খোদ নেতাজির নামেই আস্ত একটি স্টেশন, কী ঘটেছিল এখানে? যে ইতিহাস ভুলতে বসেছে মানুষ

Gomoh Station Netaji : এই স্টেশনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এই বাংলা। জড়িয়ে রয়েছেন স্বয়ং নেতাজি। আজ সেসব ভুলতে বসেছে বাঙালি।

ঝাড়খণ্ডের ধানবাদ। কয়লা, শিল্প নিয়ে বহুদিন ধরেই ভারতের মানচিত্রে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে এই শহরটি। এরই একটি জংশন স্টেশন হল গোমো বা গোমহ (Gomoh)। ভারতের অন্যান্য জংশন স্টেশনের মতোই তার চরিত্র। সেই এক ভিড়, হকারের কোলাহল, ব্যস্ততা - আপাতদৃষ্টিতে খুব একটা আলাদা নয়। তবুও এই স্টেশনে দাঁড়ালে কেমন যেন একটু শিহরণ লাগে।

প্ল্যাটফর্মে বড় বড় অক্ষরে লেখা ‘গোমো’। সেইসঙ্গে লেখা আরও একটি নাম – ‘নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস জংশন’। ভারত এবং বাংলার এই বীরপুরুষ, স্বাধীনতা সংগ্রামীর নামে রয়েছে আস্ত একটি স্টেশন, এটা তো ভালো কথা! কিন্তু গোমো স্টেশনই কেন? কারণ এর সঙ্গে জুড়ে রয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অধ্যায়। এই স্টেশনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এই বাংলা। জড়িয়ে রয়েছেন স্বয়ং নেতাজি। আজ সেসব ভুলতে বসেছে বাঙালি।

আরও পড়ুন : সাবমেরিনে ৯৭ দিন, নেতাজির জীবনের ভয়াবহ অ্যাডভেঞ্চার স্তম্ভিত করে আজও

কী সেই শিহরণ জাগানো ইতিহাস? সেটা দেখতে গেলে ফিরে যেতে হবে প্রায় ৮২ বছর আগে। সালটা ১৯৪১। সুভাষচন্দ্র বসু তখনও ‘নেতাজি’ হননি। কলকাতার এলগিন রোডের বাড়িতে গৃহবন্দি হয়ে বসে আছেন তিনি। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে আটকে রেখেছে। কড়া নজরদারি রয়েছে তাঁর ওপর। বাড়ির চারিদিকে প্রহরী ও পুলিশ অফিসারদের আনাগোনা। কিন্তু এভাবে বাড়ির ভেতর বসে থাকলে কী করে দেশের কাজ হবে? স্বাধীনতার লড়াই-ই একমাত্র লড়াই। দেশকে স্বাধীনতা দেওয়াই একমাত্র লক্ষ্য সুভাষের। দু’চোখের পাতা এক হচ্ছে না কিছুতেই। তার জন্য তো এই বাড়ি থেকে বেরোতে হবে! কেবল এলগিন রোডের বাসভবনেই নয়, গোটা দেশেই রয়েছে ব্রিটিশদের চর। সুভাষ যে ইংরেজদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছেন! এত সহজে কি ছেড়ে দেবে তাঁকে…

উপায় একটা আছে। কিন্তু তার জন্য সংসার, বাড়ি, পরিজন সমস্ত কিছু ত্যাগ করতে হবে। তৈরি করতে হবে নিজের সেনা। বাইরে থেকে সাহায্য নিয়ে দেশে ঢুকতে হবে। ব্রিটিশদের গদিছাড়া না করে যে শান্তি নেই! সুভাষ তো চুপ করে বসে থাকার পাত্র নন! পরিকল্পনা তৈরি হল। ব্রিটিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালাতে হবে। ভাইপো শিশির বসুর সঙ্গে সমস্ত কিছু ছকে নেওয়া হল। ১৯৪১ সালের ১৮ জানুয়ারি। রাতের বেলা এলগিন রোডের বাড়ির দরজায় গোপনে এসে দাঁড়াল প্রিয় ‘বেবি অস্টিন’ গাড়িটি। শিশির বসুর সঙ্গে সেই গাড়িতে উঠলেন এক দীর্ঘদেহী ‘পাঠান’। বিশেষ পোশাকে সজ্জিত তিনি। তাঁকে নিয়েই গাড়ি ছুটল। ব্রিটিশ পুলিশ জানতেও পারল না, ওই পাঠানই আসলে সুভাষ বসু!

আরও পড়ুন : নেতাজির অন্তর্ধানের পর চুরি যায় আজাদ হিন্দের ২৫০ কোটির সম্পত্তি! নেপথ্যে ছিলেন কারা?

এক নিঃশ্বাসে, দ্রুতগতিতে চলছে অস্টিন গাড়িটি। কোথাও থামা যাবে না। সুভাষ জানেন, ব্রিটিশ সরকার তাঁকে খুঁজতে ঠিকই বেরিয়ে পড়বে। গোটা পূর্ব ভারতে ছড়িয়ে পড়বে পুলিশের চর। যা করার আজ রাতেই করতে হবে। ধানক্ষেত, ব্রিজ, পুকুর, নদী – পেরিয়ে গেল সব। সুভাষ দাঁতে দাঁত চেপে বসে রয়েছেন গাড়িতে। গভীর রাতে সেই গাড়ি এসে থামল ধানবাদে। পাহাড়ের সারির মাঝে একটুখানি জায়গা, সেখানে রেললাইন। রয়েছে গোমো স্টেশন। গাড়ি থেকে চারিদিক দেখে নামলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। একটা ট্রেন এগিয়ে আসছে। তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়াল ট্রেনটি। এতে করেই সোজা চলে যেতে হবে পেশোয়ার। তারপর সেখান থেকে কাবুল। তারপর? পরিকল্পনার ঝড় চলছে সুভাষের মনে। সুভাষকে বোঝা যে বড় শক্ত!

১৯৪১ সালের জানুয়ারি মাসেই গোমো স্টেশন থেকে বরাবরের মতো কলকাতা ছাড়েন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। ওইদিনই হয়েছিল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের ‘দ্য গ্রেট এসকেপ’। নেতাজির মহানিস্ক্রমণ। ব্রিটিশের চোখে ধুলো দিয়ে দেশ ছাড়েন তিনি। আর সেই সন্ধিক্ষণেই দাঁড়িয়ে আছে এই গোমো স্টেশন। আজও সেই স্মৃতি বহন করে চলেছে এটি।

আরও পড়ুন : নিজের হাতে ভাত বেড়ে খাওয়াতেন নেতাজিকে, স্বাধীনতার ঐতিহ্য বহাল শতাব্দী প্রাচীন হোটেলে

২০০৯ সালে নেতাজির জন্মদিনে এই স্টেশনটি সংস্কার করে নতুন করে উদ্বোধন করেন তৎকালীন রেলমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব। সেইসঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকার এই স্টেশনটির নাম রাখে ‘নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস জংশন’। স্টেশনেই নেতাজির একটি মূর্তি বসানো রয়েছে। কিন্তু বাঙালির ইতিহাস থেকে গোমো স্টেশন কি একেবারেই হারিয়ে গেল? নেতাজির জীবনের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে যে স্টেশন, যার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে কলকাতা, এলগিন রোড, বেবি অস্টিন গাড়িটি… তাকে একবার মনে করতে পারি না আমরা?

More Articles