দুই বিশ্বযুদ্ধ থেকে করোনা মহামারি, দেড়শ বছর পেরিয়ে এসেও জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ‘হরলিক্স’

Horlicks : ওষুধের দোকানে কাজ করতেন দুই ভাই, ব্যবসায় পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে গিয়ে বানিয়ে ফেললেন বিশ্ববিখ্যাত পানীয়, পড়ুন ইতিহাস

“বেড়ে ওঠার ডোজ, হরলিক্স রোজ রোজ...!”, বিজ্ঞাপনের এমন বহরে সাড়া না দিয়ে আর উপায় কি! ছোট থেকেই হরলিক্সের গ্লাসে চুমুক দেওয়ার অভ্যাসের সঙ্গে কমবেশি সকলেই পরিচিত। দুধের অরুচি মেটাতে তাতে কয়েক চামচ হরলিক্স পাউডার মিশিয়ে দিতেন মা-ঠাকুমারা। আজ প্রায় দেড় শতক ধরে ঘরে ঘরে ভরসা জুগিয়ে আসছে এই পানীয়। শুধু পানীয় বললে ভুল হবে, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে হরলিক্স মানে এক চিরকালীন নস্টালজিয়া। নিছক নাম থেকে বেরিয়ে এসে ব্র্যান্ড হয়ে ওঠার এই জার্নিটা ঠিক কেমন ছিল জানেন?

হালকা বাদামি রঙের পাউডার, গরম জল অথবা দুধে মিশিয়ে পান করার চল শুরু হয় আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগে। যদিও এর শুরুটা হয়েছিল খোদ বিদেশের মাটিতে। সময়টা ১৮৭৩ সালের ৫ জুন। আমেরিকায় হরলিক্স আবিষ্কার করেন দুই ভাই। জেমস এবং তার ভাই উইলিয়াম হরলিক। দুজনেই ছিলেন ব্রিটেনের বাসিন্দা। জেমস ছিলেন একজন রসায়নবিদ। তিনি অবশ্য আগে থেকেই কাজ করতেন আমেরিকার একটি শিশুদের ড্রাই বেবি ফুড তৈরির কোম্পানিতে। পরবর্তীতে ১৮৬৯ সালে তাঁর ছোট ভাই উইলিয়ামও চলে আসেন আমেরিকায়। দাদার সঙ্গে একই কোম্পানিতে কাজ করতে শুরু করেন তিনিও।

আরও পড়ুন - রান্নাঘরে যাত্রা শুরু, আজ ঠাঁই লাখো দেশবাসীর হৃদয়ে, ভিকো-র লড়াইটাকে স্যালুট

কেবলমাত্র চাকরিতে তাঁরা থেমে থাকতে চাননি কোনওদিনই। পাশাপাশি কারখানায় রাসায়নিক পদার্থ নিয়ে নাড়া ঘাঁটা করতে করতে নতুন একটি পণ্য তৈরি করার কাজ এগিয়ে রাখেন অনেকটাই। অবশেষে, কয়েক বছর চাকরি করার পর, ১৮৭৩ সালে এক প্রকার মল্টেড মিল্ক ড্রিংক তৈরির নতুন কোম্পানি শুরু করেন দুইভাই। কোম্পানিটির নাম দেন J&W হরলিক্স। আর নতুন আবিষ্কৃত ওই পণ্যটির নাম দেন ডায়স্টয়েড।

যদিও প্রথম অবস্থায় এটি পাউডার জাতীয় খাবার হিসেবে বিক্রি হতে থাকে। তখনও জল অথবা দুধ জাতীয় তরলের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়ার স্বত্বাধিকার হাতে পায়নি এই পণ্য। পেটেন্ট পেতে পেতে লেগে গেল আরও দশটা বছর। ১৮৮৩ সালের ৫ জুন দুই ভাই তাঁদের পণ্যটির তরলের সঙ্গে মিশে যাওয়ার ক্ষমতার জন্য ইউএস পেটেন্ট নং ২৭৮,৯৬৭ হাতে পান। ফলে ডায়স্টয়েড পেটেন্ট প্রাপ্ত প্রথম মল্টেড দুধের পণ্য হয়ে ওঠে।

know the history of horlicks

নিজেদের নামের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে পণ্যের নামটিও পরবর্তীতে বদলে দেন তাঁরা। আর সেই নামেই ঘরে ঘরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এটি। আমেরিকার মাটি থেকে ক্রমেই ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও। ১৯০৮ সালে উইলিয়াম ও জেমস প্রায় ২৮,০০০ পাউন্ড খরচ করে স্লফ, বার্কশায়ারের কাছে তাঁদের প্রথম কারখানা খোলেন। দুই বিশ্বযুদ্ধ থেকে শুরু করে হালফিলের করোনা মহামারি সমস্ত ঝড় ঝাপটা সামলে ক্রমশ ঘরে ঘরে ব্র্যান্ড হয়ে উঠতে শুরু করে হরলিক্স।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করতে শুরু করে হরলিক্স। ব্রিটিশ পক্ষের সৈন্যরা এই পাউডার জলে মিশিয়ে পান করতে শুরু করেন। এতে একদিকে যেমন দৈহিক ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, অন্যদিকে অনেকক্ষণ যাবৎ খিদে মেটাতেও সাহায্য করে এই পানীয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের এই সুফলকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েও কাজে লাগানো হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, হরলিক্স ট্যাবলেটগুলি এবং ক্যান্ডি হিসাবে বিক্রি করা শুরু হয়। আমেরিকান, ব্রিটিশ এবং অন্যান্য সৈন্যরা শক্তিবর্ধক ট্যাবলেট হিসেবে এটি সেবন করতে শুরু করেন।

know the history of horlicks

এরপর ১৯৪৮ সালের লন্ডন অলিম্পিকে হরলিক্সের জনপ্রিয়তা এক নতুন পরিচয় পায়। আয়োজক কমিটি অলিম্পিকে অংশ নেওয়া সব খেলোয়াড়কে হরলিক্স উপহার দেয়। এটি রাতে শোয়ার আগে পানীয় হিসাবে এবং খেলায় নামার সময় পরিবেশন করা হয়েছিল যাতে খেলোয়াড়দের দৈহিক ক্ষমতা এবং একাগ্রতা বৃদ্ধি পায়। হরলিক্সের এই ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার কারণে ১৯৬৯ সালে বিশম গ্রুপ কিনে নেয় একে যা পরে গ্ল্যাক্সোস্মিথলাইন অর্থাৎ জিএসকে গ্রুপ নামে পরিচিত হয়।

যদিও হরলিক্স কখন ভারতে প্রবেশ করেছিল সে সম্পর্কে কোনও সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই, তবে ইতিহাস বলছে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অনেকেই এই পানীয় থেকে উপকার পেয়েছিলেন যাঁরা পরবর্তীতে এদেশে আসেন, তাঁদের হাত ধরেই আসে হরলিক্স, এমনটাই অনুমান করা যায়। এটি ১৯৪০ এবং ১৯৫০ এর দশক নাগাদ পঞ্জাব, বাংলা এবং মাদ্রাজের বেশ কিছু রাজকীয় রাজ্য সহ দেশের অন্যান্য ধনী পরিবারগুলিতেও প্রথম ফ্যামিলি ড্রিঙ্ক হিসাবে গৃহীত হতে শুরু করে।

আরও পড়ুন - ১৩৫ বছর ধরে নেশার জল বেচছে কোকাকোলা? কীভাবে জন্ম নিল এই পানীয়, অবাক করবে যে ইতিহাস

তারপর সময় অনেকটাই এগিয়েছে। আধুনিক সময়ে হরলিক্সের পাশাপাশি এসেছে আরও বাহারি পানীয়। যদিও হরলিক্সের জনপ্রিয়তা তাতে কমেনি এক রত্তিও। এই বদলে যাওয়া সময়ের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে হরলিক্সও নিজেদেরকে বদলে নিয়েছে অনেকটাই। একের পর এক যুগোপযুগী ধরন এসেছে এই পানীয়ের। বেবি ফুড থেকে শুরু করে মাদার হরলিক্স, বয়স এবং শারীরিক ধরনের সঙ্গে মানানসই ভিন্ন ভিন্ন ধরনের হরলিক্স আজ মেলে বাজারে। প্রতিক্ষেত্রেই তার প্যাকেজিং-এ রয়েছে অভিনবত্ব।

কাচের বোতলে নীল রঙের ঢাকনা, শুরুতে এমন চেহারাই ছিল এই পানীয়ের। পরবর্তীতে এসেছে রঙচঙে বোতল। কাগজের প্যাকেটেও বিক্রি হয় এটি। কাচের বোতল ভেঙে যাওয়ার ভয় ছিল বলে আসে পলিথিনের বোতল। শুধু পাউডার জাতীয় পানীয় নয় পাশাপাশি এই কোম্পানির জনপ্রিয়তার কথা মাথায় রেখে বাজারে আসে একই নামের বিস্কুটও। আজকের দিনে দাঁড়িয়েও একাধিক নিত্যনতুন হেলথ ড্রিংকের ভিড়ে অটুট এই পুরাতন হরলিক্স নামটুকু। শুধু নাম নয় একটা চিরকালীন ভরসা যোগ্য ব্র্যান্ডও বটে।

More Articles