অধ্যাপনা ছেড়ে ফুটবল! বিশ্বকাপ ফুটবলে অনুপ্রেরণার অনন্য নজির এই রেফারি
Female Referee World Cup 2022: ক্যাথরিন নেসবিট (Kathryn Nesbitt), কাতার বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে জড়িয়ে গিয়েছে এই মহিলার নাম। তিনি রেফারি।
বিশ্বকাপে ধুন্ধুমার। কাতারে ফুটবল উৎসব ঘিরে একের পর এক ঘটনার ঘনঘটা বারবার তুলে দিয়েছে প্রশ্ন, বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে বালির দেশের বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করেও। কিন্তু এর মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে একের পর এক ইতিহাসের উপাদান। সেরা হয়ে ওঠার লড়াই থেকে শুরু করে কেচ্ছার দিননামচা, শুধু খেলা নয় বিশ্বকাপ যেন অনুপ্রেরণা, লড়াই, যন্ত্রণা, কান্না, আনন্দের এক আস্ত আধার! ঠিক এমনই এক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে সম্প্রতি প্রকাশ্যে এসেছে ফুটবল বিশ্বকাপের নয়া হিরের কথা। একাধিক লড়াই আর দারিদ্রের ইতিহাস জানতে জানতে এই আকস্মিক ভিন্ন উদাহরণ অবাক করেছে বিশ্বকে।
ক্যাথরিন নেসবিট (Kathryn Nesbitt), কাতার (Qatar World Cup football) বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে জড়িয়ে গিয়েছে এই মহিলার নাম। তিনি রেফারি। একাধিক মহিলা রেফারির অবদানের মধ্যেই বিশ্বফুটবলের এই উৎসবে রয়েছে তিনিও। কখনও মাঠে নেমে সরাসরি, কখনও ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি বা ভার হিসেবে দেখা মিলেছে তাঁর। কিন্তু অন্য একাধিকের সঙ্গে দাঁড়িয়ে শুধু পুরুষ ফুটবল দলের প্রতিযোগিতায় মহিলা হিসেবেই তিনি মৌলিক নন, ক্যাথরিন সামগ্রিকভাবে হয়ে উঠেছেন ভিন্ন। কেন? কেন তিনি অনন্য?
কে ক্যাথরিন নেসবিট?
১১ জুলাই, ১৯৮৮। আমেরিকার নিউ ইয়র্কের রকস্টার শহরে জন্ম নেন ৩৪ বছর বয়সী ক্যাথরিন। ছোট থেকেই পড়াশোনায় মেধাবী ছিলেন। প্রথম থেকেই লক্ষ্য ছিল বিজ্ঞানের পথে এগনোর। পড়াশোনা শুরু করেন জোরকদমে। পড়াশোনা তো হল কিন্তু আসল ইচ্ছা! ক্যাথরিন ছোট থেকেই চাইতেন তাঁর এক সকার প্লেয়ার দাদার মতোই খেলোয়াড় হতে।
আরও পড়ুন- ফুটবলের ছন্দ নষ্ট করছে অফসাইড! প্রযুক্তির জাঁতাকলে কতটা ক্ষতি হচ্ছে খেলার
ক্যাথরিনের খেলায় প্রবেশ
বয়স তখন মাত্র ১৪, ২০০২ সালের জানুয়ারি মাস। অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী মেয়েটিকে দেখা গেল মাঠে। একান্ত ইচ্ছার বশেই ইউএস সকার অ্যাসোসিয়েশনের একটি ম্যাচে লাইন ম্যান হলেন তিনি। মাঠে নামলেন সেই থেকেই। আর ফিরে তাকাতে হয়নি।
তারপর চলতে থাকল পড়াশোনা। একদিকে কলেজ, অন্যদিকে খেলাতেও মন দিলেন ক্যাথরিন। জাতীয় সকার টুর্নামেন্টে কানস বনাম পোর্টল্যান্ডের ম্যাচে ২০১৩ সালের ১৩ এপ্রিল থেকে আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ ঘটল তাঁর। ওই ম্যাচে অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি হিসেবে মাঠে নামলেন তিনিও।
পরিচিত পেতে শুরু করলেন ২০১৫ সাল থেকেই। ক্যাথরিন 'মেজর লিগ সকার (MLS)' এর ডিসি ইউনাইটেড বনাম কলম্বাস ম্যাচে নামলেন রেফারির ভূমিকায়। মহিলা হিসেবে ম্যাচ রেফারির রেকর্ড গড়লেন সেখান থেকেই।
ফিফা অর্থাৎ বিশ্ব ফুটবল সংস্থার সঙ্গে তাঁর আনুষ্ঠানিক যোগ ঘটল ২০১৬ নাগাদ। অনূর্ধ্ব ১৭ মহিলা বিশ্বকাপে অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি হিসেবে শুরু করলেন কাজ। এরপর ২০১৮ সালে অনূর্ধ্ব ২০ মহিলা বিশ্বকাপেও দেখা গেল তাঁকে। ২০১৯ এর মহিলা বিশ্বকাপে দাপিয়ে বেড়ালেন ক্যাথরিন।
২০২০ সালে ফের মেজর লিগ সকারে তাঁর ভূমিকা রেকর্ড গড়ল। প্রথম মহিলা সহ রেফারি নন, রেফারি হিসেবে ছড়াল তাঁর নাম। ওই বছরই বছরেই মেজর লিগ সকার টুর্নামেন্টের সেরা রেফারি নির্বাচিত হলেন তিনি।
বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল নাম। আর ২০২২। কাতার বিশ্বকাপের দরবারে হাজির হলেন ক্যাথরিন। জার্মানি বনাম কোস্টারিকা থেকে একাধিক ক্ষেত্রে তাঁকে দেখা গিয়েছে। কখনও ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি হিসেবে কখনও মাঠেই প্রয়োজনের মুহূর্ত তৈরি হয়েছে তাঁর জন্য।
আরও পড়ুন- পুরুষদের বিশ্বকাপে ম্যাচ সামলাবেন এই মহিলা, যে ইতিহাসের সামনে দাঁড়িয়ে গোটা বিশ্ব
অধ্যাপক থেকে রেফারি!
এ তো গেল তাঁর খেলার কেরিয়ার। কিন্তু বাকিটা? একাধিক কথকতা আর প্রশ্নের মধ্যেই উঠে আসে ক্যাথরিনের ত্যাগের কথা। ক্যাথরিন জানিয়েছেন, "আমি ২০১৯-এর মহিলা বিশ্বকাপের রেফারি হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার মাত্র দু'সপ্তাহ আগেও পড়াতাম। অধ্যাপক ছিলাম। রসায়ন চর্চাও ছিল আমার নিত্যসঙ্গী।" বাল্টিমোরের টাইসন বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছিল গবেষণা। সেখানে নিজস্ব একটি ল্যাবও ছিল এই অধ্যাপক-গবেষকের। অর্থাৎ একদিকে খেলার সঙ্গে যুক্ত থেকে একের পর এক সাফল্য অর্জন, অন্যদিকে রসায়নের মতো কঠিন বিষয়ে গবেষণা! এই দুই কাজই চলছিল একসঙ্গে। ক্যাথরিন মূলত মানুষের মস্তিষ্কের নানা রসায়নগত উপাদানের উপরেই গবেষণার কাজ করছিলেন। এর সঙ্গেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক হিসেবেও নিযুক্ত ছিলেন তিনি। পড়ুয়াদের মধ্যে জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি কোনও দিন।
ক্যাথরিন নিউ ইয়র্কের রকস্টারের সেন্ট জনস ফিশার কলেজ থেকে স্নাতক হন। বিষয় ছিল রসায়ন। সেখানে মহিলা ভলিবল দলের সদস্য ছিলেন তিনি। সেখানে ওই দলের হয়ে বিভিন্ন জায়গায় ৪২টি ম্যাচও খেলেন তিনি।
ক্যাথরিন পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি উপাধি লাভ করেন। সেখানেই দলে দীর্ঘকাল ধরে পড়াশোনা। ২০১০ থেকে ২০১৫, প্রায় ৫ বছরের পড়াশোনা জীবন কাটিয়ে তিনি ফের ভর্তি হন মিশিগানের বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানেও চলে গবেষণা। এরপর ২০১৭-র অগাস্ট মাস নাগাদ অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন টাউসন বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানেই টানা দু'বছর অধ্যাপনা করেন ক্যাথরিন। যা ২০১৯ অগাস্ট নাগাদ ছাড়েন শুধুমাত্র ফুটবলের তাগিদে।
তথাকথিত নিশ্চিত পেশা এবং জীবনের একাধিক স্বপ্ন ত্যাগ করে তিনি পাকাপাকি ফেরেন ফুটবলে। তথাকথিত পুরুষতান্ত্রিক বিশ্বের ফুটবল জগতে পদার্পণ ঘটে আর এক মহিলার, যা বর্তমান প্রেক্ষিত এবং কাতারের বিশ্বকাপ আবহে অনন্য তো বটেই, মৌলিক আর অভিনবও, বলছেন অনেকেই।