আরসালান থেকে ডি বাপি: দুষ্কৃতীদের হাতেই কলকাতা বিরিয়ানির মালিকানা?
D Bapi Biriyani: কলকাতার বিখ্যাত এই বিরিয়ানির দোকানগুলির নেপথ্যে থাকা মানুষগুলির আইনি পরিচয় কতখানি স্বচ্ছ?
সাল ২০১৯। খবরের শিরোনামে উঠে আসে কলকাতার এক বিখ্যাত রেস্তোরাঁ। কলকাতার বিরিয়ানিপ্রেমীদের অত্যন্ত পছন্দের ঠেক আরসালান । সেই রেস্তোরাঁর মালিকের পুত্রের বিরুদ্ধে গাড়ি চাপা দিয়ে দুই বাংলাদেশি নাগরিককে হত্যার অভিযোগ ওঠে। ঘটনাপ্রবাহে দেখা যায়, জোরে গাড়ি চালানো, বেপরোয়া মনোভাব, ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা সমস্ত কিছুই ঘটে গেছে এই 'জাগুয়ারকাণ্ড' ঘিরে। বেশ কিছুকাল যাবৎ আরসালান বিরিয়ানির বদলে অপরাধের জন্যই কীর্তিমান হয়ে ওঠে। সদ্য ডি বাপি বিরিয়ানি উঠে এসেছে শিরোনামে। ব্যারাকপুরের এই বিখ্যাত বিরিয়ানির রেস্তোরাঁর মালিককে অস্ত্র আইনে গ্রেফতার করা হয়েছে। গুদাম মালিককে অস্ত্র নিয়ে ভয় দেখানোর অভিযোগ উঠেছে ডি বাপির মালিক অনির্বাণ দাসের বিরুদ্ধে। অনির্বাণ অবশ্য উত্তর ২৪ পরগনার মোহনপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্যও। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, কলকাতার বিখ্যাত এই বিরিয়ানির দোকানগুলির নেপথ্যে থাকা মানুষগুলির আইনি পরিচয় কতখানি স্বচ্ছ? কারও বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ, কারও বিরুদ্ধে অস্ত্র নিয়ে চড়াও হওয়ার! সত্যিই কি অপরাধীদের হাতেই রয়েছে কলকাতার বিরিয়ানির রাশ?
২০১৯ সালের আরসালানের ওই ঘটনার ৩২ দিনের মাথায় চার্জশিট দিয়েছিল কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ। জানা গেছিল, ওই বছরের ১৬ অগাস্ট রাত প্রায় দুটো নাগাদ লাউডন স্ট্রিট এবং শেক্সপিয়র সরণির সংযোগস্থলে একটি জাগুয়ার প্রবল বেগে এসে ধাক্কা মারে একটি মার্সিডিজকে। জাগুয়ারের ধাক্কায় মার্সিডিজটি পাশের পুলিশ কিয়স্কে গিয়ে ধাক্কা দেয়। তুমুল বৃষ্টির মধ্যে মঈনুল, তানিয়া ও শফী নামে তিনজন ওই পুলিশ পোস্টে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এঁরা সকলেই বাংলাদেশি নাগরিক। এদের মধ্যে মৃত্যু হয় দু’জনের।
আরও পড়ুন- কেন গ্রেফতার ডি বাপি বিরিয়ানির মালিক-তৃণমূল নেতা অনির্বাণ দাস?
ঘটনার তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে, জাগুয়ারটি আরসালানের মালিকের। সেদি দিনই দুপুরে পারভেজ আরসালান গাড়ির চালক হিসাবে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। পুলিশ পারভেজকে গ্রেফতার করে কিন্তু তাঁকে জেরা করতে গিয়েই দেখা যায় কেউটে বেরোচ্ছে একে একে। তদন্তে জানা যায়, ওই রাতে গাড়ি চালাচ্ছিলেন পারভেজের দাদা রাঘিব। তিনি রাতে প্রথমে সেন্ট জেমস কলেজ চত্বরে এক বন্ধুর জন্মদিনের পার্টিতে যান। সেখান থেকে এক বন্ধুকে নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে শেক্সপিয়র সরণি ধরে যাওয়ার পথে একাধিক ট্রাফিক সিগন্যাল ভেঙেওছে জাগুয়ারটি। লাউডন স্ট্রিট ধরে আসা মার্সিডিজ গাড়িটিকে প্রায় ১৩০ কিলোমিটার বেগে ধাক্কা মারে জাগুয়ারটি।
পুলিশ জানিয়েছিল, ঘটনার পরই গাড়ি ফেলে পালিয়ে যায় রাঘিব। ফোন করে তাঁর মামা হামজাকে। মামা সল্টলেকে রাঘিবকে এক পরিচিতের বাড়িতে রাতে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। পরের দিন দুবাইয়ে পালিয়ে যান রাঘিব। কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দারা জানিয়েছিলেন, জাগুয়ারের চালকের সামনের এয়ার ব্যাগ খোলা ছিল। অর্থাৎ সংঘর্ষের পরই এয়ার ব্যাগ খুলে যায়। অর্থাৎ চালকের ওই ব্যাগের আঘাত লাগার কথা কিন্তু পারভেজ আরসালান ের ক্ষেত্রে সেই ক্ষত ছিল না। বাড়ির সিসিটিভি-র ফুটেজ খতিয়ে দেখে পুলিশ জানতে পারে, সেদিন রাতে ১১টা নাগাদ গাড়িতে ওঠেন রাঘিব।
রাঘিবকে দেশে ফেরানো হয় এবং গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার করা হয় হামজাকেও। তবে পুলিশ তাঁদের চার্জশিটে পারভেজ আরসালান কে অভিযুক্ত করে কারণ তিনি রাঘিবের ভূমিকা গোপন করে আত্মসমর্পণ করেনছিলেন, পুলিশকে বিভ্রান্ত করেছিলেন। কিন্তু ধাঁধা থেকেই যায় কেন আরসালান বিরিয়ানির মালিক আখতার পারভেজ তাঁর ছোট ছেলেকে এই ঘটনায় আত্মসমর্পণ করাতে গেলেন? কাকে বাঁচানোর জন্য নিজের ছোট ছেলেকে বিপদের মুখে ফেললেন? পুলিশ জানিয়েছিল, গোটা ঘটনায় আখতার পারভেজ ভেঙে পড়েন, তা দেখে ছোট ছেলে পারভেজ আরসালান পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। দুবাই গিয়ে রাঘিব জানতে পারেন তার কাণ্ডের জন্য তাঁর ভাইকে আত্মসমর্পণ করানো হয়েছে। দুবাই থেকে কলকাতা ফেরেন রাঘিন এবং এক নার্সিংহোমে ভর্তি হয়ে যান রাঘিব। কেন? স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়নি এই ঘটনার।
আরও পড়ুন- মুঘল নয়, খোদ সংস্কৃতে উল্লেখ রয়েছে বিরিয়ানির! জিভে জল আনা এই পদ আসলে কতটা প্রাচীন?
২০১৯ এর পর ২০২৫। আবারও শিরোনামে কলকাতা বিরিয়ানি। তবে স্বাদের বাহারের জন্য নয়, ফের অপরাধের সূত্রেই! বছর খানেক আগেই ডি বাপি বিরিয়ানির মালিক অভিযোগ করেছিলেন২০ লক্ষ টাকা চেয়ে তাঁর কাছে ফোন আসছে। তাঁকে ধাওয়া করা হচ্ছে। ব্যারাকপুর, মধ্যমগ্রাম, বারাসাত এবং সোদপুরে ডি বাপি বিরিয়ানির আউটলেট রয়েছে। প্রতিদিন কাছাকাছি ৭,০০০ প্লেট বিরিয়ানি বিক্রি হয় তাঁদের। অনির্বাণ দাস বলেছিলেন, টাকা চেয়ে ফোনে হুমকি দেওয়া হয়েছিল যে, টাকা না দিলে মধ্যমগ্রাম আউটলেটে গুলি চলবে। ২০২২ সালের ১৬ মে, তিন যুবক ব্যারাকপুর ডি বাপি বিরিয়ানি আউটলেটে সাত রাউন্ড গুলি চালায়। তাতে একজন কর্মচারী এবং একজন গ্রাহক আহত হন।
কাট টু ২০২৫। এবার অভিযুক্ত খোদ অনির্বাণ দাস, ডি বাপির মালিক। মধ্যমগ্রাম-সোদপুর রোডে অবস্থিত ডি বাপি বিরিয়ানির একটি রেস্তোরাঁ। মধ্যমগ্রামের বাদামতলায় তাদের একটি গুদাম রয়েছে। বাদামতলার বাসিন্দা ও পুরসভার কর্মী বিশ্বজিৎ দত্তর সঙ্গে গুদাম ভাড়া নিয়ে ১১ মাসের চুক্তি হয়েছিল অনির্বাণ দাসের। পুলিশ বলছে, গত সোমবার সন্ধেয় গুদামের মালিক বিশ্বজিৎ অনির্বাণের সঙ্গে দেখা করতে যান। অভিযোগ, চুক্তি শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও ঘর ছাড়ছিলেন না। বিশ্বজিৎ জানান, এবার হিসেবমতো গুদাম ছেড়ে দিতে হবে তাঁকে। শুরু হয় বচসা। অনির্বাণ বাড়ির মালিকের উপর চড়াও হন। গুদামের মালিককে মারধর করেন অনির্বাণ। আর তাঁর নিরাপত্তারক্ষীর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ভয়ও দেখান। অনির্বাণের নিরাপত্তারক্ষীরও খোঁজ চলছে। এই ঘটনায় ডি বাপি বিরিয়ানির অন্যতম মালিক ও তৃণমূল নেতাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। দু'-দিনের জেল হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছে বারাসাত আদালত। অনির্বাণের নিরাপত্তারক্ষীর খোঁজ চলছে।
বিরিয়ানির সঙ্গে বিপুল অংশের বাঙালির আবেগ জড়িয়ে রয়েছে। সেই আবেগের বাড়বাড়ন্ত পাড়ায় প্রতি মোড়ে একটি করে গজিয়ে ওঠে বিরিয়ানির দোকানই প্রমাণ করে। আর কলকাতা বিরিয়ানি বিরিয়ানি সমাজেও কিঞ্চিৎ পৃথক ও ঐতিহ্যের দাবিদার। সেই প্রিয় খাবারের গন্ধে ধীরে ধীরে কি অপরাধের মশলাও মিশে থাকছে? থাকছে আগ্নেয়াস্ত্রের অবাধ ব্যবহার আর রাজনীতির পাঁকও?