রেসকোর্স থেকে জ্যোতিষ চেম্বার! কলকাতা পুলিশের রহস্যভেদ হার মানাবে ওয়েব সিরিজকেও!
Kolkata Police Murder Mystery: “বিশ্বাস করুন স্যার আমি খুন করিনি! ওরা খুন করেছে স্যার, আমি বারণ করেছিলাম। সুরজিৎদা আমায় বাঁচান, বিশ্বাস করুন আমি খুন করিনি!”, শুভজিৎ, সুরজিৎ দু'জনেই থ!
“তির গতিতে ছুটছে সি-লায়ন, আর একটু গেলেই ফিনিশ লাইন। সি-লায়নের সঙ্গে গলায় গলায় দৌড়াচ্ছে ক্যামিলা। কেউ কাউকে এক ইঞ্চি জমি ছাড়ছে না। এদিকে পিছন থেকে নিজের গতি বাড়িয়ে এগিয়ে আসছে সিলভার ট্রেস এবং ইস্টউড। ৪০০ মিটার মার্ক পেরিয়ে গেছে। কিন্তু একী! সি-লায়নকে পিছনে ফেলে দিয়ে এগিয়ে চলছে ক্যামিলা। পিছন থেকে উঠে আসছে ইস্টউড। আর বাকি ২০০ মিটার! ক্যামিলা না ইস্টউড, ইস্টউড না ক্যামিলা! বলতে বলতেই ফিনিশ লাইন পেরিয়ে গেল ক্যামিলাআআআ!” ধীরে ধীরে নিজের স্বরকে স্বাভাবিক করে আনলেন ধারাভাষ্যকার। গোটা গ্যালারি জুড়ে উত্তেজনা। কিন্তু সেসবের দিকে মন নেই শুভজিতের। তাঁর চোখ গ্যালারির দিকে। ঘোড়দৌড়ের প্রতি বিশেষ আগ্রহ কোনওকালেই নেই। আজকে প্রথম সে এসেছে রেসকোর্সে। গত সপ্তাহে ফোন কলটা না হলে হয়তো তাঁকে আসতেও হত না। কিন্তু কী আর করার, তদন্তের স্বার্থে আসতেই হয়েছে। আরও কতবার যে আসতে হবে জানা নেই।
১৬ অগাস্ট, ২০০৭। সবে আধঘণ্টা হয়েছে থানায় ঢুকেছেন শুভজিৎ। ফোনটা বেজে উঠল। অপর প্রান্ত থেকে লোকটি কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলেন, “স্যার এখানে একটা খুন হয়ে গেছে। ২৪ পার্ক রোড, শিগগির আসুন স্যার।” ফোনটা কেটে গেল। তড়াক করে সোজা হয়ে বসলেন শুভজিৎ। পার্ক রোড টালিগঞ্জ থানা থেকে পাঁচ মিনিটের পথ। বহুদিন হয়ে গেল কোনও ভালো কেস পাননি শুভজিৎ। বছর তিরিশের এই যুবকের পুলিশ হওয়ার পিছনে অনেক বড় হাত আছে বাংলা সাহিত্যের গোয়েন্দাদের। ফেলুদা থেকে ব্যোমকেশ, চেটে খাওয়া তাঁর। তৎকালীন টালিগঞ্জ থানার সাব-ইন্সপেক্টর শুভজিৎ সেনও আশা করেছিলেন গল্পের মতোই দারুণ দারুণ কেস পাবেন। কিন্তু কয়েকদিন অফিস করেই বুঝতে পারলেন সে গুড়ে বালি। বাস্তব বড়ই ফিকে। তবে ফোনটি আসায় বহু বছর পর এই ফিকে হয়ে যাওয়া ফ্যান্টাসির মধ্যে নতুন প্রাণের আভাস এল যেন। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন শুভজিৎ, গন্তব্য ২৪ পার্ক রোড।
দূর থেকেই শুভজিৎ দেখতে পান বাড়ির সামনে একটা জটলা। আসলে ঠিক বাড়ি নয়, একই ঠিকানায় দু’টি বড় বড় অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে। সামনের দিকের অ্যাপার্টমেন্টটি ২৪-এ, পিছনের দিকের অ্যাপার্টমেন্টটি ২৪-বি। উর্দি পরা শুভজিৎকে দেখে এগিয়ে আসেন প্রায় তাঁরই বয়সী একজন। “নমস্কার স্যার, আমিই আপনাকে ফোন করেছিলাম। আমার বাড়ি এই সামনেই। আমি সকালবেলা বাজার করে ফিরছিলাম, তখন দেখি ওদের ঘর পরিষ্কার করার ছেলেটি চিৎকার করতে করতে বেরিয়ে আসছে ২৪ নম্বর থেকে। ওর মুখে চোখে ভয়। ওর হাতের ইশারা দেখে আমি ঢুকলাম ২৪-বি তে। একটা গা গুলিয়ে ওঠা গন্ধ ছিল চারিদিকে স্যার। টপ ফ্লোরে উঠে দেখলাম ফ্ল্যাটের দরজা খোলা। ঢুকে দেখি হাত পা বাঁধা অবস্থায় পরে আছে শ্যামাপ্রসাদ বাবুর দেহ...” বলতে বলতে রীতিমতো কাঁপছে ভদ্রলোকের হাত পা।
আরও পড়ুন- কলকাতা ভোলেনি বন্দরের ‘গ্যাংযুদ্ধ’! সেকালের হত্যাকাণ্ডের সমাধানে ঘুম উড়েছিল পুলিশের
“আচ্ছা, আমি দেখছি”, ছোট্ট জবাব দিয়ে এগিয়ে যান শুভজিৎ। উঠতে উঠতেই বিকট গন্ধ! পচে যাওয়া লাশের গন্ধ। তিন তলা অ্যাপার্টমেন্ট দু’টির প্রত্যেকটিতে তিনটে করে মোট ছ’টা ফ্ল্যাট আছে। ২৪-বি অ্যাপার্টমেন্টের তিনতলায় পৌঁছে শুভজিৎ দেখেন হাত-পা বাঁধা অবস্থায় মাটির সঙ্গে হাঁটু মুড়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে একটি দেহকে। মুখে কাপড় গোঁজা রয়েছে। দেহে ইতিমধ্যেই পচন শুরু হয়ে গিয়েছে। মধ্য পঞ্চাশের এই ভদ্রলোকের পরণে হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি। নাক আর ঠোঁটের কোণ দিয়ে বেরোচ্ছে রক্ত। গায়ে-হাত-পায়ে কিছু আঘাতের চিহ্ন। তবে দেখে মনে হচ্ছে সেটা আত্মরক্ষার্থে। দেহটাকে বাঁচিয়ে ফ্ল্যাটে ঢোকেন শুভজিৎ। মোটামুটি ৬৫০ স্কোয়ার ফুটের ফ্ল্যাট। একটা মাঝারি সাইজের ড্রয়িং কাম ডাইনিং, একটা বড়সড় বেডরুম, একটা কিচেন, একটা বাথরুম এবং একটা সরু ব্যালকনি। এরপর বড়বাবুকে ফোন করে নিচে নেমে আসেন শুভজিৎ। ঘর পরিষ্কার করতে আসা ছেলেটির সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন, দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল না। একটা অদ্ভুত গন্ধ পাচ্ছিল সে। তাতেই সন্দেহ বাড়ে। বারবার বেল বাজানোর পরেও যখন কেউ খুলছিল না তখন বাধ্য হয়ে দরজা খুলে ফেলে ছেলেটি। দরজা খুলে বাড়ির মালিক শ্যামাপ্রসাদ বাবুকে থাকতে দেখে লোক ডাকতে ছুট মারে সে। প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে শুভজিৎ জানতে পারেন মৃতের নাম, শ্যামাপ্রসাদ রায়। বয়স ৫৪ বছর। পেশায় উকিল এই মানুষটি একাই থাকতেন ফ্ল্যাটে। পাড়া-প্রতিবেশীদের সঙ্গে মিশতেন না সেরকম। বিয়ে করলেও বছর দশেক আগে তাঁর স্ত্রী কন্যা-সহ, শ্যামাপ্রসাদকে ছেড়ে চলে গিয়েছেন বাপের বাড়ি।
শুভজিতের ফোন করার কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসে পুলিশ। সন্ধ্যা নামতেই ঠিক হল তদন্ত করবে টালিগঞ্জ থানা এবং দরকারে তাকে সাপোর্ট করবে লালবাজার হোমিসাইড ডিপার্টমেন্ট। তদন্তের ভার পড়ল শুভজিতেরই উপর। ততক্ষণে হাতে চলে এসেছে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট। রিপোর্টে বলা হয়েছে, মুখের মধ্যে কাপড় গুঁজে দেওয়ার কারণেই শ্বাসরোধ হয়ে মারা গিয়েছেন শ্যামাপ্রসাদ রায়। মৃত্যুর সময় আনুমানিক ৬৬ থেকে ৭২ ঘণ্টা আগে। অর্থাৎ খুন হয়েছে ১৪ অগাস্ট, বিকেলবেলা। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, শ্যামাপ্রসাদ বাবুর ঘরে ৪০০০ টাকা থাকলেও তা ছুঁয়ে পর্যন্ত দেখেনি আততায়ীরা। তাহলে কি আততায়ীরা চুরি করতে আসেনি? অন্য কোনও কারণে এসেছিল? প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে শুভজিৎ জানতে পারেন, সেদিন দুপুরবেলা কোর্ট থেকে ফিরে আর সারাদিন বাড়ি থেকে বেরোননি শ্যামাপ্রসাদ।
৭২ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও কেসের কোনও সুরাহাই মিলছে না। ইতিমধ্যেই শ্যামাপ্রসাদের মেজ ভাই সলিলপ্রসাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। প্রায় ৭০ বছরের বৃদ্ধ সলিল বাবু জানিয়েছেন, বাবার তিন ছেলের মধ্যে সবচেয়ে ছোট শ্যামাপ্রসাদই। তিনি মেজ এবং বড় ভাই বহু বছর আগেই কলকাতা ছেড়ে চলে গিয়েছেন। তিনি নিজে থাকেন জৈনুদ্দিন মিস্ত্রি লেনে। বাবা কারবার করে অনেক সম্পত্তিই করেছিলেন। তার মধ্যে পার্ক লেনের এই অ্যাপার্টমেন্ট দু’টি দিয়ে যান ছোট ছেলে শ্যামাপ্রসাদ রায়কে। মোট ছয়টি ফ্ল্যাটের মধ্যে পাঁচটি ফ্ল্যাট বিক্রি করে ভালই অর্থ পেয়েছিলেন তিনি। শুধুমাত্র একটি ফ্ল্যাটে নিজে থাকতেন। হাইকোর্টের দুঁদে উকিল শ্যামাপ্রসাদ রায় নিজেও বিষয় সম্পত্তি করেছিলেন ভালোই। বছর দশেক আগে শ্যামাপ্রসাদকে ছেড়ে চলে গিয়েছেন তাঁর স্ত্রী। তিনি মেয়েকে নিয়ে গোলাম মহম্মদ শাহ রোডে নিজের বাপের বাড়িতে থাকেন। মেয়ে ক্লাস এইটে পড়ে। বেহালায় স্কুল বোর্ডিংয়েই বেশিরভাগ থাকে সে। সলিলবাবুর সঙ্গে কথা বলে শুভজিৎ দেখা করতে গেলেন কৃষ্ণা দেবী অর্থাৎ শ্যামাপ্রসাদ রায়ের স্ত্রীয়ের সঙ্গে। ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা বলার সময় শুভজিৎ লক্ষ্য করলেন স্বামীর মৃত্যুর বিন্দুমাত্র শোক নেই। একটু ইতস্তত করেই শুভজিৎ জিজ্ঞেস করে বসলেন, “ম্যাডাম আপনারা আলাদা থাকতেন কেন... মানে ওঁর কি অন্য কোনও মহিলার সঙ্গে অ্যাফেয়ার বা...”- শুভজিৎকে মাঝপথে থামিয়েই কৃষ্ণা দেবী বলা শুরু করেন, “ওর মতো এত আত্মকেন্দ্রিক মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। নিজের বাইরে কিছুই বুঝত না। এই দেখুন না, এত বছর তো আছি আলাদা, এটার সম্পর্কে পর্যন্ত কোনওদিনও খোঁজ নেয়নি। তবে আমি থাকাকালীন তো ওর কোনও পরকীয়া সম্পর্কে কিছু শুনিনি। চলে আসার পরে কোনও মহিলার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছে কিনা বলতে পারব না।”
এইটুকু কথা বলেই উঠে পড়েন শুভজিৎ। দেহ উদ্ধার হওয়ার তিন দিনের মাথায় হাতে এল শ্যামাপ্রসাদ রায়ের কল লিস্ট। বিগত এক মাসে একটি বিশেষ নম্বরে বেশ দীর্ঘ ফোনালাপ চলত শ্যামাপ্রসাদের। খোঁজ লাগিয়ে শুভজিৎ জানতে পারেন নম্বরটি কসবা নিবাসী বিপ্লব ঘোষ নামে এক ব্যক্তির। সেদিন রাতেই বিপ্লব ঘোষের বাড়ি যান শুভজিৎ। বছর বাহান্নর বিপ্লব ঘোষকে দেখে মনে হয় না কোনওদিনও পিঁপড়েও মেরেছেন। অত্যন্ত গোবেচারা লোক খুন এবং পুলিশ শুনে ঘাবড়ে গিয়েছেন। তাঁকে শান্ত করিয়ে বসান শুভজিৎ। বিপ্লববাবু জানান, বছর দুয়েক আগে তাঁর সঙ্গে শ্যামাপ্রসাদের আলাপ হয়েছিল রেসকোর্সে। তাঁদের মধ্যে ফোনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রেস নিয়ে কথা হতো। প্রত্যেক শনিবার নিয়ম করে রেসকোর্সে যেতেন শ্যামাপ্রসাদ রায়। তবে বিপ্লববাবু অবশ্য মাসে দু’বারের বেশি যান না রেসকোর্সে। “সব জুয়াড়িদের যে সমস্যা, শ্যামেরও তাইই হয়েছিল। যতটা না জিতত, তার থেকে অনেক বেশি খুইয়ে আসছিল। আমি বহুবার সাবধান করেছিলাম, এবার সমঝে খেলো। কিন্তু কে শোনে কার কথা। ওর পাঁচটা ফ্ল্যাট বিক্রি হয়েছিল বলে হাতে বেশ কিছু টাকা পেয়েছিল। কিন্তু কথায় আছে কুবেরের ধনও ফুরিয়ে যায়,” বলছিলেন বিপ্লব। “আপনার সঙ্গে শেষ বার কবে দেখা হয়েছিল শ্যামাপ্রসাদ বাবুর?” জবাবে বিপ্লব বলেন, শেষ দু’টি শনিবার তিনি রেস কোর্সে যাননি। তার আগের শনিবার শেষবার দেখা হয়েছিল শ্যামাপ্রসাদের সঙ্গে। শুভজিৎ বেশ বুঝতে পারেন একবার তাঁকে রেসকোর্সে ঢুঁ মারতেই হবে। বিপ্লববাবুকে সে কথা বলতেই তিনি শুভজিৎকে মণিময় বলে একটি ছেলের নম্বর দিয়ে দেন। মণিময় ছেলেটি খুব ভালো এবং তদন্তের ক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে বলে আশ্বাস দেন বিপ্লব। পরদিন শুভজিতের গন্তব্য স্থল হলো রেসকোর্স।
রেসকোর্সে প্রথম রেস শেষ হলে শুভজিতের সঙ্গে দেখা হয় মণিময়ের। বিপ্লববাবু আগেই সব বলে রাখায় নতুন করে জানাতে হল না। বিগত সপ্তাহগুলিতে রেসের সময় শ্যামাপ্রসাদের মধ্যে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করেছে কিনা জিজ্ঞেস করায় মণিময় বলে, “শ্যামদা আমাদের রেগুলার কাস্টমার ছিলেন। বিপ্লবদার মুখে ওঁর খুনের খবর শুনলাম। সাধারণত খুব একটা কথা বলতেন না শ্যামদা। কিন্তু গত দু'সপ্তাহ ধরে একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করতাম। বছর ২৩-২৪ এর তিনটে ছেলের সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে কথা বলতেন শ্যামদা। রেসের সময় অন্য কারও সঙ্গে কথা বলা ওঁর ধাতে ছিল না। এই বিষয়টা একটু অবাক লাগলেও সেভাবে আমল দিইনি তখন।” ছেলেগুলিকে দেখতে কেমন জিজ্ঞেস করায় মণিময় জানায়, ছিপছিপে, ময়লা গায়ের রং ছেলেগুলোর। সবারই মাঝারি হাইট। এতটুকু বিবরণ দিয়ে ওরকম ভরা গ্যালারিতে কোনও মানুষকেই চেনা যায় না। এক প্রকার নিরাশ হয়েই অফিস ফেরেন শুভজিৎ।
রাতে বাড়ি ফেরার পথে গিরিশ পার্কে বন্ধু সুরজিতের দোকানে গাড়ি দাঁড় করান শুভজিৎ। বিকেলে ডিসি সাহেব ফোন করে জিজ্ঞেস করেছেন কেসের প্রগ্রেস কী? প্রগ্রেস বলতে গিয়ে মাথা নিচু হয়ে গিয়েছে। সব মিলিয়েই মনটা বেশ বিষণ্ণ। এই মুহূর্তে চায়ের অত্যন্ত প্রয়োজন, চা-টা ব্যাপক খাওয়ায় সুরজিৎ। শুভজিতের এই বন্ধুটির গিরিশ পার্কে একটি জিম এবং জ্যোতিষের চেম্বার রয়েছে। সুরজিতের সঙ্গে কথা বলতে বলতে শুভজিৎ বলেন, “একটা খুনের কেস নিয়ে বিচ্ছিরি রকম আছি ভাই। দেখ না তোর কাছে পাথর-ফাথর কিছু আছে কিনা। যদি পরে একটু দুঃসময় কাটানো যায়।” শুভজিতের কথা শুনে হেসে গড়িয়ে পড়েন সুরজিৎ। হাসতে হাসতে বলেন, “সকাল থেকে সব আজব আজব কাণ্ড দেখছি শুভজিৎদা। এখন তুমি পাথর চাইছ আর আজকে সকালেই দুটো বাচ্চা ছেলে, বয়স বড়জোর ২২ কী ২৩ হবে, আমার কাছে এসে বলে, এক কোটি টাকায় একটা পাথর কিনব কিনা।” কথাটা শুনে চক্ষু ছানাবড়া হয়ে যায় শুভজিতের। সুরজিৎ বলতে থাকেন, “আরে ওই পাথরটার দাম এক কোটি টাকা হতেই পারে না। মেরে কেটে দশ-বিশ হাজার টাকা। আমি বললাম ১০ হাজার টাকা দিতে পারি। হন হন করে বেরিয়ে গেল ছেলে দুটো। চুরির মাল মনে হয়।” ছেলে দুটোর বয়স আর চুরির মাল, এই দুটো কথা শুনে হঠাৎ কী একটা মনে হয় শুভজিতের। বন্ধুর কাছে ছেলে দু’টি ঠিক কেমন দেখতে, বিশদে জানতে চান। সুরজিৎ ডেকে পাঠান তাঁর দোকানে বসা ছেলেটিকে। “সাত্যকি! এদিকে একবার আসো তো। মনে আছে সকালবেলা ওই দুটো ছেলে এসেছিল কোটি টাকায় পাথর বিক্রি করবে বলে। এই স্যারকে ওদের চেহারা সম্পর্কে একটু বলতো।” এরপর যা হল তা কেউ কল্পনাও করেনি। সোজা শুভজিতের পায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাত্যকি। “বিশ্বাস করুন স্যার আমি খুন করিনি! ওরা খুন করেছে স্যার, আমি বারণ করেছিলাম। সুরজিৎদা আমায় বাঁচান, বিশ্বাস করুন আমি খুন করিনি!”, শুভজিৎ, সুরজিৎ দু'জনেই থ! সাত্যকিকে টেনে তোলেন শুভজিৎ।
‘খুন’, ‘ওরা খুন করেছে’, ‘আমি খুন করিনি’- এসব শুনেই এক ঝটকায় উঠে দাঁড়িয়েছেন শুভজিৎ। সাত্যকিকে তুলে সামনে বসান। একে একে সব বলা শুরু করে সাত্যকি। বড়লোক ঘরের সন্তান, পড়াশোনায় মন ছিল না বলে বাবা সুরজিৎকে বলে-কয়ে এই দোকানে সাত্যকিকে বসিয়েছেন। টাকার কোনও রকম অভাবই নেই। শুধুমাত্র কিছু একটা কাজ করতে হবে বলে দোকানে বসে। এমনিতে প্রতি মাসে প্রচুর পকেট মানিই পায়। তবে বেশিরভাগটাই খরচা করে রেসকোর্সে। রেসকোর্সে তাঁর সঙ্গী ছোটবেলার বন্ধু অরিন্দম, পেশায় একজন দালাল। তাঁর বাড়িতে বউ এবং আড়াই বছরের একটি ছোট মেয়ে রয়েছে। এই খুনের অন্যতম মাস্টারমাইন্ড সে। শুভজিতের জেরায় সাত্যকি বলে, “আমি, অরিন্দম আর অম্লান রেসকোর্সে যেতাম। সেখানেই আমাদের আলাপ হয় শ্যামাপ্রসাদ রায়ের সঙ্গে। কথায় কথায় ভদ্রলোক আমাদের জানান ওঁর একটি বহু দুষ্প্রাপ্য আংটি রয়েছে। যার দাম প্রায় এক কোটি টাকা। আমরা প্রথমে বিশ্বাস করতে চাইনি। শ্যামদাই আমাদের ওঁর বাড়ি আসতে বলেন আংটিটা দেখতে। আসলে, অরিন্দম বলেছিল ও খদ্দের যোগাড় করে দেবে। ওই ছয় কোণা আংটিটা দেখে আমাদের সবার কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অম্লান আর অরিন্দম ঠিক করে আংটিটা হাতাতে হবে। আমাকেও ওরা নিয়েছিল প্ল্যানে। কিন্তু আমি শেষ মুহূর্তে না করে দিই, মনে হয়েছিল ব্যাপারটা ঠিক না।”
“তারপর কী হলো?”, হিমশীতল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন শুভজিৎ।
“আমরা পোস্তায় যেখানে আড্ডা দিতাম, সেখানে আসত সঞ্জয়দা। সঞ্জয়দার বাড়ি ব্যান্ডেল তবে এখানে বড়বাজারের একটা দোকানে কাজ করে। সঞ্জয়দা আংটির কথা শুনে এক কথায় রাজি। ওরা প্ল্যান বানায় শ্যামদাকে খদ্দেরের কাছে নিয়ে যাচ্ছি বলে অরিন্দম কোথাও একটা নিয়ে যাবে। ওখানে আগে থেকে লোক ফিট করে রাখবে সঞ্জয়দা। ওরা আংটিটা হাতিয়ে নেবে। ওদের কয়েক হাজার টাকা দিলেই হবে।” একটানা কথা বলে কিছুটা জল খায় সাত্যকি। ফের বলা শুরু করে, “শ্যামদাকে অরিন্দম বলে এক খদ্দের পেয়েছে। কিন্তু তার কাছে গিয়ে আংটিটা বিক্রি করতে হবে। শ্যামদা বলে এত দামি জিনিস নিয়ে এতদূর যাতায়াত করতে পারব না। তার চেয়ে বরং ওই খদ্দেরকেই আমার বাড়িতে ডেকে নাও। ঠিক হয় ১৪ অগাস্ট, মঙ্গলবার শ্যামদার বাড়িতে যাব আমরা। কিন্তু আমার প্ল্যানটা শুরু থেকেই কিছু গোলমেলে মনে হচ্ছিল। তাই আমি অনুষ্ঠানের বাহানা দিয়ে কাটিয়ে দিই। পরে শুনেছিলাম আমি যাইনি বলে সঞ্জয়দা আরও চারজনকে নিয়ে ওইখানে গিয়েছিল। তারপর দিন দুয়েক আগে, খবরের কাগজে শ্যামদার খবর পড়ি।”
আরও পড়ুন- এই ভারতীয়র নামে রয়েছে খুনের বিশ্বরেকর্ড, যার কারণে আজও ভুক্তভুগী ৬ কোটি মানুষ
সাত্যকির থেকে অম্লান, অরিন্দম, সঞ্জয় সবার ফোন নম্বর এবং ঠিকানা নেন শুভজিৎ। একই সঙ্গে কড়া ভাষায় শাসিয়ে যান, যদি এদের মধ্যে কেউ জানতে পেরেছে যে পুলিশ তাদের কথা জানে তাহলে সবার আগে সাত্যকিকেই থানায় তুলে নিয়ে যাবে। সাত্যকি আশ্বস্ত করে সে চুপ থাকবে। সুরজিতের দোকান থেকে বেরিয়ে বাড়ি না ফিরে সোজা অরিন্দমের বাড়ির দিকে গাড়ি ছুটিয়ে দেন শুভজিৎ। অরিন্দমের বাড়ি গিয়ে শুভজিৎ জানতে পারেন ভবানী সিনেমায় সিনেমা দেখতে গেছে সে। ঘটনাচক্রে অরিন্দমের বাবাও অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মী। ছেলের কুকীর্তি শুনে হতবাক বাবা জানিয়ে দেন পুলিশ যা খুশি করতে পারে ছেলের সঙ্গে। তিনি ধরে নেবেন ছেলে মৃত। অরিন্দমের বাবার কথা মতো সেদিন রাতেই ভবানী সিনেমার সামনে থেকে তুলে নেওয়া হয় অরিন্দমকে। অরিন্দমকে জেরা করে শুভজিৎ জানতে পারেন সাত্যকি সত্যিই বলছিল। সে সত্যিই খুনের দিন যায়নি। জেরায় অরিন্দম জানায়, পোস্তার এক নামী ব্যবসায়ীর ড্রাইভারকে হাত করেছিল সঞ্জয়। সেই দিন ওই ব্যবসায়ীর স্যান্ট্রো গাড়ি নিয়ে পার্ক রোডের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে ওরা সাতজন। সাতজন বলতে, অরিন্দম, অম্লান, সঞ্জয়, সঞ্জয়ের দুই পরিচিত- বিজয় রায়, বিজয় বাহাদুর সিং, একটি স্থানীয় ছেলে অমিত এবং ওই ব্যবসায়ীর ড্রাইভার রাম কমল মণ্ডল। অরিন্দম ধরা পড়েই মুখ খুলে দেয়। ফলত, এক সপ্তাহের মধ্যেই ধরা পড়ে যায় বাকিরা। যদিও নাটের গুরু সঞ্জয় তখনও অধরা।
১৪ তারিখ বিকেলে ঠিক কী হয়েছিল? সকলকে জেরা করে যা জানা যায় তা খানিকটা এরকম - শ্যামাপ্রসাদ রায়ের কোর্ট থেকে বাড়ি ফিরতে সাড়ে চারটে-পাঁচটা বাজে। রাম নিজের মালিককে চারটের মধ্যে বাড়িতে নামিয়ে গাড়ি সার্ভিসিং করানোর নাম করে গাড়ি নিয়ে চলে আসে সঞ্জয়ের ডেরায়। কথা ছিল সকলে রাসবিহারী মোড়ে জড়ো হবে পৌনে পাঁচটা নাগাদ। এখান থেকে তারা একসঙ্গে গাড়িতে উঠবে এবং সাড়ে পাঁচটা পৌনে ছটার মধ্যে পৌঁছে যাবে পার্ক রোডে। রাম কমল মণ্ডল গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে শরৎ বোস রোডের মুখে। প্ল্যান ছিল, সঞ্জয় প্রথমে খদ্দের সেজে কথা বলবে শ্যামাপ্রসাদ রায়ের সঙ্গে। একটু দর কষাকষির পর শ্যামাপ্রসাদকে বলবে, সে আপাতত আংটিটা নিয়ে যেতে চায়, ভ্যালুয়েশন করিয়ে একদিনের মধ্যে ফেরত দিয়ে যাবে। স্বাভাবিকভাবেই শ্যামাপ্রসাদ তাতে বেঁকে বসবে। আর তখনই সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যাবে আংটিটা। সব প্ল্যানমাফিক চললেও ছিনিয়ে নিতে গিয়েই সমস্যাটা হয়। অরিন্দম জানায়, প্ল্যান ছিল শ্যামাপ্রসাদকে হালকা ভয় দেখিয়ে বা দু’চারটে থাপ্পড় মেরে আংটিটা নিয়ে পালাবে। কিন্তু সঞ্জয় এবং তার সাঙ্গপাঙ্গদের মতিগতি ছিল অন্য। তারা খুন করতেই চেয়েছিল শ্যামাপ্রসাদকে। না চাইলেও প্রাণের ভয়ে তাদের সঙ্গ দিতে হয় অরিন্দমদের।
প্রথমে ধরা না পড়লেও ৮ সেপ্টেম্বর অসম থেকে ধরা পড়ে সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানে সে মনোজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় নাম নিয়ে হোটেলে ওঠে। পুলিশি রেকর্ডে এর আগে বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে সঞ্জয়ের নামে। জেরায় সঞ্জয় জানায়, মিথ্যে বলেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ রায়। ওটা মোটেই কোনও কোটি টাকার আংটি নয়। একটা অত্যন্ত সামান্য পাথর রয়েছে আংটিতে, দাম বড় জোর ১০ হাজার টাকা। ওই আংটি বিক্রি করাও খুব রিস্ক আবার নিজের কাছে রাখাও সমস্যা। তাই সঞ্জয় নাকি গঙ্গায় ফেলে দিয়েছে আংটি। সমস্ত সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে চার্জশিট পেশ করেন শুভজিৎ। কোর্টে সবার বিরুদ্ধে সাক্ষী দেয় সাত্যকি। অম্লান এবং অরিন্দমই যে বিক্রি করতে সুরজিতের দোকানে এসেছিল তা সনাক্ত করেন সুরজিৎ। পোস্তার ওই ব্যবসায়ী রাজেশ প্রসাদ জানান, তাঁর ড্রাইভার রাম কমল মণ্ডল ১৪ তারিখ বিকেলবেলা গাড়ি সার্ভিসিং করাতে যাবে বলে নিয়ে বেরিয়েছিল। অসমের ওই লজের বোর্ডিং রেজিস্টার থেকে মনোজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতের লেখা মিলিয়ে দেখা যায় ওই লেখা একই ব্যক্তির। এছাড়াও ১৪ তারিখ বিকেল পৌনে পাঁচটা থেকে সন্ধে সাড়ে ছটা পর্যন্ত প্রত্যেকের ফোনের টাওয়ার লোকেশনের ডিটেলস তো ছিলই। শুনানির পর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের শাস্তি হয় এই সাতজনের বিরুদ্ধে। অতি লোভে তাঁতি নষ্ট হয় কিনা জানা নেই, তবে জীবন তো নষ্ট হয়ই। লোভের কারণেই খুন হতে হয়েছে শ্যামাপ্রসাদ রায়কে, লোভের কারণেই সাত জনকে জেলে পচে মরতে হচ্ছে। মার্ক টোয়েন যথার্থই বলেছেন, “Truth is stranger than fiction”।
তথ্যসূত্র-
কলকাতা পুলিশের ফেসবুক পেজ