মোরবি থেকে বিলকিস, দাগ কাটছে না কিছুই! আবারও গুজরাতের রং হবে গেরুয়া?
Gujarat Election: লাগাতার ষষ্ঠবারের জন্য গুজরাতে বিজেপি-র ক্ষমতায় আসা কেউ আটকাতে পারবে না বলেই মত রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের।
জনগণের মনের জাগরণের কথা বলতে গিয়ে অন্য রাজ্যের সঙ্গে গুজরাতকেও একই বন্ধনীতে এনে ফেলেছিলেন কবি। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, আদিকাল থেকেই সাম্প্রদায়িকতা এবং বিভাজনের চোরাবালির উপরই দাঁড়িয়ে থেকেছে প্রতীচ্য গুজরাত। বিংশ শতকে অলিগলিতে যে গুজরাত মডেলের কথা ঘুরেফিরে উঠে আসে কথা-কাহিনিতে, বরাবরই ফাঁপা তার অন্তরমহল। তাই গুজরাতের ভূমিপুত্র মহাত্মা গান্ধী একজাতির আধিপত্যকে অলীক কল্পনা বলে দাগিয়ে দিলেও, হিন্দু হৃদয়সম্রাট, গুজরাতের আর এক ভূমিপুত্র নরেন্দ্র মোদি ঘোষিতভাবেই সংখ্যাগরিষ্ঠের একাধিপত্যে সিলমোহর দেন। তাই বিংশ শতকের ভারতে ‘নামহীন’ নির্ভয়ার দোষীদের ফাঁসি হলেও, শুধুমাত্র নামের জন্যই লুকিয়ে বাঁচতে হয় পাশবিক অত্যাচারের শিকার বিলকিস বানো-কে। ফুলের মালা গলায় ঝুলিয়ে, মিষ্টিমুখ করে, হাসিমুখে জেল থেকে বেরিয়ে আসে তাঁর ধর্ষকরা। নির্ভয়ার ওপর ঘৃণ্য আচরণে সরকার পড়ে যায় দিল্লিতে। আর বিলকিসের ধর্ষকদের মুক্তিতে গুজরাতে ভোট বাড়ে সরকারের। বিধানসভা নির্বাচনের আগামী সমীক্ষা অন্তত তেমনই ইঙ্গিতই দিচ্ছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি সেতু ভেঙে পড়ে সওয়া একশো-র বেশি লোকের সলিল-সমাধি ঘটলেও, হিন্দু ভোট বিজেপিকে উতরে দেবে বলে পাটিগণিত কষে দেন বিশারদরা।
নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, ১৮২ আসনের গুজরাত বিধানসভায় নির্বাচন হবে দুই দফায়। ১ ডিসেম্বর প্রথম দফায় ভোটগ্রহণ। দ্বিতীয় দফায় ভোটগ্রহণ ৫ ডিসেম্বর। ফলপ্রকাশ ৮ ডিসেম্বর, হিমাচল প্রদেশের সঙ্গে একই দিনে। ফল ঘোষণা একদিনে হলে, দুই রাজ্যের নির্বাচনী নির্ঘণ্ট প্রকাশও কেন একদিনে হলো না, তা নিয়ে যদিও প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধীরা। তাঁদের অভিযোগ, একসঙ্গে নির্বাচনী আচরণবিধি কার্যকর হয়ে গেলে প্রচারের জন্য যথেষ্ট সময় পেতেন না মোদি। মোরবির সেতু বিপর্যয়ের পর তা বিজেপির জন্য অস্বস্তিকর পরিস্থিতি ডেকে আনতে পারত। আবার নির্বাচনের ঠিক আগে, গুজরাতের দুই জেলায় বসবাসকারী, পড়শি দেশ থেকে আগত অ-মুসলিম মানুষজনকে নাগরিকত্ব প্রদানের বাহবা কোড়ানোরও যথেষ্ট সময় পেতেন না হিন্দু হৃদয়সম্রাট। তাই পাঁজি দেখে, হিসেব কষেই, গুজরাত নির্বাচনের দিনক্ষণ স্থির হয়েছে, যাতে সাপও মরে, আবার লাঠিও না ভাঙে। নির্বাচন কমিশন যদিও নিজেই নিজেকে নিরপেক্ষতার দরাজ সার্টিফিকেট দিয়ে ফেলেছে। বিগত আট বছরে এই প্রথম এমন অভিযোগ এই প্রথম নয়। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে মরিয়া বিরোধী শিবিরের এমন ‘নাকে কান্না’ শুনতে শুনতে কানই পচে গিয়েছে তাদের। তাই যুক্তিযুক্ত কারণ দেখানোর তাগিদ নেই তাদের।
আরও পড়ুন: গুজরাতের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকুক দেশ, রাষ্ট্রপতির এই মন্তব্যের আসল কারণ কী
তবে প্রচারের জন্য হাতে সময় থাক বা না থাক, লাগাতার ষষ্ঠবারের জন্য গুজরাতে বিজেপির ক্ষমতায় আসা কেউ আটকাতে পারবে না বলেই মত রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের। এর সপক্ষে যুক্তি হল, ২০১৭ সালে ৭৭টি আসন জিতে বিজেপিকে জোর ধাক্কা দিতে পেরেছিল বটে কংগ্রেস। কিন্তু একের পর এক বিধায়ক বিজেপিতে গিয়ে ওঠায়, সেই আসনসংখ্যা এখন ৬২-তে এসে ঠেকেছে। ২০১৭ সালে গুজরাতে কংগ্রেসকে চাঙ্গা করার নেপথ্যে ছিলেন যে আহমেদ প্যাটেল, তিনিও গত হয়েছে। রাহুল গান্ধী ব্যস্ত ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ নিয়ে। সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দলকে টপকে কিছু করার জায়গায় নেই যুবনেতা জিগনেশ মেভানি। তার ওপর গুজরাতের নির্বাচনে গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে উঠেছে আম আদমি পার্টির আবির্ভাব। তারকা প্রার্থী তো দূর, যেখানে প্রচার চালাতেই হিমশিম খাচ্ছে কংগ্রেস, গুজরাতকে কার্যত দ্বিতীয় বাড়ি বানিয়ে ফেলেছেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিতে বিজেপির বিকল্প হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে সচেষ্ট তিনি। তবে গুজরাতে তাঁর লক্ষ্য বিজেপিকে পরাস্ত করা নয়, কংগ্রেসের ভোট কেটে বিরোধী দলের স্বীকৃতি হাসিল করা। তাই বিজেপি নয়, গুজরাতে আপের আগমনে কংগ্রেসেরই চিন্তিত হওয়ার কথা বলে মানছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। আর তাতেই বিজেপির হাত মজবুত হবে বলে মত সকলের।
ঘটনাচক্রে, এমনই এক ডিসেম্বরে রাজধানী দিল্লিতে উদয় হয়েছিল আপের। ২০১২ সালে নির্ভয়া ধর্ষণকাণ্ডের সময়ই। চলন্ত বাসের মধ্যে পাষণ্ডদের লালসার শিকার তরুণী নির্ভয়ার মৃত্যুতে গর্জে উঠেছিল গোটা দেশ। মোমবাতি মিছিলে ভরে গিয়েছিল রাজধানীর রাস্তা। সেই জনরোষকে হাতিয়ার করেই জননেতা হয়ে ওঠা কেজরিওয়ালের এবং পরবর্তী কালে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীও। এই মুহূর্তে তাঁর লক্ষ্য প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার হওয়া। তার জন্যই একে একে পঞ্জাব, গোয়া, হিমাচল এবং গুজরাতের উপর নজর পড়েছে তাঁর। বিজেপি তথা মোদির বিকল্প হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে তাই নিত্যনতুন চমকও তৈরি করছেন তিনি, কথায় এবং কাজে। সুযোগ পেলেই আজ এই মন্দির, তো কাল ওই মন্দিরে মাথা ঠুকে আসছেন। গদা হাতে পরাক্রম দেখাচ্ছেন কোথাও, তো কোথাও আবার হনুমান চালিশা পাঠ করছেন। নিজেকে রামভক্ত বলতেও দ্বিধা নেই আইআইটি ফেরত কৈজরিওয়ালের। তাই অর্থনীতি চাঙ্গা করার উপায় হিসেবে টাকায় মহাত্মার পাশে লক্ষ্মী-গণেশকে রাখতে চান। তবে নিজে কন্যাসন্তানের বাবা হলেও, নির্ভয়ার জন্য সুবিচার চাইলেও, দেশের আর এক মেয়ে বিলকিসকে নিয়ে একটি শব্দও খরচ করেননি তিনি। বেখেয়ালে নয়, একেবারে সচেতন সিদ্ধান্ত।
অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় ধর্ষণের শিকার বিলকিস, চোখের সামনে মাকে ধর্ষিতা হতে দেখা বিলকিস, একরত্তি মেয়েকে আছাড় খেয়ে নিথর হতে দেখা বিলকিস, ২০ বছর ধরে বিচারের আশায় দরজায় দরজায় ছুটে বেড়ানো বিলকিস, ১১ জন ধর্ষককে ভাল আচরণের জন্য মেয়াদ শেষের আগে জেল থেকে বেরোতে দেখা বিলকিস, নিরাপত্তাহীনতায় ফের মুখ লুকনো বিলকিস, তাঁকে নিয়ে মুখ খুলে গুজরাতে ৮৯ শতাংশ হিন্দু জনসংখ্যার বিরাগভাজন হতে চান না কেজরিওয়াল। শুধু কেজরিওয়ালই নন, বিলকিসের প্রতি সমবেদনা জানানো, তথাকথিত সংখ্যালঘুর দল অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই ইত্তেহাদুল মুসলিমিন-ও হিসেব কষেই এগোচ্ছে গুজরাতে। একটা-দু’টো আসন হলেও হতে পারে ধারণা নিয়েই বিলকিসের পাশে দাঁড়িয়েছে তারা, যাতে কংগ্রেসের উপর আশা হারানো সংখ্যালঘু মুসলিম ভোট অন্তত তাদের দিকে চলে আসে। আর যাদের সব চলেই গিয়েছে, জাদুদণ্ডের ছোঁয়ার চাঙ্গা হওয়ারও আশা নেই, সেই কংগ্রেস মানবিকতার তাগিদেই বিলকিসের পাশে দাঁড়িয়েছে। তবে তা করতে গিয়েও, গুজরাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতার সামনে বার বার ঘোষণা করতে হয়েছে যে, সংখ্যালঘু তুষ্টিকরণ তাদের উদ্দেশ্য নয়। অকথ্য অত্যাচারের শিকার, নারী বিলকিসের পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত মানবিকতার খাতিরেই নিতে হয়েছে। কিন্তু প্রায় তিন দশক প্রত্যক্ষ ভাবে ক্ষমতাতেই নেই যে দল, তাদের অবস্থানে কারও কিছু এসে যাওয়ার কথা নয়, বিশেষ করে গুজরাতের মানুষের তো নয়ই।
নর্মদার জল থেকে কচ্ছের বালুকাভূমি, গুজরাতের বাতাসে ভেসে বেড়ানো অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণাও রাজনীতিমুক্ত নয়। বিলকিসের ধর্ষকদের মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক জেনেও, ওজর-আপত্তি নেই অধিকাংশেরই। খাতায় কলমে ১৭১৩ সাল থেকেই গুজরাতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রমাণ রয়েছে। সাম্প্রদায়িক অশান্তির জেরে সত্যাগ্রহ পর্যন্ত থামিয়ে দিতে হয়েছিল খোদ মহাত্মাকে। খিলাফৎ আন্দোলনে সমর্থন জানানোয় গুজরাতি হিন্দুদের বিরাগভাজন হতে হয়েছিল তাঁকে। জাতীয়তাবাদ এবং ধর্ম কখনও পরস্পরের সমার্থক হতে পারে না, জনে জনে এই বার্তা দিলেও, নিজভূমের সংখ্যাগরিষ্ঠকে বোঝাতে পারেননি। বরং যত দিন গিয়েছে, গুজরাত হয়ে উঠেছে হিন্দুত্ববাদের রসায়নাগার। তাই অতীতের অত্যাচারী মুসলিম শাসকের সঙ্গে বর্তমানের নিপীড়িত মুসলিম নাগরিকের মধ্যেকার ফারাক বোঝানো সম্ভব হয়নি গুজরাতের হিন্দুত্ববাদের সমর্থক নাগরিকদের। বরং অতীতের সোমনাথ মন্দির ধ্বংস, পাকিস্তানের ক্রিকেট জয়ে মুষ্টিমেয়র উল্লাস, মসজিদের আজানের ‘উৎপাত’, এমনকী বিত্তবান হয়ে ওঠা মুসলিমদের শিকড় বিস্তারের প্রতি বিষোদ্গারই উঠে এসেছে পাল্টা যুক্তি হয়ে। তাহলে কি পাশবিক অত্যাচারও প্রাপ্য ছিল বিলকিসের? যুক্তি উঠে আসে, ‘‘ভদ্র পরিবারের ছেলেরা ওই কাজ করতেই পারে না। হতে পারে অভিযোগই মিথ্যা!’’
কিন্তু শুধু তো বিলকিস নন, এহসান জাফরি, আর কতশত মানুষ কচুকাটা হয়েছেন! জবাব আসে, ‘‘কিছু কিছু ক্ষেত্রে কড়া হতে হয়। নইলে মাথায় চেপে বসবে।’’ এখানেই জয় হিন্দু হৃদয়সম্রাটের। আগে তবু ‘রাজধর্ম’ পালনের সাফাই দিতে হত তাঁকে, আজ ভূমিপুত্রের হয়ে জবাব দেওয়ার গুরুদায়িত্ব কাঁধে নিয়ে ফেলেছেন খোদ গুজরাতবাসী। তাই যতদিন পর্যন্ত মেরুদণ্ডের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন মানুষ, ততদিন অজেয় থাকবেন তিনি ও তাঁর আদর্শ।