এ যুগের 'রেভ পার্টি'ও ফেল! জানেন ব্রোঞ্জ যুগে নেশায় কতটা আসক্তি ছিল মানুষের?
Ancient Hallucinogenic Drugs: রঙিন চুলের কয়েকটি গোছা কখনও কখনও কাঠ বা শিং দিয়ে তৈরি ছোট শিশিতে ভরে চুলের মৃত মালিকের মৃতদেহের পাশে রাখা হতো।
নেশা তো মানুষের জন্মগত অধিকার! অন্তত এমনটাই মনে করেন নিয়মিত নেশা করা মানুষ। তবে এ সামান্য বিড়ি, সিগারেট, মদের নেশা নয়। এই নেশা আরও বেশ কয়েক ধাপ এগিয়ে। বেশ কয়েক যুগ ধরে নানা ধরনের মাদক, মাদকের ব্যবসা ও চাহিদা দুই-ই বৃদ্ধি পেয়েছে। নানা প্রকারে, নানা আকারে মেলে সেইসব ড্রাগস। তবে কয়েক যুগ বা কয়েক দশক নয়। মানুষ চরম প্রকারের মাদক সেবন করত সেইই ব্রোঞ্জ যুগ থেকেই! যে সে ড্রাগস নয়, রীতিমতো হ্যালুসিনেটিং ড্রাগস! স্পেনের মেনোর্কাতে ব্রোঞ্জ যুগের শামানদের চুলের জীবাশ্মে সাইকোঅ্যাকটিভ অ্যালকালয়েডের চিহ্ন পাওয়া গেছে। একটি কবর গুহার পিছনে এক গোপন কুঠুরিতে লুকানো চুলের নমুনাগুলি বলছে প্রাচীন ইউরোপে হ্যালুসিনোজেনিক ড্রাগের ব্যবহার ছিল। প্রায় ৩,০০০ বছর আগেকার ওই চুলের গুচ্ছগুলিতে অ্যালকালয়েড স্কোপোলামাইন এবং এট্রোপিন পাওয়া গিয়েছে। এই দু'টিই সাংঘাতিক নেশার মাদক।
ব্যালেরিক দ্বীপে অবস্থিত এস কারিটক্স গুহায় ওই চুলের গুচ্ছ এবং তাতে লেগে থাকা মাদক আবিষ্কার করা গিয়েছে। গবেষক এলিসা গুয়েরা-ডোসের ব্যাখ্যা অনুযায়ী এই গুহাটি ১৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ব্যবহার করা হচ্ছিল এবং আরও কিছুকাল পরে গুহাটি কবরস্থানে পরিণত হয়- প্রায় ১৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ। প্রায় ৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত গুহার কিছু অংশ সমাধিস্থল হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। এর আগেকার খননকার্য থেকে জানা গেছে, এই ৬০০ বছরের সময়কালে গুহায় কমপক্ষে ২১০ জন ব্যক্তিকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল এবং মৃতদের মধ্যে কয়েকজনের চুলে লাল রঙ করা হয়েছিল। রঙিন চুলের কয়েকটি গোছা কখনও কখনও কাঠ বা শিং দিয়ে তৈরি ছোট শিশিতে ভরে চুলের মৃত মালিকের মৃতদেহের পাশে রাখা হতো।
আরও পড়ুন- কোকে কোকেন ফেরাব, বলছেন এলন মাস্ক || সত্যিই কি ঠান্ডা পানীয়ে মিশত ভয়ানক মাদক?
সাম্প্রতিক এক গবেষণায়, গুয়েরা-ডোসে এবং তাঁর সহকর্মীরা গুহার গভীরে একটি ছোট স্থান যেটি প্রায় ৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে বন্ধই ছিল, সেখান থেকে এই মাদক আবিষ্কার করেছেন। পাথর খনন করে এবং মাটির একটি স্তরের নীচে লুকানো একটি জায়গা থেকে রঙিন চুলের দশটি শিশি এবং সেইসঙ্গে অন্যান্য কাঠের, সিরামিক এবং ব্রোঞ্জের জিনিসপত্র উদ্ধার করেছেন।
আল্ট্রা-হাই-পারফরম্যান্স লিকুইড ক্রোমাটোগ্রাফি এবং হাই-রেজোলিউশন মাস স্পেকট্রোস্কোপি ব্যবহার করে গবেষকরা এই লুকানো চুলের নমুনায় স্কোপোলামাইন, অ্যাট্রোপিন এবং ইফেড্রিনের উপস্থিতি শনাক্ত করেছেন। এতকাল আগে এই প্রথম মানুষের নমুনায় হ্যালুসিনোজেনিক উদ্ভিদের ব্যবহার নথিভুক্ত করা গিয়েছে, জানান গুয়েরা-ডোস। আগে, সাইকোঅ্যাকটিভ বৈশিষ্ট্য সহ অংসখ্য গাছপালা নথিভুক্ত করা হয়েছিল- যার মধ্যে কিছু এই গুহার চেয়েও অনেক পুরনো কিন্তু সেগুলি সবই পরোক্ষ প্রমাণ ছিল৷ ইউরোপ জুড়ে নানা স্থানে খননকালে প্রাচীন পাত্র বা অন্যান্য পাত্রে আফিম পোস্তর অবশিষ্টাংশ এবং অন্যান্য উদ্ভিদের উপাদান মিলেছে আগে। তবে এই গাছগুলির উপস্থিতির মানে এই নয় যে সেগুলিকে ড্রাগ হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। কিন্তু এই গবেষণা দেখাচ্ছে মানুষ আসলে বিভিন্ন গাছপালা থেকে উদ্ভূত এই ওষুধগুলি খেয়েছিল।
আরও পড়ুন- ১৩৫ বছর ধরে নেশার জল বেচছে কোকাকোলা? কীভাবে জন্ম নিল এই পানীয়, অবাক করবে যে ইতিহাস
স্কোপোলামাইন এবং এট্রোপাইন কুখ্যাত ডাটুরা বিভাগের গাছপালা। গবেষকদের মতে, এই অ্যালকালয়েডগুলির চরম মানসিক বিভ্রান্তি, শক্তিশালী এবং বাস্তবসম্মত হ্যালুসিনেশন, বিভ্রান্তি, অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা এবং ত্বকের পরিবর্তনের অনুভূতি তৈরি করার ক্ষমতা রয়েছে। মানে এই নেশা করে মনে হতে পারে দেহে যেন পশম বা পালক গজাচ্ছে। চুলের মধ্যে পাওয়া অ্যালকালয়েডগুলি এত্তাই বিষাক্ত যে সেগুলির ব্যবহার এবং প্রয়োগ ঘটাতে অত্যন্ত বিশেষ জ্ঞানের প্রয়োজন আছে। এই জ্ঞান শামানদের ছিল।
এই অনুমানের উপর ভিত্তি করেই গুয়েরা-ডোস বলছেন, সম্ভবত লুকানো শিশিতে থাকা চুলগুলি ব্রোঞ্জ যুগের শামানদেরই ছিল। এই লাল চুলের নমুনার শিশিগুলিকে বৃত্ত দিয়ে সাজানো হয়েছিল, যা চোখের প্রতীক হতে পারে এবং তাই হ্যালুসিনোজেনিক উদ্ভিদ খাওয়া শামানদের 'অভ্যন্তরীণ দৃষ্টি'-র প্রতীকও হতে পারে।
কেন এই লাল চুলগুলি ইচ্ছাকৃতভাবে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল সেই রহস্যের সমাধানও করেছেন গবেষকরা। গুয়েরা-ডোস বলছেন, কিছু কিছু প্রমাণ রয়েছে যে প্রায় ৩,০০০ বছর আগে মেনোর্কার মানুষরা 'সামাজিক অস্থিতিশীলতা' টের পেয়েছিল। তাই প্রাচীন ঐতিহ্য পরিত্যাগ করতে অনিচ্ছুক, সম্প্রদায়ের কিছু নির্দিষ্ট মানুষ গুহায় শামানদের নিজস্ব আচার-অনুষ্ঠানের কিছু অংশ লুকিয়ে রেখেছিল এই আশায় যে, সামাজিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে ভবিষ্যতে। তাই সেই রীতি আচারের অংশ হিসেবেই চুলগুলিও রয়ে গিয়েছিল মাটির গভীরে।