেলে দেখিয়েছিলেন ফাইনালের মঞ্চে। সেই ম্যাচে প্রথমার্ধ্বে ব্রাজিলের কিংবদন্তি ফুটবলার ভাভা ২টি গোল করে ২-১ ব্যবধানে এগিয়ে দিয়েছিলেন ব্রাজিলকে। কিন্তু, তৃতীয় গোলটি করার সময় পেলে যে স্কিল প্রদর্শন করেছিলেন তার হয়তো কোনওদিন কোনও তুলনাই হবে না। ডিফেন্ডারের উপর দিয়ে বল ফ্লিক করে পেনাল্টি এরিয়াতে ঢুকে পড়ে গোলকিপার কল্লি স্বেনসনকে ডজ করে সোজা গোলপোস্টের একেবারে বটম কর্ণারে শট রেখেছিলেন এই ১৭ বছরের ফুটবলার। সেই বয়সে এটি শিল্পের থেকে কম কিছু নয়।

এই বিশ্বমানের গোলের কারণে পেলে হয়েছিলেন ফিফা বিশ্বকাপ ফাইনালের ইতিহাসে গোল করা কনিষ্ঠতম ফুটবলার। মাত্র ১৭ বছর ২৪৯ দিন বয়সে টুর্নামেন্টে ছয়টি গোল করে সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন পেলে। সেই বিশ্বকাপে ১৩ টি গোল করে ফ্রান্সের ফুটবলের ফন্টেইন সেরা গোল স্কোরার হলেও, পেলের পায়ের জাদুতে সে বছর বিশ্বকাপ জিতেছিল ব্রাজিল।

৩. ১৯৬২ ইন্টার কন্টিনেন্টাল কাপ ফাইনাল, সেকেন্ড লেগ, বেনফিকা ২-৫ স্যান্টোস

১৯৬২ বিশ্বকাপে চোটের কারণে কয়েকটি ম্যাচেই দেখা গিয়েছিল পেলেকে। তবে তার তিন মাস পরে ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বর অক্টোবর মাসে, আবারও পেলে দেখিয়েছিলেন তাঁর জাদু। এখন যেমন ইউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ এবং কনমেবলের চ্যাম্পিয়নদের মধ্যে ফিনালিসিমা খেলা হয়, সেরকম ভাবেই আগে ইউরোপিয়ান কাপ এবং কোপা লিবেরতাদোর্সের মধ্যে ইন্টার কন্টিনেন্টাল কাপ প্রতিযোগিতা হতো। তবে, দু'টির মধ্যে একটু ফারাক রয়েছে। ফিনালিসিমা একটি জাতীয় টুর্নামেন্ট। সেখানে ফুটবলাররা নিজের দেশের হয়ে খেলতে আসেন। অন্যদিকে ইন্টার কন্টিনেন্টাল কাপ ছিল একটি ক্লাব লেভেলের টুর্নামেন্ট। আর সেবছর ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপের ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল ব্রাজিলের স্যান্টোস এবং পর্তুগালের বেনফিকা।

প্রথমেই ঘরের মাঠে প্রথম লেগে ৩-২ ব্যবধানে এগিয়ে ছিল স্যান্টোস। তবে দ্বিতীয় লেগে পেলে আবারও নিজের সেরা পারফরমেন্স দেখালেন। বেনফিকার ডিফেন্সকে চুরমার করে পরপর তিনটি গোল দিয়ে হ্যাটট্রিক করেন পেলে। প্রথম লেগের শেষ গোল এবং দ্বিতীয় লেগের ২টি গোল দিয়ে সম্পূর্ণ হয়েছিল পেলের হ্যাটট্রিক। ম্যাচের শেষে বেনফিকার গোলকিপার কোস্টা পেরেরা বলেছিলেন, "আমরা এমন একজন মানুষের সঙ্গে খেলছিলাম, যিনি এই গ্রহের মানুষই নন। তার স্কিল সত্যিই দেখবার মতো।" পর্তুগিজ সংবাদপত্রে ২০২২ সালে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে বেনফিকার ফুটবলার আন্তনীয় সিময়েস বলেছিলেন, "এখনও যদি কেউ আমাকে জিজ্ঞাসা করে, কে সর্বকালের সেরা ফুটবলার, বা কে আপনার জীবনে দেখা সেরা খেলোয়াড়, আমি অবশ্যই নাম নেব পেলের। তার মতো ফুটবলার, আমি আমার জীবনে আর দেখিনি। সেবছর ইউরোপিয়ান কাপে বেনফিকা ছিল সেরা দল। তবে স্যান্টোস ছিল বিশ্বসেরা।"

আরও পড়ুন- অভিনয় অথবা লেখালিখি সবেতেই দক্ষ পেলে, ফুটবল সম্রাটের জীবনের যে সত্য অনেকেরই অজানা

৪. ১৯৬৩ রোকা কাপ, ব্রাজিল ৫-২ আর্জেন্টিনা

১৯৬৩ সালে ব্রাজিলের রাজধানীর রিও ডি জেনিরোতে আয়োজিত রোকা কাপে আবারও হ্যাট্রিক করেছিলেন পেলে। এই রোকা কাপ আয়োজন করা হতো লাতিন আমেরিকার এই দুই দলের মধ্যেই। ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনার মধ্যে খেলা এই প্রতিযোগিতা দেখার জন্য অপেক্ষা করে থাকতেন দুই দেশের লক্ষ লক্ষ ফুটবলপ্রেমী। ১৯৬৩ সালের এই রোকা কাপের মোকাবিলায় শেষ হাসি হেসেছিলেন পেলে। চোট থাকলেও সেদিন পেলে যেন মহামানব হয়ে উঠেছিলেন চির প্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে।

একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায়, সেদিন ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনার মধ্যে এই ম্যাচ দেখতে মাঠে উপস্থিত হয়েছিলেন ১ লক্ষ ৩০ হাজার দর্শক। রোকা কাপের এই দ্বিতীয় লেগে হ্যাট্রিক করেছিলেন পেলে। এর মধ্যে যদিও দু'টি গোল পেনাল্টি থেকে এসেছিল, তবে দু'বারই পেনাল্টি বক্সের ভিতরে ধাক্কা দেওয়া হয়েছিল পেলেকেই। ম্যাচটি ৫-২ ব্যবধানে শেষ হলো এবং শেষ পর্যন্ত পেলেই হলেন এই টুর্নামেন্টের ম্যান অব দ্যা সিরিজ।

৫. ১৯৭০ ফিফা বিশ্বকাপ ফাইনাল ব্রাজিল ৪-১ ইতালি

১৯৬৬ বিশ্বকাপে পেলের চোটের কারণে ইংল্যান্ডের কাছে পরাজিত হতে হয়েছিল ব্রাজিলকে। সেই বিশ্বকাপে খুব কম ম্যাচ খেলতে পেরেছিলেন পেলে। সেই সুযোগই গ্রহণ করে ইংল্যান্ড এবং বিশ্বকাপ জয় করেন জিওফ্রে হার্স্ট। চার বছর পর ১৯৭০ বিশ্বকাপে জুলে রিমে ট্রফি আবারো নিজের হাতে তোলার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন পেলে। পুরো টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত পারফরমেন্সের পর মেক্সিকো সিটির অ্যাজটেকা ময়দানে আজ্জুরিদের বিরুদ্ধে ফাইনালি মুখোমুখি হয়েছিল পেলের ব্রাজিল।

গ্রুপ স্টেজে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে পরাজিত করে চ্যালেঞ্জ সম্পূর্ণ করে দিয়েছিলেন পেলে। বাকি ছিল বিশ্বকাপ জয়ের চ্যালেঞ্জটা। সেটাও নিজের অমায়িক ভঙ্গিতে পূরণ করে ফেলেন তিনি। বার পোস্টের দিকে দুর্দান্ত হেডার নিয়ে ব্রাজিলকে প্রথমেই এগিয়ে দেন পেলে। এরপর জাইরজিনিওকে দুর্দান্ত অ্যাসিস্ট করে পরের গোলে নিজের নাম খোদাই করেন ফুটবল সম্রাট। শেষে কারলোস আলবার্তোর গোলে ইতিহাস রচনা করে ব্রাজিল।

 

More Articles