স্তব্ধ হল শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়ের জীবন! যে কারণে পেলে আসলে অমর...
Pelé Passes Away: পেলে মূলত পছন্দ করতেন ‘জিঙ্গা’ স্টাইল ফুটবল খেলতে। এটি লাতিন আমেরিকার অত্যন্ত প্রাচীন একটি পদ্ধতি।
কিছু কিছু ঘটনা ঘটে যায় যার কোনও ব্যাখ্যা হয় না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে অদৃষ্টের দিকে চেয়ে থাকতে হয়। ঠিক যেমনটা হলো কিছুক্ষণ আগে। প্রয়াত এডসান আরেন্টস ডি'নাসিমেন্টো যাঁকে গোটা বিশ্ব চেনে ‘পেলে’ নামে। বেশ কিছু দিন আগেই হার্টের সমস্যা ও শরীর ফুলে যাওয়ায় সাও পাওলোর একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল পেলেকে। পেলের সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্ত্রী মার্সিয়া আওকি এবং এক জন আয়া। বছরের শেষ প্রান্তে এসে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি। বৃহস্পতিবারই জানা গিয়েছিল, পেলের শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হচ্ছে। তার ঠিক দিন কয়েক আগেই হেল্থ বুলেটিন জারি করে ডাক্তাররা জানিয়েছিলেন, ভয়ের কোনও কারণ নেই। বিশ্বকাপ চলাকালীন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে ব্রাজিল দলকে শুভেচ্ছাও জানিয়েছিলেন পেলে। ঘনিষ্ঠ মহল থেকে জানা যায় ফাইনাল দেখতে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল তাঁর। ফাইনাল দেখেওছেন, আর্জেন্টিনার জয় প্রত্যক্ষ করেছেন। বিশ্বকাপ সাঙ্গ হয়েছে, ফুটবলের আকাশ থেকে নিভে গিয়েছেন বিশ্বের কিংবদন্তি এক নক্ষত্র, চলে গিয়েছেন বিশ্ব ফুটবলের জাদুকর। দীর্ঘ দিন ধরে মলাশয়ের ক্যানসারে আক্রান্ত পেলে। গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে অপারেশন করা হয়েছিল তাঁর। অপারেশন সফল হয়। ডাক্তাররা জানিয়েছিলেন অপারেশন ভালো হয়েছে এবং কেমোথেরাপি নিচ্ছেন পেলে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে জানা যায় আর কেমো নিতে পারছেন না পেলে। অতঃপর আজ ৮২ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন বিশ্ব ফুটবলের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়।
কিছু কিছু মানুষ থাকেন যাঁদের নামে একটা আস্ত দেশ পরিচয় পায়, একটা জাতি পরিচয় পায়। পেলে এমনই একজন মানুষ। বিশ্ব ফুটবলে আজকে ব্রাজিলের যা 'ক্রেজ', তার নেপথ্যে রয়েছেন পেলে। পৃথিবীতে অনেক মানুষই আছেন যারা ফুটবল দেখেন না, বোঝেন না। কিন্তু পেলের নাম শোনেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই বিশ্ব ফুটবলে আবির্ভাব ঘটিয়েছিলেন পেলে। ১৯৫৮ বিশ্বকাপে আবির্ভাব লগ্নেই ৪ ম্যাচে ছয়টি গোল করে নিজের আবির্ভাব জানান দিয়ে দেন পেলে। ব্রাজিলীয় ফুটবলের আঁতুড় ঘর স্যান্টোস থেকে উত্থান তাঁর। প্রথম বিশ্বকাপেই গোল করেছিলেন তিনি। আর কেরিয়ার যখন শেষ করেছেন তখন তাঁর ক্যাবিনেটে তিন তিনটে বিশ্বকাপ! নিজের জীবনের মোট চারটি বিশ্বকাপে (১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৭০) তিনটেই জিতেছেন তিনি। ক্লাব এবং দেশের হয়ে খেলেছেন ১৩০০-র বেশি ম্যাচ, করেছেন ১২০০-র বেশি গোল।
আরও পড়ুন- অভিনয় অথবা লেখালিখি সবেতেই দক্ষ পেলে, ফুটবল সম্রাটের জীবনের যে সত্য অনেকেরই অজানা
১৯৪০ সালের ২৩ অক্টোবর ব্রাজিলের এক ছোট্ট গ্রাম, ত্রেস করোকায়েসে জন্ম পেলের। বাবা ছিলেন একজন কারখানার শ্রমিক। পেটের টানে কারখানায় কাজ করতে হলেও তিনি ফার্স্ট ক্লাস লেভেল ফুটবল খেলেছিলেন। পেলের জীবনের প্রথম ফুটবল কোচও তিনিই। ছোটবেলায় যখন নিজের গ্রামে পেলে খেলে বেড়াতেন, তখন সেই খেলা দেখেই বোঝা গিয়েছিল এই ছেলে অনেক দূর যাবে। পেলে মূলত পছন্দ করতেন ‘জিঙ্গা’ স্টাইল ফুটবল খেলতে। এটি লাতিন আমেরিকার অত্যন্ত প্রাচীন একটি পদ্ধতি। স্কুল লেভেলে এই পদ্ধতিতে খেললেও যখন স্যান্টোস ক্লাবে তিনি যোগ দেন তখন দেখা দেয় সমস্যা। সেখানকার কোচ প্রথমে রাজি না থাকলেও, তিনি বুঝতে পারেন পেলেকে পেলের মতোই খেলতে দেওয়া উচিত। ফল মেলে হাতে নাতে। এরপর থেকে গোটা দল জিঙ্গা স্টাইল ফুটবল খেলা শুরু করে। জিঙ্গার প্রথম স্তর হল হল মার্শাল আর্ট আর দ্বিতীয় স্তর হল সাম্বা। সাম্বা এমন একটা নাচ, যেখানে শরীর সোজা রেখে পায়ের প্রায় প্রতিটা অংশ দিয়ে নানারকম কারুকাজ করা হয়। ফুটবলের ড্রিবলিংও তো তাইই! ছোটবেলা থেকেই এই বিষয়টি খুব ভালো করে রপ্ত করেছিলেন পেলে। যার সরাসরি বহিঃপ্রকাশ তিনি ঘটান ১৯৫৮-র ফুটবল বিশ্বকাপে।
জীবনের প্রথম বিশ্বকাপের প্রথম গোলটি পেলে করেছিলেন কোয়ার্টার ফাইনালে। ১৯৫৮ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে করেন হ্যাটট্রিক। তিনিই বিশ্বকাপ ফুটবলের সর্বকনিষ্ঠ হ্যাটট্রিক অধিকারী। এরপর ফাইনালে সুইডেনের বিরুদ্ধে আরও দু'টি গোল করেন পেলে। ফলত, ১৯৫৮ বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। ১৯৬২ বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই ব্রাজিলের হয়ে গোল করেন পেলে। কিন্তু সেই ম্যাচে চোট পেয়ে গোটা টুর্নামেন্টের জন্যই অনিশ্চিত হয়ে পড়েন তিনি। তবে পেলে ফিরেছিলেন রাজার মতো। সেই বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচে কামব্যাক করেছিলেন পেলে। ফাইনালে চেকোস্লোভাকিয়াকে ৩-১ গোলে হারিয়ে দ্বিতীয় বার বিশ্বকাপ তোলে ব্রাজিল। কিন্তু এর পরের বিশ্বকাপ অর্থাৎ ১৯৬৬ বিশ্বকাপ, পেলের জীবনের অন্যতম খারাপ বিশ্বকাপ। সেবার টানা তিনবার বিশ্বজয়ের লক্ষ্যে নেমেছিল ব্রাজিল। প্রথম ম্যাচে বুলগেরিয়াকে ২-০ গোলে উড়িয়েও দেয় সেলেকাওরা। গোল পান পেলেও। কিন্তু এরপরই ঘটে বিপর্যয়। প্রথমে হাঙ্গেরি (৩-১) এবং তারপর পর্তুগালের (৪-৩) কাছে হেরে বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিতে হয় ব্রাজিলকে। পরবর্তীকালে এক সাক্ষাৎকারে পেলে জানিয়েছেন, “১৯৬৬ বিশ্বকাপে আমরা প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। আর সেটাই ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে খারাপ বিশ্বকাপ। কিন্তু বিশ্বকাপে ওরকম বিশ্রি পারফরমেন্সের পর আমি নিজেই প্রচণ্ড হতাশ হয়ে পড়ি। এক প্রকার ঠিক করেই নিয়েছিলাম আর কোনদিনও ব্রাজিলের জার্সি গায়ে খেলব না। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তকে বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে দিইনি।”
আরও পড়ুন-‘দিয়েগো নিশ্চয়ই এখন হাসছে’, মেসিদের বিশ্বজয়ে যে ভাবে আবেগে ভাসলেন পেলে
এরপর আসে ১৯৭০। জীবনের শেষ বিশ্বকাপ খেলতে নামছিলেন পেলে। সেবারও দুরন্ত পারফর্ম করেন তিনি। ৬ ম্যাচে ব্রাজিলের হয়ে ৪ গোল করেছিলেন পেলে। ফাইনালে ববি মুরের ইংল্যান্ডকে হারিয়ে তৃতীয়বারের জন্য বিশ্বকাপ ঘরে তোলেন তিনি। বিশ্বকাপে মোট ১৬ ম্যাচে ১২টি গোল করেছেন পেলে৷ এরপর ১৯৭১ সালে, দেশের জার্সিতে শেষ ম্যাচ খেলে আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর গ্রহণ করেন পেলে। সেই ম্যাচ দেখতে স্টেডিয়ামে ভিড় করেছিলেন লক্ষাধিক মানুষ। নিজের সম্পূর্ণ আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে পেলে পাশে পেয়েছেন গ্যারিঞ্চা, ভাভা, ডিডি, জিটোদের মত তারকাদের।
ক্লাব ফুটবলেও যথেষ্ট বড় নাম পেলে। ১৯৫৬ সালে কিশোর বয়সে স্যান্টোস ক্লাবের হয়ে ক্লাব ফুটবলে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। স্যান্টোসের হয়ে খেলেছিলেন প্রায় কুড়ি বছর! স্যান্টোসের হয়ে সুদীর্ঘ কুড়ি বছরে ৬৩৬ ম্যাচে করেছেন ৬১৪ গোল। ১৯৬২ এবং ১৯৬৩ সালে স্যান্টোসকে ক্লাব বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন করেন তিনি। প্রায় দু-দশক কাটিয়ে, ১৯৭৫ সালে যোগদান নিউইয়র্ক কসমস ক্লাবে। ১৯৭৫-৭৭ পর্যন্ত সেই ক্লাবের হয়ে খেলেন তিনি। ১৯৭৭ সালে কসমস ক্লাব থেকেই অবসর গ্রহণ করেন পেলে। এই সময় ভারতেও খেলতে এসেছিলেন পেলে। ফুটবল থেকে অবসর নেওয়ার পরেও ফুটবলের উন্নতিকল্পে বিভিন্ন কাজ করে গেছেন পেলে। ফুটবলের পাশাপাশি হলিউডের বেশ কয়েকটি সিনেমায় ক্যামিও রোলেও তাঁকে দেখা গিয়েছে। ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত ব্রাজিলের ক্রীড়ামন্ত্রীর দায়িত্বও সামলেছেন পেলে। ২০০০ সালে তাঁকে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়ের খেতাব দেওয়া হয়। ২০১৬ সালে পেলের বায়োপিকও তৈরি হয়েছে হলিউডে। সেখানেও একটি ছোট্ট চরিত্রে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। এইভাবেই পেলে আজও বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাসে এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে আছেন। যতদিন মানুষ ফুটবল খেলবে, ফুটবলের অস্তিত্ব থাকবে, ততদিন পেলেকে আমরা মনে রাখব। পেলের মতো ব্যক্তিত্বের মৃত্যু হলেও, তাঁরা কখনই চিরকাল হারিয়ে যান না।