ভারাক্রান্ত ফরাসি হৃদয়, তবুও এমবাপেকে আঁকড়ে ধরেই আগামীর স্বপ্ন দেখছে প্যারিস
FIFA World Cup 2022 : গোটা একটা দেশ বিধ্বস্ত। খেলা শেষে আবেগে অভিভূত মঁসিও মাক্রোঁ টুইট করলেন ভুল ফরাসিতে!
বড়দিনের আগের রোববার। রাত আটটা, হাঁটতে বেরিয়েছি। বড়দিনের মরশুমি বাজারে শাটার ফেলা। আজ ব্যবসা বন্ধ। শহরের জাঁকজমকপূর্ণ প্রাণকেন্দ্র, আলো জ্বলছে রাস্তায় রাস্তায়, শীতবস্ত্রে সাজগোজ করা রঙিন মানুষের ঢল পথে। তবু সব আনন্দ আয়োজনের উপর যেন লম্বা ছায়া ফেলেছে বিষাদ। লা ক্যানবিয়ের রাজপথের স্যাক্সোফোন বাদকের বাজনা স্তব্ধ। লাল-সাদা-নীল আলোকিত সিটি হল ম্লান। ফ্রান্স পরাজিত। আর্জেন্টিনার কাছে হেরে গেছে বিশ্বকাপ ফাইনাল।
রুদ্ধশ্বাস ম্যাচের শেষে ক্লান্ত মার্সেই শহরের বুকে ছড়িয়ে পড়েছে পুলিস বাহিনী। বাতাসে অনস্বীকার্য বারুদের ঘ্রাণ। কিছুক্ষণ আগেও আতসবাজিতে ছেয়ে গিয়েছিল বন্দরের উঠোন। প্রথম হাফ হতাশ করলেও, শীতের কামড় উপেক্ষা করে সবাই হুল্লোড়ে মেতে উঠল এমবাপের দৌলতে। এই বৃষ্টির রাতে খোলা আকাশের নীচে একসঙ্গে খেলা দেখতে ভিড় করেছিল যারা - স্থানীয় মানুষ, পর্যটকের দল, পথশিশু। এর মধ্যে হাতেগোনা লোকজন, পিঠে বাঁধা নীল-সাদা পতাকা, চকচকে চোখমুখ, বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রকাশ্যে। এক পাব থেকে অন্য পাবে তাদের যাতায়াত। কী সাহস! বাঁ দিক ঘুরলে একটা ব্রাজিলিয়ান রেস্তরাঁ, সেদিকে আর যাওয়ার কোনও মানে হয় না আজ!
গোটা একটা দেশ বিধ্বস্ত। খেলা শেষে আবেগে অভিভূত মঁসিও মাক্রোঁ টুইট করলেন ভুল ফরাসিতে! "Les Blues nous on fait rêver" (Les Blues nous 'ont' fait rêver)। অর্থাৎ, 'ওরা আমাদের স্বপ্ন দেখিয়েছে।' বিধ্বস্ত, তবু হতাশ নয়, খেলার শেষ মুহূর্ত অবধি স্বপ্ন দেখেছে ফ্রান্স। পথঘাট ঘুরে যা দেখলেন ইভ জেগ্লে, লিখছেন Le Parisien কাগজে - 'আজ অদ্ভূত নীল এক রবিবারের রাত। এ রাত সহনশীলতার, হেরে যেতে শেখার, হারার পর মাথা তুলতে শেখার, সব শেষে, এ রাত ভালবাসতে শেখার রাত।' এক কিশোরী তার বন্ধুকে বলছে, 'যতই যাই হোক, শেষ অবধি সব কিছুই খুব সুন্দর ছিল, তাই না!' হারের মধ্যে অনিন্দ্যকে খুঁজছে আল্পস থেকে ভূমধ্যসাগর বিস্তারিত অদ্ভূত নীল এই রাত। নতুন কোনও নক্ষত্র জার্সিতে যোগ না হলেও ছড়িয়ে আছে অচেনা কোন আলো।
সমগ্র উত্তেজনায় মাক্রোঁ যে স্বপ্নের আভাসটুকু বড় করে দেখলেন, Le Parisien দৈনিকের সম্পাদকীয়তে নিকোলা শারবনো লিখছেন একই কথা 'এই স্বপ্ন দেখার পরিসর তৈরি করে দেওয়াই ফুটবলের অসীম কৃতিত্ব।' "Et puis le football a aussi cette vertu incroyable de faire briller les yeux partout sur la planète. Que l'on soit riche ou pauvre, jeune ou beaucoup moins jeune, né dans un hémisphère ou un autre, fin connaisseur des règles ou novice, supporteur d'une équipe ou de son adversaire, les sensations sont universelles." 'সব শেষে, ফুটবল এমন এক অবিশ্বাস্য গুণের অধিকারী, যার জাদুতে দেশে বিদেশে ছড়িয়ে থাকা অজস্র চোখজোড়া একসঙ্গে চিকচিক করে ওঠে। সে আমি ধনী হই বা গরীব, নবীন কিশোর বা নবীনতর, উত্তর অথবা দক্ষিণ গোলার্ধের বাসিন্দা, খেলার নিয়মের সঙ্গে ওয়াকিবহাল বা একেবারেই নভিস্, এক টিমের পক্ষে বা তার প্রতিপক্ষে, আমার আবেগ ও সংবেদন সর্বজনীন। কাল মাঠে কেবল বল নিয়ে খেলা হয়নি। খেলার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল নাটকীয়তা, তীব্রতা, বেদনা, গভীর উল্লাস এবং অশ্রু - হতাশার কিছু মুহূর্ত যার পরেই অপেক্ষা করেছে লাবণ্যময়ী ক্ষণ।' হয়ত হাতেগোনা এমন জিনিস আমরা আজও বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছি যা আপামর মানুষের ভিতর প্রবল আবেগের ঢেউ তুলতে সক্ষম। সেই তীব্র আবেগ আমায় স্বপ্ন দেখতে শেখায়, ভাবতে শেখায়, এমন মাদকীয় আবেগ অপরের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারলে আমি আরও একটু জীবন ফিরে পাব।
ফ্রান্সের খবরের কাগজের পাতায় পাতায় পরমসহিষ্ণুতা ফুটে উঠছে, ফুটবলের প্রতি প্রেম উপচে উঠছে। সব ভাল। হারাও ভাল, জেতাও ভাল, তার চেয়ে ভাল পলটিক্যাল কারেক্টনেস। এর বাইরে পড়ে রইল আঙুরফল টক! La Marseillaise কাগজের সম্পাদকীয়তে লেও পুরজুয়েত লিখছেন, 'কালকের ম্যাচ আমাদের কিছুক্ষণের জন্য ভুলিয়ে দিয়েছিল কাতারের বিশ্বকাপ আসলে বিশ্বপরিবেশ, মানবসভ্যতা এবং গণতন্ত্রের বিপর্যস্ত মুখ।' আরও লিখছেন, 'এই তৃতীয় নক্ষত্রের জন্য লড়েছে ফ্রান্স, যা শেষ পাতে গিয়ে পড়ল আর্জেন্টিনার মুকুটে, যদিও তাতে ছিটে লাগল দুর্নীতি আর পরিবেশ দূষণের কাদা। ৬০০০ পরিযায়ী শ্রমিকের রক্তের দাগ। এই নক্ষত্রের প্রতি আমাদের অভিলাষ ছিল বটে, যদিও যা হারানোর জন্য কোনও ঈর্ষা আমরা রাখিনা।' শহরের রেস্তরাঁ পাব-এ শুধুই কি ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ পিঠ চাপড়ানো?
মার্সেই-এর নামকরা ব্রিটিশ পাব The Little Temple Bar এ ভিড় করেছিলেন আর্জেন্টিনার সমর্থকরা। এজকিয়েল তার মধ্যে অন্যতম, যিনি থেকে থেকেই জানান দিচ্ছিলেন, 'আজ ওদের ছিঁড়ে খাবো!' এজকিয়েলের প্রেমিকা যদিও ঠাণ্ডা মাথার মানুষ, বলেছেন, 'যাই হোক না কেন, আজ আমি বিজয়ী হবই কারণ জন্মসূত্রে আমি আধা ফরাসি, আধা আর্জেন্টিনিয়ান।' ফরাসি যুবক তোমা-কে তার বন্ধুরা বিশ্বাসঘাতক বলেছে। পাঁচ বছর আগে আর্জেন্টিনিয়ান বান্ধবী জুটিয়েছে অতএব গতকাল তোমা গলা ফাটিয়েছে নীল-সাদা জার্সির সমর্থনে। Le Parisien এর অতি সংবেদনশীল সম্পাদকীয়র পাশে দেখা যাবে শিরোনাম : Irrationnel et si cruel - irrational and so cruel! La Marseillaise ছোট করে লিখছে, 'পেনাল্টি শুট আউটে ফ্রান্স তাদের জয় ছেড়ে দিল আর্জেন্টিনার হাতে। শেষ পর্যন্ত নিজেদের গুটিয়ে নিয়ে ওরা মেসিকে ট্রফি তুলে নিতে দিল।' ফরাসি ভাষার অভাবনীয় মুন্সিয়ানা প্রয়োগ করে কেবল দু'টি বাক্যে আর্জেন্টিনার জয়ের এজেন্সি তুলে নিচ্ছে ফরাসিরা নিজেদের হাতে। এই না হলে পরাজয়ের গ্লানি!
জয় পরাজয়ের টানাপোড়েন, হার জিতের ঊর্ধ্বে ফুটবলের জয়গান, এসব ছাপিয়ে যে মুখটা ভেসে উঠছে বারবার সেটা এমবাপের। অমন সারল্য মাখা দুঃখি চোখ আমি দেখিনি। Le Monde শিরোনাম করেছে, "La symphonie inachevée de Kylian Mbappe", এমবাপের অসমাপ্ত ঐকতানে ভারাক্রান্ত ফরাসি হৃদয়। কাপ হাতে মেসির মুখে যে শিশুসুলভ আভা, তার থেকে কোনও অংশে পিছিয়ে নেই এমবাপের বেদনার্ত চাহনি। সে সোনার বুট পাচ্ছে,তার মুখে হাসি নেই। অন্যদিকে সাতবার বালোঁ দি'ওর পেয়েও মেসির মুখে এমন আলোকোজ্জ্বল হাসি এর আগে দেখেনি ফুটবল বিশ্ব। ওরা নিজের জন্য খেলেনা, দলের জন্য ছুটছে, দেশের জন্য হেসেছে, কেঁদেছে। একজনের দল জিতল আজ, অন্যজনের হারল। ফলস্বরূপ নিষ্পাপ দু'টি মুখ আদি অকৃত্রিম আনন্দ আর যন্ত্রণা বয়ে হাতে হাত ধরে মাঠ ছাড়ল, এইটুকুই আমি দেখছি আজ আশাহত ফ্রান্সের হেডলাইন।