একটি সেদ্ধ ডিমের ভিতরে রয়েছে হাজার রহস্য, জানলে আপনি চমকে যাবেন!

'দুধ না খেলে হবে না ভালো ছেলে' শুনে শুনে বড় হওয়া আমরা ছোটবেলায় টিভি চালালে হিন্দিতে আরেকটা মজাদার ছড়া শুনতাম 'সানডে হো ইয়া মনডে, রোজ খাও আন্ডে'। এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাদুকরের থলিতে অনায়াসে জায়গা করে নিতে পারে একটা সেদ্ধ ডিম কিংবা যদি বলি এই পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্যের নাম সেদ্ধ ডিম! অবাক হবেন?  নাকি বিস্ময়ভরে জানতে চাইবেন, 'কেন?'

ডিম পুষ্টি উপাদানে ভরপুর একটি প্রাকৃতিক খাদ্য। ডিমকে প্রোটিন এবং পুষ্টি উপাদানের পাওয়ার হাউসও বলা হয়ে থাকে। শিশু থেকে বৃদ্ধ, সব বয়সের মানুষের সুস্বাস্থ্যের জন্য ডিম একটি অত্যন্ত উপাদেয় খাদ্য। সাধারণত বলা হয়ে থাকে, ‘যদি সুস্থ থাকতে চান, প্রতিদিন একটি করে ডিম খান’। কিন্তু ডিম খাওয়া না খাওয়া নিয়ে তুমুল বিতর্কও রয়েছে। কেউ বলেন- প্রতিদিন ডিম খাবেন, কেউ বলেন- একদম ডিম খাবেন না, ডিম খেলে মৃত্যুঝুঁকি বাড়ে, আবার কেউ বলেন- ডিমের কুসুম বাদ দিয়ে শুধু সাদা অংশ খাবেন, আবার কেউ বলেন- সপ্তাহে বেশি হলে দুটো ডিম খাবেন।। নানা মুনির নানা মত।

কিন্তু সাধারণ মানুষের নিজস্ব মতামতের বাইরে, ধারণার বাইরে গিয়ে; বিজ্ঞানসম্মত ভাবে, অর্থাৎ ডাক্তার, গবেষক এবং বিজ্ঞানীদের মতে প্রতিদিন একটি করে ডিম খেলে কী হয় জানেন? 

তবে শুনুন, একটি ডিমে কী কী থাকে - 

একটি সেদ্ধ ডিম থাকে প্রোটিন, উপকারি ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট, কোলেস্টেরল (১০০ গ্রামে ৩৭৫ মিগ্রা), ভিটামিনের মধ্যে নিয়াসিন, রাইবোফ্ল্যাভিন, প্যান্টোথেনিক অ্যাসিড, থায়মিন, পিরিডক্সিন, ফোলিক অ্যাসিড, ভিটামিন বি১২, ভিটামিন এ, ভিটামিন ই, ভিটামিন ডি, লিউটিন, জিয়াজেন্থিন।

খনিজের মধ্যে থাকে- ক্যালসিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, ফসফোরাস, পটাশিয়াম, জিঙ্ক, কপার, সেলেনিয়াম

ফ্যাটি অ্যাসিডের মধ্যে থাকে- অলিক অ্যাসিড, লিনোলিক অ্যাসিড, লিনোলেনিক অ্যাসিড, আইকোসাপেন্টাইনোয়িক অ্যাসিড, ডকোহেক্সাইনোয়িক অ্যাসিড, পালমিটিক অ্যাসিড, স্টিয়ারিক অ্যাসিড, আরাচিডোনিক অ্যাসিড এবং ২০ টি গুরুত্বপূর্ণ অ্যামিনো অ্যাসিড, যা ছাড়া শরীরে প্রোটিন তৈরি হয় না।

এবার লেখার প্রথম স্তবকে ফিরে যান এবং বোঝার চেষ্টা করুন কেন আমি ডিমকে পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য বলেছিলাম বা কেন তুলনা করেছিলাম শ্রেষ্ঠ জাদুকরের থলির অন্যতম উপাদানের সাথে! 

ডিমের মধ্যে থাকা উপাদানগুলির বিবিধ উপকারিতা :

প্রোটিন:  একটি ডিম থেকে প্রায় ৬.৩ গ্রাম উচ্চমানের প্রোটিন পাওয়া যায়। ডিমের প্রোটিন শরীরে খুব সহজে গৃহিত হয়। শরীরের গঠন ও ক্ষয়পূরণের জন্য প্রোটিন অত্যাবশ্যকীয়। এ ছাড়া প্রোটিন বিভিন্ন অঙ্গ, ত্বক, চুল এবং শরীরের বিভিন্ন টিস্যু পুনর্গঠনে সহায়তা করে।

বিভিন্ন ভিটামিন: 

ভিটামিন এ: ডিম থেকে ভিটামিন এ পাওয়া যায়। এই ভিটামিন এ ত্বক এবং চোখের কোষের সুস্থতা দান করে। সেই সঙ্গে রাতকানা প্রতিরোধ করতে সহায়তা করে।

ভিটামিন ই: ভিটামিন ই দেহে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। ত্বক ও চুলের জন্য ভিটামিন ই গুরুত্বপূর্ণ। এটি শরীরকে সুস্থ রাখে এবং রোগ প্রতিরোধ করতে সহায়তা করে।

ভিটামিন বি-১২: এটি হৃদরোগ প্রতিরোধ করতে সহায়তা করে এবং হৃদয় সুস্থ রাখে।

ভিটামিন ডি: ভিটামিন ডির একটি ভালো খাদ্য উৎস হচ্ছে ডিম। ভিটামিন ডি হাড় এবং দাঁত সুস্থ ও মজবুত করে। কিছু কিছু ক্যানসার কোষ প্রতিরোধে সহায়তা করে এবং রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বাড়ায়।

ক্যালরি: একটি ডিম থেকে সাধারণত ৭৭ ক্যালরি পাওয়া যায়। ডিম দীর্ঘ সময় শক্তি জোগায় এবং ক্ষুধা কমায়। তাই ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য ডায়েটে ডিম রাখা জরুরি। সকালের খাবারে রোজ একটি ডিম সারা দিনের পুষ্টি চাহিদা অনেকটুকুই পূরণ করতে সহায়তা করে।

কোলিন: ডিমের কুসুমে কোলিন থাকে। এটি আমাদের প্রত্যেকের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান, বিশেষ করে বাড়ন্ত বাচ্চা এবং শিশুদের জন্য। কারণ কোলিন মস্তিষ্কের বিকাশ এবং কার্যক্ষমতা বাড়াতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সেই সঙ্গে মস্তিষ্কের সুস্থতা বজায় রাখে।

কোলেস্টেরল: একটি বড় সেদ্ধ ডিম থেকে প্রায় ১৮৬.৫ গ্রাম কোলেস্টেরল পাওয়া যায়। বর্তমান গবেষণায় জানা গেছে, ডিম থেকে যে কোলেস্টেরল পাওয়া যায় তা আমাদের শরীরে বিশেষ কোনো ক্ষতি করে না। ডিমে উপস্থিত কোলেস্টরল নিয়ে বিভিন্ন মিথ প্রচলিত রয়েছে। অনেকেই মনে করেন ডিমের হলুদ অংশ বা কুসুম নিয়মিত খেলে তা শরীরে কোলেস্টেরল এর পরিমাণ বাড়ায় যা আমাদের হৃদয়ের জন্য ক্ষতিকারক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , ক্লিনিক্যাল ফার্মাসি ও ফার্মাকোলজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মুনীরউদ্দিন আহমেদ বলেন, ডিম থেকে কোলেস্টেরল না নিলেও শরীর গ্লুকোজ বা অন্যান্য উৎস থেকে ঠিকই প্রয়োজন মতো পর্যাপ্ত কোলেস্টেরল সংশ্লেষণ করে নেবে। কোলেস্টেরলের মূল উৎস কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা, যা থেকে শরীর ৮৫ - ৯০ শতাংশ কোলেস্টেরল সংশ্লেষ করে এবং ১০-১৫ শতাংশ কোলেস্টেরল আসে কোলেস্টেরলসমৃদ্ধ খাবার থেকে। তাই আমাদের শর্করা কম খেয়ে কোলেস্টেরলসমৃদ্ধ খাবার বেশি খাওয়া উচিত। কোলেস্টেরল মানুষের শরীরের জন্য এক বিশেষ উপকারি রাসায়নিক উপকরণ। আমাদের মস্তিষ্কের ২৫ শতাংশ কোলেস্টেরল। আমাদের শরীরের প্রায় ৩৭ ট্রিলিয়ন সেলের সেলওয়াল বা কোষ প্রাচীর তৈরির জন্য দরকার কোলেস্টেরল। সুতরাং বুঝতেই পারছেন কী পরিমাণ কোলেস্টেরল প্রয়োজন হয় শরীর গঠনে। তাই কোলেস্টরলকে শত্রু না বানিয়ে, চিনিকে নিজের শত্রু বানান। 

ফলেট: ডিমে ফলেট থাকে, যা শরীরে নতুন কোষ গঠনে সাহায্য করে। ফলেট এর অভাবজনিত রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধে সহায়তা করে। গর্ভবতী মায়েদের জন্য ফলেট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি শিশুর জন্মগত ত্রুটি দূর করতে সহায়তা করে।

সেলেনিয়াম: ডিম থেকে সেলেনিয়াম পাওয়া যায়। এটি ভিটামিন ই-এর সঙ্গে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে, যা শরীরের বিভিন্ন টিস্যুর ক্ষয় রোধ করে এবং রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।

ডিমের কুসুম খাওয়া কি নিরাপদ? :

ডিমের কুসুমে পুরো ডিমের প্রায় অর্ধেক পুষ্টি উপাদান থাকে যথা ফলেট, কোলিন, ভিটামিন এ, ভিটামিন ডি, ভিটামিন ই, লেটিইন এবং জি-অ্যাকজানথাইন থাকে। ডিমের কুসুম নিয়ে একটি ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত আছে। যেহেতু ডিমের কুসুমে অধিক মাত্রায় কোলেস্টেরল থাকে, তাই এতদিন ধারণা করা হতো, যাঁদের করোনারি হার্ট ডিজিজ রয়েছে এবং রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি, তাঁদের জন্য ডিমের কুসুম ক্ষতিকর। পরামর্শ দেওয়া হতো কুসুমছাড়া ডিম খাওয়ার জন্য। কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এটি প্রমাণিত হয়েছে, ডিমের কুসুম থেকে যে কোলেস্টরেল পাওয়া যায়, তা রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ায় না এবং এটি করোনারি হার্ট ডিজিজের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। প্রতিদিন কুসুম-সহ একটি ডিম সবার জন্য নিরাপদ এবং স্বাস্থ্যকর। তাই কুসুম বাদ দিয়ে নয়, কুসুম-সহ প্রতিদিন একটি ডিম সবার জন্যই স্বাস্থ্যসম্মত।

সম্প্রতি চিনের ৫ লক্ষ মানুষের ওপর একটি গবেষণা চালিয়ে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন প্রতিদিন একটা করে সেদ্ধ ডিম মানুষকে হৃদরোগ থেকে দূরে রাখে এবং কমিয়ে দেয় স্ট্রোকের সম্ভাবনা। এ ছাড়াও এই গবেষণায় জানা যায় রোজ একটা করে ডিম সেদ্ধ খেলে মুক্তি মিলতে পারে ৯টি কঠিন দুরারোগ্য থেকে। ডিম আমাদের চোখ থেকে নখ, চুল থেকে যকৃৎ এবং পাকস্থলী থেকে মস্তিস্ক সব কিছুর সুস্বাস্থ্য বৃদ্ধি করে। 

বর্তমানে ডিমের গুরুত্ব অনুধাবন করে বিভিন্ন সরকারি স্কুলের মিড ডে মিলে একটি করে ডিম সেদ্ধ রাখা হচ্ছে যাতে শিশুদের শারীরিক বিকাশ ঘটে। আপনিও ডিমের অমোঘ জাদুগরীর সাক্ষী হতে চাইলে রোজ সকালে একটা করে ডিম সেদ্ধ নিজের প্লেটে রেখেই দেখুন। দেখবেন সুকুমার রায়ের 'ছিল রুমাল হয়ে গেল বিড়ালের' মতোই হয়তো, 'ছিল ডিম, হয়ে গেল সঞ্জীবনী' হয়ে যাবে নিমেষে।

More Articles