জি ২০: মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে
২০২৩ সালের HUNGER INDEX বলছে, ১২১ টি দেশের মধ্যে ১০৭ এ অবস্থান ভারতের।
মুখ দেখানোর উপায় নেই। কারণ, রাজধানী ঢেকে গেছে বিজ্ঞাপনে। বড় বড় হোর্ডিং জুড়ে জি ২০-র লোগো। শহরের কালিমা মুছতে কলোনিতে কলোনিতে পর্দা টাঙিয়েছে রাজার পেয়াদারা। যাবতীয় মলিনতা চাপা দিতে সদা সতর্ক পাইক বরকন্দাজ। ২০২৩ সালের জি ২০ সামিট হচ্ছে ভারতে। সারা বিশ্ব থেকে আসছেন প্রতিনিধিরা। তাঁদের আমন্ত্রণে বিশেষ 'আকর্ষণ' স্বরূপ গেছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিশেষ পরিচয়। প্রাইম মিনিস্টার, ভারত। ইণ্ডিয়া নাম কি তবে অস্ত যাওয়ার মুখে? শোরগোল রাজনৈতিক মহলে।
এবারের সামিটের থিম 'One Earth, One Family, One Future'. এই থিম নিয়ে নিঃসন্দেহে তুমুল আগ্রহী 'এক দেশ, এক নাম, এক ভোট'-এর প্রবক্তা। কিন্তু আসল ভারত? কোথায় দাঁড়িয়ে আছে সেই দেশ? কিছু তথ্যপ্রমাণসহ সেই ছবিটিরই হদিশ মিলবে এই আলোচনায়।
২০২৩ সালের HUNGER INDEX বলছে, ১২১ টি দেশের মধ্যে ১০৭ এ অবস্থান ভারতের। যাবতীয় কোন্দলের শেষে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া এক রাষ্ট্র, যার থেকে বিশ্ব খাদ্য সূচকে এগিয়ে আছে পাকিস্তানও। তালিকায় আছে ৯৯তম স্থানে। World Happiness Index 2023, সমীক্ষা দেখাচ্ছে ১৩৬ টি দেশের মধ্যে ১২৬ এ ভারত। কী জীর্ণ এক দৈন্য ঘিরে রেখেছে স্বদেশের মাটিকে। প্রতিবেশী সব দেশের মানুষ আমাদের চেয়ে বেশি আনন্দে বাঁচেন প্রতিদিন, সেই চিত্রই দেখাচ্ছে এই সমীক্ষা। CEMIE এর রিপোর্ট বলছে ৪৫.৮% যুব বেকার এই দেশে। গড়ে প্রতিদিন আত্মহত্যা করেন ৪০ জন কৃষক। ৪ মাসেরও বেশি সময় ধরে উত্তপ্ত মণিপুর। কুকি-মুক্ত মণিপুর গড়তে সেখানে তুঙ্গে সেনা-জনতা উত্তেজনা। রাজধানী দিল্লি ডুবে আছে ভরা বর্ষার বন্যায়। এই স্থবির সভ্যতার অচলাবস্থাকেই কি ঢেকে ফেলতে চাইছে সরকার?
আরও পড়ুন- বিলাসবহুল গাড়ি, লিফট! জি ২০ সম্মেলনে কোথায়, কীভাবে থাকছেন বাইডেন, সুনাকরা?
উল্লেখ্য, চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিংপিং এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন আসছেন না জি২০ সামিটে। সেই বিষয়েও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের জল্পনা তুঙ্গে। এলেই বা কতটুকু দেখা যেত আসল ভারতের ছবি? উঠছে প্রশ্ন। সামিট উপলক্ষে সেজে উঠেছে দিল্লির রাজপথ। কোথাও বসছে জলের ফোয়ারা, কোথাও বিশাল বিজ্ঞাপনী ব্যানার জুড়ে বিরাজ করছেন প্রধানমন্ত্রী, কোথাও নতুন রঙে মুছে ফেলা হয়েছে পুরনো গ্লানিময় শহরের চালচিত্র। সবচেয়ে আশ্চর্যজনকভাবে বেশ কিছু কলোনি এলাকায় মুছে ফেলতে চাওয়া হয়েছে খোদ বসবাসকারী মানুষেরই অস্তিত্ব। শাহিনবাগ হয়ে হরিয়ানা, বারবার দরিদ্র মানুষের ঘর ভেঙে দিয়ে গেছে রাষ্ট্রের বুলডোজার। এবার শহর জুড়ে বিশাল পর্দা টাঙিয়ে যেন তাঁদের উপস্থিতিটিকেই লজ্জাজনক কোনও ভুল হিসেবে দাগিয়ে দিল সেই রাষ্ট্র। আর কে পুরম এলাকায় কত ঘর ভেঙে দিয়ে গেছে সামিটের তল্পিবাহকরা।
এক পৃথিবী, এক প্রকৃতি, এক ভবিষ্যৎ। যদিও ভবিষ্যতের তারতম্য ঘটে যাচ্ছে তার কেন্দ্রভূমিতেই। অক্সফাম ইণ্ডিয়া, ২০২২ সালে তাদের 'Inequality Kills' শীর্ষক রিপোর্টে জানিয়েছে, ভারতে ধনীতম ১০ জনের সম্পদ, আগামী ২৫ বছর চালাতে পারে দেশের সমস্ত স্কুল-কলেজের যাবতীয় খরচ। তবু বাড়ছে স্কুলছুটের সংখ্যা। রেগার বরাদ্দ কমছে। আর পর্দার আড়ালে থাকা মানুষগুলোর অস্তিত্ব ভুলিয়ে দেওয়ার অবশ্যম্ভাবী প্রয়াস চলছে এই জি২০ তেই। শুধু মানুষই নয়, সরিয়ে ফেলা হচ্ছে রাস্তার কুকুর, মেরে ফেলা হচ্ছে আকাশের পাখি। কোন প্রকৃতির জয়গান গাইতে চাইছে এই সামিট?
শুক্রবার থেকে কার্যত গৃহবন্দি হয়ে পড়েছেন শহরবাসী। বাইরে চলছে প্রশাসনের উৎসব। অধিকার নেই গড়পড়তা শহরবাসীর। রাস্তায় রাস্তায় জারি ১৪৪ ধারা। ২৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে এই সামিটের জন্য। এর মধ্যে ৪৬০৪ কোটি টাকা সরকার খরচ করেছে সৌন্দর্যায়নের পেছনে। যে এলাকা সৌন্দর্যায়নেরও 'অযোগ্য', পর্দা টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে সেইসব এলাকায়। ভোল বদলালো রাজধানীর। কিন্তু, জনগণের স্বার্থ সরকারের এই রোল বদল হবে কবে?