'চাকরি দিলাম, মা-কে খাওয়াবি'! জ্যোতি বসুকেও থামিয়ে দিতেন মস্তান-মন্ত্রী রাম চ্যাটার্জি
Ram Chatterjee: হরেকৃষ্ণ কোঙ্গারের দিকে আঙুল উঁচিয়ে বললেন, "আপনার সম্পর্কেও নানা কথা শোনা যায়। কে মন্ত্রিসভায় যাবে দলের তরফে সেটা সেই দলের ব্যাপার।"
ক্যালকাটা সুইমিং ক্লাবের পুলে আদিবাসীদের নামিয়ে স্নান করানোর ঘটনা নিয়ে রাজনৈতিক জলঘোলা শুরু হলো। ব্রিটিশরা ছেড়ে গেলেও ওই ক্লাব তখন অবাঙালি ব্যবসায়ীদের আখড়া। সেই প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে নালিশ করলেন। জোরালো নালিশ। এই রকম কাণ্ডকারখানা চলতে থাকলে ওঁরা রাজ্য ছেড়ে চলে যাবেন, ব্যবসাও গুটিয়ে নেবেন। জ্যোতি বসুর ক্যাবিনেটের এক মন্ত্রীর নেতৃত্বে ঘটা এমন ঘটনা তারা মেনেই নিতে পারছেন না। জল এত দূর গড়াল যে জ্যোতি বসুর ইমেজ ব্যবসায়ীদের কাছে তখন প্রশ্নচিহ্নের মুখে। রাম চ্যাটার্জিকে ডেকে পাঠালেন জ্যোতি বসু। সাফ জানিয়ে দিলেন, এ ধরনের ঘটনা আর কখনও হলে তাঁকে ক্যাবিনেটে স্থান দেওয়া সম্ভব হবে না। এতটা কড়া সুরে তাঁর রাজনৈতিক আশ্রয়দাতা জ্যোতি বসুকে কোনওদিন কথা বলতে দেখেননি রাম চ্যাটার্জি। গোটা দিনটাই যেন বরবাদ হয়ে গেল বেতাজ বাদশার।
এদিকে সংগঠিত আন্ডারওয়ার্ল্ডের এমন এক চরিত্রকে মন্ত্রিসভায় স্থান দেওয়া নিয়ে বামফ্রন্ট এবং সিপিএমের ভেতরেই নানা কথা চলছিল। জ্যোতি বসুর উপর এই নিয়ে চাপ বাড়াচ্ছিলেন বর্ষীয়ান নেতারা। এ বিষয়ে একটি হাঁড়ির খবর বর্ষীয়ান সাংবাদিক প্রবীর ঘোষালকে শুনিয়েছিলেন ফরোয়ার্ড ব্লকের কিংবদন্তি নেতা অশোক ঘোষ। যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমলেই মন্ত্রী হয়েছিলেন রাম চ্যাটার্জি। মন্ত্রিসভা গঠন নিয়ে সিপিএমসহ শরিক দলগুলির বৈঠক শুরু হয়েছে। কোন দল থেকে কে কে মন্ত্রী হবেন তার প্রস্তাব আসছে। বৈঠকে রয়েছেন প্রমোদ দাশগুপ্ত। বাকি তাবড় নেতারা তো রয়েইছেন। যাই হোক, বিভিন্ন দলের তরফে মন্ত্রীদের নাম ফ্রন্টের বৈঠকে পেশ করার পর এবার মার্ক্সবাদী ফরোয়ার্ড ব্লকের পালা। দলের তরফে রাম চ্যাটার্জির নাম মন্ত্রী হিসেবে পেশ করা হলো। বৈঠকে রাম চ্যাটার্জি স্বয়ং উপস্থিত। রামের নাম প্রস্তাব হতেই বৈঠকে গুরুতর আপত্তি তুললেন হরেকৃষ্ণ কোঙ্গার। জ্যোতি বসু, প্রমোদ দাশগুপ্তদের সামনেই হরেকৃষ্ণ বলেন, "রামবাবুকে মন্ত্রিসভায় নেওয়া কখনই উচিত না, ওঁকে নিয়ে নানা কথা শোনা যায় যা মন্ত্রিসভাকে কলঙ্কিত করবে।" দোর্দণ্ডপ্রতাপ কৃষক নেতার বক্তব্যের পর থমকে রয়েছে বামফ্রন্টের সভা। সবাই চুপ। আচমকাই আত্মপক্ষ সমর্থনে চিৎকার করে উঠলেন রাম চ্যাটার্জি। হরেকৃষ্ণ কোঙ্গারের দিকে আঙুল উঁচিয়ে বললেন, "আপনার সম্পর্কেও নানা কথা শোনা যায়। কে মন্ত্রিসভায় যাবে দলের তরফে সেটা সেই দলের ব্যাপার। আমার দল আমাকে ঠিক করেছে। আপনি আপত্তি করার কে হন?"
হরেকৃষ্ণ কোঙ্গার বুঝলেন রামের পেছনে অদৃশ্য সমর্থন রয়েছে। নাহলে ফ্রন্টের সভায় এক ছোট শরিক দলের নেতার এত দূর সাহস হয় না যে তাঁর মুখের ওপর কথা বলে। সুতরাং সম্মান বাঁচাতে তাঁর চুপ করে যাওয়াই উচিত বলে মনে করলেন তিনি। বসে যেতে যেতে একবার নিচু চোখে জ্যোতিবাবুকে দেখলেন হরেকৃষ্ণ। কেমন ভাবলেশহীন বসে আছেন বামফ্রন্টের মুখ্যমন্ত্রী, যেন কিছুই হয়নি। রাম চ্যাটার্জিকে নিয়ে বিতর্ক থামছিল না। মন্ত্রী হওয়ার পর সব থেকে বড় বিতর্ক বাঁধল রাম চ্যাটার্জির চারতলা সুবিশাল অট্টালিকা নিয়ে। বিকল্পের সন্ধান দিতে চাওয়া বামফ্রন্টের এক সর্বহারা মন্ত্রী কোথা থেকে এত টাকা পান এমন অট্টালিকা বানাবার? এই নিয়ে তখন চর্চা তুঙ্গে। অহরহ প্রশ্ন তুলছে বিরোধী কংগ্রেস দলের নেতারা। শিয়ালদা, শেওড়াফুলি লোকালে তখন এই নিয়েই আলোচনা। এরই মধ্যে রাম চ্যাটার্জির চন্দননগরের বাড়িতে ভোরবেলা হাজির হলেন আয়কর আধিকারিকরা। গোটা বাড়ির তল্লাশি নিতে চান তারা।
আরও পড়ুন- মস্তান থেকে মন্ত্রী! দাঁড়িয়ে থেকে গোটা বাজার লুঠ করিয়েছিলেন রাজ্যের এই মন্ত্রী
ভোরবেলা ডাকাবুকো রাম চ্যাটার্জির বাড়িতে তল্লাশি! বাড়ির নিচের তলায় পাহারায় থাকা লোকজন উপরে 'বাবু'-র কাছে খবর পাঠালো। ঘুম ভেঙে নেমে এলেন ডন। একটুও ঘাবড়ালেন না। সবাইকে ভেতরে আসতে বললেন। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হলো।
তখনকার দিনে আজকের মতো সক্রিয় সংবাদ মাধ্যম, লাইভ কভারেজ এসব কিছুই ছিল না, তবু খবর চেপে থাকল না। অফিসযাত্রীদের মুখে মুখে ফিরতে লাগল খবর। বেলা গড়াতেই রাম চ্যাটার্জির বাড়ির সামনে অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে লাগল। এমনিতেই কিছু লোক জড়ো হয়েছিল। এবার দেখা গেল লম্বা লাইন পড়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর রাম চ্যাটার্জির বাড়ির দরজায় চাপড় মারতে শুরু করল লাইনে দাঁড়ানো বহু মানুষ।
"কী ব্যাপার?" বাড়ির ভেতর থেকে জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন কেউ।
উত্তর এল, "ইনকাম ট্যাক্সের বাবুদের সঙ্গে কথা বলতে এয়েছি।"
লাইনের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা সব লোকেরই এক বক্তব্য। ইনকাম ট্যাক্সের অফিসারদের সঙ্গে কথা বলবেন তারা। ভেতরে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে আর বাইরে শোরগোল। অবশেষে অফিসারদের একজন এলেন বাড়ির বাইরে।
"ক্যায় বাত হ্যায়?" সবিনয়ে জিজ্ঞাসা করলেন সমবেত জনতাকে।
উত্তরে একজন বলে উঠলেন, "আমি সদানন্দ কোলে (নাম অপরিবর্তিত)। এসেছি আরামবাগ থেকে। শুনলাম আপনারা এই বাড়ি নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। এই বাড়ির জন্য আমি ইট দিয়েছি। আমাকেও জিজ্ঞাসা করুন।
পেছন থেকে এগিয়ে এলেন আরেকজন। বললেন বিনামূল্যে ৫০০ জন লেবার সাপ্লাই দিয়েছেন তিনি।
এভাবেই এক একজন এগিয়ে আসছেন। কেউ বলছেন সিমেন্ট দিয়েছি, কেউ বলছে বালি, কেউ বলছে অন্যান্য নির্মাণ সরঞ্জাম। সবার দাবি, রামবাবুকে বাড়ি নিয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তাদেরকেও জিজ্ঞাসা করা উচিত কারণ রাম চ্যাটার্জির প্রাসাদোপম বাড়ি নির্মাণে তারা স্বেচ্ছা শ্রম এবং স্বেচ্ছায় দান করেছেন। সুতরাং দিল্লির বাবুদের উচিত তাদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা। কয়েকশো লোক লাইনে দাঁড়িয়ে। অফিসাররা একসময় দেখলেন, বাড়ির ভেতর রামবাবু আর বাড়ির বাইরে রামভক্তদের দ্বারা কার্যত ঘেরাও হয়ে রয়েছেন তারা। ওই একদিনই শেষ। পরে অবশ্য ওই বাড়ি নিয়ে আর কোনও তদন্ত হয়নি।
আরও পড়ুন- যৌনকর্মী, বেপরোয়া প্রেমিকা! কে ছিলেন কলকাতার প্রথম মহিলা মস্তান নির্মলা দাসী?
কিন্তু বামফ্রন্টের মন্ত্রী, রবিনহুড রাম বাড়ি তৈরির এত টাকা পেলেন কোথা থেকে?
সিগারেটে সুখটান দিয়ে একবার নিজেই সেসব কথা শাগরেদদের বলেছিলেন রাম চ্যাটার্জি।
সিগারেট ধরানোর একটা বিশেষ স্টাইল ছিল তাঁর। দু'আঙুলের ফাঁকে সিগারেট ধরিয়ে সব ক'টা আঙুল ভাঁজ করে হাতের চেটো গোল করে মারতেন সুখটান। তেমনই একদিন একটা সুখটান মেরে রাম বললেন, "বাড়ির টাকা দিয়েছে এক ব্যাটা সাধু"।
সবাই বলল, "সে কী! কোথাকার সাধু?"
কলকাতারই। বলে কিনা গঙ্গার উপর হেঁটে যেতে পারে। শুনলাম। তখনই ভেবে নিলাম একদিন সুবিধা মতো পাকড়াও করব। একদিন দেখি ভক্তদের নিয়ে বসে আছে। গেলাম। বললাম,
"এসব কী ভুজুং ভাজুং হচ্ছে। আপনি গঙ্গার উপর হাঁটতে পারেন? হেঁটে দেখান তো! সাধু নড়ে না। নানা কথা বলে। শেষে বললাম, হাঁট শ্লা, নাহলে তোর ভাণ্ড ভেঙে দেব বাজারে। সাধু তখন হাতে-পায়ে ধরে। ওকে ততক্ষণে জলে নামিয়ে দিয়েছি তো। তারপর বলে আমাকে ছেড়ে দিন। আপনাকে টাকা দেব। সেই টাকা দিয়েই এই বাড়ির সিংহভাগ খরচ করলাম।"
এই গল্প রাম চ্যাটার্জির পুত্র দেবাশিষ চ্যাটার্জিও শুনেছেন ছোটবেলায়। তাঁর মুখেও এই গল্প ফেরে। যাইহোক, রাম চ্যাটার্জির ঘটনাবহুল জীবন তরতরিয়ে এগোচ্ছিল। রাজ্য জুড়ে নামডাক। তাঁকে ঘিরে রম্যকাহিনির মতো গল্পগাথা ছড়াচ্ছিল। ভিড় বাড়ছিল তাঁর প্রসাদোপম বাড়িতে। দূর দূরান্ত থেকে লোক আসে। দু'মুঠো না খাইয়ে কি ছাড়া যায়? প্রতিদিনই প্রচুর পাত পড়ে রাম চাটুজ্জ্যের বাড়িতে। বাড়ি মানে চারতলা প্রাসাদের নিচতলায় বসে আমদরবার। বিচার, সালিশি, চাকরি প্রার্থীদের আবেদন সব শোনেন রাম। রাম চ্যাটার্জির থেকে চাকরি পাওয়ার একটা গোপন ট্রিকস আছে। এখন আর গোপন নেই যদিও, সবাই জেনে গেছে। রাম চ্যাটার্জির কাছে চাকরি পেতে গেলে সঙ্গে বিধবা মা-কে নিয়ে যেতে হবে। বিধবা মায়ের সন্তান রাম বোঝেন সংসারের ভার। বিধবা মা নিয়ে কোনও ছেলে দাঁড়ালে তাঁর চাকরি ঠেকায় কে? এমন ঘটনা গল্প নয় সত্যিই ঘটেছে। পাকা সরকারি চাকরি দিয়ে রাম চ্যাটার্জির সতর্কবাণী, "চাকরি দিলাম, মা-কে খাওয়াবি। মা-কে দেখবি।" ঘাড় নেড়ে ডনের দরবার থেকে বিদায় নিত মা-ছেলে। কৃতজ্ঞতার চোখের জলে রামকে আশীর্বাদ করতেন বিধবারা। তবে এর অন্যথাও ঘটত কখনও সখনও। একবার এক রামঅনুগামী এসে জানালেন, "বাবু, অমুক বিধবা মাসিমার ছেলেকে চাকরি দিয়েছিলেন। ও কথা রাখেনি, মা-কে খেতে দেয় না।"
"কী বললি?", শুনেই অগ্নিশর্মা রাম চ্যাটার্জি আদেশ করলেন, "ডেকে নিয়ে আয় হারামজাদাকে"।
ছেলে এল। থরথর করে কাঁপছে।
"ভুল হয়ে গেছে স্যার।"
"নিকুচি করেছে তোর ভুলের। অ্যাই ওর পেটে একটা বালির বস্তা বাঁধ তো। ওই অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাক রাস্তার মোড়ে।
দরবার শেষ করে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে রওনা দেন রাম। ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায়। বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে দেখেন ওই ছেলে সকাল থেকে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বস্তা পেটে বাঁধা। কাঁদছে। কোমর ভেঙে পড়ার জোগাড়। রাম চ্যাটার্জি কাছে যান। বলেন, "কী রে হারামজাদা, একদিনেই কাহিল। ভাব, তোর মা দশ মাস তোকে এভাবে পেটে করে ঘুরেছে।"
"ভুল হয়ে গেছে স্যার। এ ভুল আর হবে না।"
"মনে রাখিস, মা কে খাওয়াবি বলেই তোকে চাকরি দিয়েছি।"
"আর ভুল হবে না," মা-কে সেবা করবে এই শর্ত দিয়ে ছাড়া পায় যুবক। রামও দিনের শেষে বাড়িতে ঢোকেন।
এরকম কিসসা বহু আছে। নিজের শৈশব আর বিধবা মায়ের যন্ত্রণা কোনওদিন ভুলতে পারেননি রাম। বিধবা মা-কে নিয়ে কোনও বেকার যুবক সামনে দাঁড়ালে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পারতেন না রাম চ্যাটার্জি। একবার কী হলো, রামের দরবারে হাজির হলেন খোদ রামের মা। ছেলের দরবারে বৃদ্ধা মা কখনও আসেননি। মা-কে দেখে লাফিয়ে উঠলেন মন্ত্রী, "মা, তুমি এখানে কী করো?"
রামের মায়ের হাতে একটা কাগজ।
"এইটা কী মা? দেখি..."
কাগজ হাত থেকে নিয়ে রাম তো থ!
"এসব সরকারি কাগজ তোমার হাতে এল কোথা থেকে?"
মা বলেন, "দ্যাখ রে গোপালের মা আমকে রোজ ভোরে ফুল পেড়ে দেয়। গোপালের চাকরি সেই কোচবিহারে। দু'বছর হয়ে গেল। ওকে ঘরের পাশে এনে দে।"
"এগুলো সরকারি কাগজ তুমি নিয়েছ কেন?"
"আমি কথা দিয়ে দিয়েছি। তোকে করতেই হবে।"
এই ঘটনার চারদিন পর গোপালের মা এসে রাম চ্যাটার্জির মায়ের পায়ে পড়ল। "দিদি গো তোমার রাম রাজা হোক। ভগবানের কাছে এই প্রার্থনা করি। গোপাল এমাসেই ফিরে আসছে । চুঁচড়োয় ওর ট্রান্সফার হয়ে গেছে।" এমন সব ঘটনা লোকমুখে ফিরতে লাগল। ভিড় উপচে পড়তে লাগল রামের বাড়িতে। প্রতিদিন দরবার বসে। 'ভিজিট' শেষ করেই রাম ছোটেন রাইটার্সের উদ্দেশে। একদিন ঘটে গেল সেই বিখ্যাত ঘটনা।
আরও পড়ুন- গোপাল পাঁঠা : হিন্দুত্বের তাস না কি কলকাতা কাঁপানো মস্তান?
একদিন বাড়ির দরবার শেষ করতে করতে বেলা হয়ে গেল। হঠাৎ রাম চ্যাটার্জির খেয়াল হলো, "আরে আজ তো ক্যাবিনেট!" মনে পড়তেই চেয়ার ছেড়ে দুদ্দাড় করে বেরিয়ে পড়লেন রাম। উঠে পড়লেন গাড়িতে। অ্যাম্বাস্যাডর ছুটল ডানকুনির দিকে। ডানকুনিতে রামবাবুর একটা ডেরা ছিল। সেখানে স্নান সেরে, খেয়ে রাইটার্স রওনা হতেন তিনি। সেদিনও গাড়ি থামল ডানকুনির নির্দিষ্ট জায়গায়। গাড়ি থেকে নেমে রাম বললেন, "স্নানের সময় নেই রে। তাড়াতাড়ি জামা প্যান্টটা আন। ড্রেস চেঞ্জ করেই বেরিয়ে যাব।"
রামের কথা শুনে কাঠের মতো দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর নিরাপত্তারক্ষী। চোখ বিস্ফারিত, কেমন ঘাবড়ে আছেন।
দেখে রাম বললেন "কী ব্যাপার নিয়ে এসো জামা প্যান্ট।"
মানে স্যার,
কী মানে মানে করছো?
এত তাড়াতাড়ি উঠলেন, জামা প্যান্ট গাড়িতে তুলতে ভুলে গেছি।
অ্যাঁ। আঁতকে উঠলেন রাম, "বলিস কীরে হারামজাদা, ক্যাবিনেটে যাব কী পরে।" নিরাপত্তাকর্মীকে এই মারেন কী সেই মারেন দশা।
এর পরের দৃশ্য। রাইটার্স বিল্ডিংয়ের গাড়ি বারান্দা। মন্ত্রী রাম চ্যাটার্জির গাড়ি এসে পৌঁছল মহাকরণে। গাড়ি থেকে নামলেন মন্ত্রী। পরনে লুঙ্গি আর জামা। রাইটার্সের বিখ্যাত অলিন্দ দিয়ে হনহন করে যাচ্ছেন রোটানদায়। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ক্যাবিনেট বৈঠকে ঢুকে পড়েছেন। মুখ্যসচিব, অন্যান্য সচিব, মন্ত্রীরা ঢুকে গেছেন। এবার ঢুকছেন রাম। পরনে লুঙ্গি। দেখে তো সবাই থ! কেউ মিটিমিটি হাসছেনও।
জ্যোতিবাবু বললেন, "এ কী, আপনি লুঙ্গি পরে ক্যাবিনেট মিটিংয়ে এসেছেন?"
এতটুকু ঘাবড়ালেন না রাম চ্যাটার্জি। বললেন, "লুঙ্গি তো গরিব মানুষের পোশাক। আপনি তো গরিবের সরকার চালান, লুঙ্গি পরলে কী ক্ষতি!"
জ্যোতি বসু আর কী বলবেন! লোকটা মাঝেমধ্যে এমন কীর্তি করে বসেন, আর কিছু বলারও থাকে না। অথচ একথা কী করে ভুলবেন যখন সব ছেড়ে রাজনীতি শুরু করেছেন জ্যোতি বাবু। বিধায়কের মাইনে, তাও পার্টিকে দিয়ে দিচ্ছেন। স্ত্রী কমল বসুর সংসার চালাতে হাঁড়ির হাল দশা। তখন এই রাম চ্যাটার্জিই ভালো-মন্দ মাছ, সবজি, ফল নিয়ে হাজির হতেন প্রিয় নেতার বাড়িতে। এসব কথা তো বাইরের লোকের জানার কথা না। যাই হোক, রাম চ্যাটার্জি মানে সব দোষ মাফ। বৈঠক শুরু করলেন জ্যোতি বসু।
রামের নাম যত উল্কাবেগে ছড়িয়ে পড়ছিল, কুলীন মস্তানদের হতাশা ততই গাঢ় হচ্ছিল। তাদেরই একজন আজ পুলিশের স্যালুট পায় আর তারা এখনও 'অন্ধকার জগতের মানুষ' বলে বিবেচিত। এই বাস্তবতা কলকাতার রইস মস্তানদের জীবন তছনছ করে দিয়েছিল। রাম ওদের হারিয়ে দিয়েছে, এমনটাই ভাবতে লাগল তারা। রামের দেখাদেখি তাঁর বন্ধু ভানু বোসও নাম লিখিয়েছিল মার্ক্সবাদী ফরোয়ার্ড ব্লকে কিন্তু রাজনীতি তাঁর ধাতে নেই। ভোট এলে আশ্রয়দাতা কংগ্রেস নেতাদের জন্য ভোট করতে যান, আবার মার্ক্সবাদী ফরোয়ার্ড ব্লকও করেন। দুটো সম্ভব নয় কোনওভাবেই। তাই পেশাদার মস্তানের পরিচয় নিয়েই বেঁচে থাকতে হয় ভানুকে। রাজনীতি দুরাশা হয়ে যায়।
আরেকজন গোপাল পাঁঠা। আন্ডারওয়ার্ল্ডের বেতাজ বাদশা। রাম চ্যাটার্জির উত্থান এদের সবার জীবনে কী পরিমাণ ঈর্ষা আর হতাশার সঞ্চার করেছিল তা বোঝা যায় গোপাল পাঁঠার অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়লে। শেষ জীবনে গোপাল পাঁঠা এক সাময়িক পত্রে লিখেছিলেন আত্মজীবনী "আমার আমির অন্ধকারে"। এই ভাষ্যে গোপাল লিখছেন, "আমার কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে অনেকেই ফেরত দেয়নি। কত লোক রামায়ণের রামচন্দ্র হয়ে গেছে।" নাম না করে তাঁর ইঙ্গিত যে একদা তাঁরই অনুগামী রাম চ্যাটার্জির প্রতি তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। যদিও রাম চ্যাটার্জি গুরু গোপাল পাঁঠাকে সৌজন্য দেখাতে ভুলতেন না। মন্ত্রী হয়েও মস্তানতীর্থ মলঙ্গা লেনে এসেছেন রাম। গোপালকে বলেছেন, "দাদা একদিন আসুন রাইটার্সে আমার দফতরে।" গোপাল কোনওদিন যাননি।
আরও পড়ুন- মিতা বলে ডাকতেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতার ‘মস্তান’ ভানু বোসের ম্যাজিক আজও অমলিন
রাম চ্যাটার্জি উত্তরণের সুযোগ পেয়েছিলেন। গোপাল পাঁঠা, ভানু বোসরা পাননি। বিধানচন্দ্র, অতুল্য ঘোষরা মস্তানদের ব্যবহার করলেও কোনওদিন রাজনীতির বৃত্তে পা রাখতে দেননি। এখানেই জ্যোতি বসু ব্যতিক্রম। রামকে তিনি মন্ত্রী করেছিলেন। 'লুম্পেন প্রলেতারিয়েত'-কে রাজনীতির শক্তি হিসেবে যুক্ত করার শিক্ষা তাঁর ছিল। সেই জন্যই বোধহয় এই উদারতা দেখিয়েছিলেন হাজার সমালোচনা সত্ত্বেও। আর জীবনে এমন একটা সুযোগ পেয়ে বাস্তবিকই কল্পতরু হয়ে উঠেছিলেন রাম চ্যাটার্জি। দান-ধ্যান, ক্যালাকেলি, এলাকা চুপ করিয়ে রাখার ক্ষমতা আর তার সঙ্গে মজার কাণ্ডকারখানা তাঁকে কার্যত এক রূপকথার নায়ক করে তুলেছিল। শেষ জীবনে দল দেখতেন না। যে যাবে তাঁর কাছে ন্যায্য আবেদন নিয়ে, তিনি তারই পাশে আছেন। এরকমই একবার তাঁর সঙ্গে দেখা করলেন হুগলির ছাত্র পরিষদের তরুণ তুর্কি আব্দুল মান্নান। মান্নানের নাম তখন জেলা জুড়ে। তিনি এসেছেন বামফ্রন্টের মন্ত্রীর কাছে। মান্নানকে দেখেই রাম চ্যাটার্জি বললেন, "গুন্ডাও বলবে আবার সাহায্যও চাইবে! তা কী চাই বলো।"
আব্দুল মান্নান সবিনয়ে জানালেন, "আরামবাগ রামমোহন কলেজে ছাত্র পরিষদকে অনুষ্ঠান করতে দিচ্ছেন না অনিল বসু। আপনি অতিথি হয়ে এলে আমরা অনুষ্ঠানটা করতে পারি। আপনি দলের হয়ে না মন্ত্রী হিসেবে আসবেন।"
সেই সময় আরামবাগ জুড়ে অনিল বসু এবং আব্দুল মান্নানের লড়াই সবাই জানত। রাম চ্যাটার্জিও জানতেন। সব শুনে বললেন, "কলেজের ভেতর ইউনিয়ন তোমাদের, অনুষ্ঠান করবে তো সমস্যা কোথায়? এক কাজ করো, আমি যাব।"
অনুষ্ঠানের দিন গোটা এলাকা থমথমে। হঠাৎ একটা গাড়ি এসে থামল আরামবাগ সিপিআইএম পার্টি অফিসের সামনে। গাড়ি থেকে মুখ বাড়ালেন রাম চ্যাটার্জি।
"অনিল আছে নাকি রে..."
উত্তর এল, "না দাদা একটু বাইরে..."
শুনে রামের বাণী, "যেখানেই থাক জানিয়ে দিবি আমি রামমোহন কলেজে যাচ্ছি । কিছু গোলমাল হলে এমন মার মারব যে রাজ্যছাড়া করে দেব। বলে দিস।"
সেইদিন অনুষ্ঠান উতরে গেল ছাত্র পরিষদের। রাম তো সবার । যার সঙ্গে রাম থাকে তাকে ঠেকিয়ে রাখে কে!