ব্রাজিলের গদি উল্টোনো কতটা বাঁচাবে পৃথিবীর ফুসফুস আমাজনকে
Amazon forest: বিশ্বজুড়ে পরিবেশবিদরা এবং বিজ্ঞানীরা এখন এই আশাতেই বুক বাঁধছেন, যে সুসময় আসবে, আমাজন আবারও স্বমহিমায় পৃথিবীর বুকে রাজত্ব করবে।
বেলজিয়ামের আয়তন ৩০,৬৮৮ বর্গকিলোমিটার। একটি দেশের পরিপ্রেক্ষিতে আয়তনটি বেশ ছোট। ঠিকই। কিন্তু ভাবুন, ৩০,৬৮৮ বর্গকিলোমিটার সবুজের আচ্ছাদন যদি পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হয়? পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল যখন ধীরে ধীরে উত্তপ্ত হচ্ছে, বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবে যখন সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রত্যেকদিন একটু একটু করে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তখন এইভাবে জঙ্গলকে ধ্বংস করা মানবজাতির বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে না? আর যখন সেই অপরাধ সংগঠিত হয় একজন রাষ্ট্রপ্রধানের মদতে? তখন তাঁকে মসনদ থেকে সরিয়ে দেওয়াটাই হয়তো পবিত্র কর্তব্য হয়ে ওঠে।
সেই পবিত্র কর্তব্যই পালন করেছেন ব্রাজিলের জনগণ। রাষ্ট্রপতি জাইর বোলসোনারোকে গদিচ্যুত করে তাঁরা মসনদে ফিরিয়ে এনেছেন লুলা দ্য সিলভাকে। বোলসোনারো ক্ষমতায় থাকাকালীন ধৃষ্টতা দেখিয়েছিলেন, আমাজনকে তিলে তিলে ধ্বংস করে দেওয়ার। সেটা ছিল তাঁর ঘোষিত নীতি। তাঁর ক্ষমতায় থাকাকালীন ৩৪,০১৮ বর্গকিলোমিটার জঙ্গল ভষ্মীভূত হয়েছে। তিনি জিতলে এই সংখ্যাকে লক্ষ বর্গকিলোমিটারে পৌঁছে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করেছিলেন তিনি। পরিবেশই হোক, বা আদিবাসীদের অধিকার, কোনও কিছুকেই তিনি প্রাধান্য দিতে রাজি ছিলেন না। তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল, দেশের কৃষিব্যবসাকেই শুধুমাত্র প্রাধান্য দেওয়া। সেই কতিপয় মানুষের গোষ্ঠীকে আরও ধনী করে তুলে নিজের ফায়দা করা। কিন্তু ব্রাজিলের জনগণ ঐতিহাসিক এই নির্বাচনে সব হিসেব পাল্টে দিয়েছেন। তাঁরা জিতিয়ে এনেছেন শ্রমিকদের নেতা লুলা দ্য সিলভাকে।
লুলা ২০০৩ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত এর আগে ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি পদে থেকেছেন। কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক কেরিয়ারে চূড়ান্ত আঘাত আসে, যখন দুর্নীতির অভিযোগে তাঁকে জেলে যেতে হয়। যদিও পরবর্তীকালে সুপ্রিম কোর্ট তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা সেই অভিযোগ খারিজ করে দেয়। অভিযোগ মুক্ত হওয়ার পরেই রাজনীতির আঙিনায় ফেরত আসেন তিনি। ঘোষণা করেন, পুনরায় নির্বাচন লড়ার। এমন একটি সময়ে লুলা ফেরত আসেন, যখন ব্রাজিলের জনগণ দেখছে চূড়ান্ত বৈষম্য। গুটিকয়েক শিল্পপতির সম্পদ আকাশ ছুঁয়ে ফেলছে এবং দেশের গরিব জনগণ আরও দারিদ্রসীমার নিচে চলে যাচ্ছেন। সবথেকে বড় বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে ছিল আমাজন এবং সেখানে বসবাসকারী লক্ষ লক্ষ আদিবাসীরা। লুলা স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন দেশের, তথা পৃথিবীর সেই সম্পদকে রক্ষা করার, এবং আদিবাসীদের সুরক্ষা দেওয়ার। আজ তাঁর জয় নিশ্চিত হওয়ার পর অনেকেই আশায় বুক বাঁধছেন। সুদিনের আশা, সুসময়ের আশা।
আরও পড়ুন: দক্ষিণ আমেরিকায় লাল সূর্যোদয়? ব্রাজিলে বামপন্থী প্রেসিডেন্টের নির্বাচন যে প্রশ্ন তুলে দিল
কিন্তু লুলা কি প্রভাবশালী শিল্পপতিদের গোষ্ঠীকে রুখতে পারবেন? নিজের আট বছর ক্ষমতায় থাকাকালীন তিনি আমাজনকে রক্ষা করতে কতটা সফল হয়েছিলেন?
পরিসংখ্যান বলছে, লুলার প্রতিশ্রুতি ফাঁপা নয়। তাঁর ক্ষমতায় থাকাকালীন ব্রাজিলিয়ান আমাজনে বননিধন কমে গিয়েছিল আশি শতাংশেরও বেশি। লুলা যখন প্রথমবার ক্ষমতায় এসেছিলেন, তখনও পরিস্থিতি অনেকটা একরকম ছিল। সেই বছর ৬৩ লক্ষ একর জঙ্গলকে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু লুলা মাত্র এক বছরের মধ্যে সেই সংখ্যাকে মাত্র ১১ লক্ষ একরে নামিয়ে আনেন। Forest Code নামক একটি আইন প্রণয়ন করেন তিনি, যা বন-নিধনকারীদের শাস্তি দেবে, সেই সঙ্গে জঙ্গলে কড়া নজরদারি সুনিশ্চিত করবে। বলাই বাহুল্য, লুলার এই পদক্ষেপ আমাজনকে রক্ষা করতে সফল হয়েছিল। শুধু তাই নয়, লুলার সরকার বেশ কিছু স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠায়, যাতে আমাজনকে আরও নিশ্ছিদ্রভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারে। এই সমস্ত পদক্ষেপের ফলাফল ছিল অ্যামাজনের দুরন্ত স্বাস্থ্য। কিন্তু ২০১৯ সালের নির্বাচন সব পাল্টে দেয়।
ক্ষমতায় আসেন দক্ষিণপন্থী নেতা জাইর বোলসোনারো। তাঁর ঘোষিত নীতি ছিল, আমাজনকে ব্যবসার জন্য উপলব্ধ করা। তিনি লুলা সরকারের সমস্ত নীতি খারিজ করে দেন, বিজ্ঞান এবং পরিবেশ নিয়ে কাজ করা সমস্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানের বরাদ্দ কমিয়ে দেন এবং পরিবেশবিদদের বরখাস্ত করেন। শুরু হয় নির্বিচারে বননিধন যজ্ঞ। ২০১৯ সালের ১ অগাস্ট থেকে ২০২১ সালের ৮৪ লক্ষ একর জঙ্গল পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ২০২০ সালেই আমাজনে ভয়াবহ দাবানল হয়। অভিযোগ ওঠে, বোলসোনারোর প্রচ্ছন্ন মদতেই এই দাবানল সংগঠিত করা হয়েছে। মজার বিষয় হলো, তিনি এই অভিযোগ খারিজ করার বিশেষ তাগিদ দেখাননি। ২০২১ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, আমাজনের ১৭ শতাংশ অংশ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। যদি সেই সংখ্যা কোনও ভাবে ২০ থেকে ২৫ শতাংশের কাছে পৌঁছে যায়, তাহলে ভয়াবহ বিপদ আসন্ন।
আমাজন যদি কোনও ভাবে ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে গোটা পৃথিবীতে সবার আগে ঘাটতি হবে অক্সিজেনের। ছয় শতাংশের ওপর অক্সিজেন প্রস্তুত হয় শুধুমাত্র এই রেনফরেস্টে। সেই অক্সিজেন প্রস্তুত করে প্রায় ৩৯০ বিলিয়ন গাছ এবং তাদের আচ্ছাদনে আশ্রয় নিয়েছে পৃথিবীর মোট প্রাণী-প্রজাতির দশ শতাংশ। সেই সঙ্গে ৪০,০০০ প্রজাতির উদ্ভিদ। বিভিন্ন ধরনের খাদ্য থেকে শুরু করে ওষুধ, সবকিছু আসে শুধুমাত্র আমাজন থেকে। এতটাই সম্পদশালী এই জঙ্গল। এই জঙ্গলের স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য প্রয়োজন সমস্ত প্রাণীরও সুরক্ষিত থাকা; কারণ তারা সেই বাস্তুতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ এবং অবিচ্ছেদ্য অংশ, এবং এই গ্রহে সমস্ত প্রকারের প্রাণকে জলবায়ু পরিবর্তনের হাত থেকে বাঁচাতে প্রয়োজন আমাজনকে সুরক্ষিত রাখা। সেই সঙ্গে আরও একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। আমাজন শুধুমাত্র অনেক পরিমাণে অক্সিজেন প্রস্তুত করে না। তা কার্বনকে ধরেও রাখে। যদি কোনও ভাবে আমাজন ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে সেই সমস্ত গ্রিন হাউজ গ্যাস বায়ুমণ্ডলে মিশে যাবে এবং বিশ্ব উষ্ণায়ন আরও দ্রুত গতিতে তীব্র আকার ধারণ করবে।
লুলা বলেছেন, তিনি তাঁর অসম্পূর্ণ কাজকে আবার নতুন করে শুরু করবেন। বিশ্বজুড়ে পরিবেশবিদরা এবং বিজ্ঞানীরা এখন এই আশাতেই বুক বাঁধছেন, যে সুসময় আসবে, আমাজন আবারও স্বমহিমায় পৃথিবীর বুকে রাজত্ব করবে।