নীতীশ, কেজরি থেকে হেমন্ত, রাজ্যে রাজ্যে যেভাবে ধাক্কা খাচ্ছে বিজেপির রথ
বিহার, দিল্লির পর ঝাড়খণ্ডেও ধাক্কা খেল বিজেপি।
অপারেশন পদ্ম! কমলের কোমল ছোঁয়ায় রাজনৈতিকভাবে কুপোকাত একের পর এক রাজ্য সরকার। অভিযোগ, ঘোড়া কেনাবেচার (বিধায়ক) তাগিদ সঙ্গে নিয়েই দল, তারপর বিরোধী সরকার ভাঙানোর খেলায় মেতেছে নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহের দল। জগৎপ্রকাশ নাড্ডা-র (JP Nadda) জগৎজুড়ানো রাজনৈতিক খ্যাতির তীব্রতায় বিজেপি বিরোধীদের কপালে জমেছে শঙ্কার মেঘ। শেষ হয়েছে বিরোধীদের ক্ষমতা, এক একটি রাজ্যের সরকার। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে গলার জোর আর সংবাদমাধ্যমে শোরগোল ছাড়া তেমন একটা লড়াই দিতে পারেনি বিরোধীরা।
মোদি-শাহ কৌশল আর নাড্ডা-জাদুতে ফের মহারাষ্ট্রে মহা-নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। শিবসেনা নেতা, কংগ্রেস-এনসিপি সমর্থিত উদ্ধব ঠাকরে সরকারের মন্ত্রী একনাথ শিন্ডের (Eknath Shinde) ছোঁয়ায় অসম-যোগে 'ভ্যানিশ' হয়েছেন উদ্ধব। পদোবনতি মেনে নিয়েই শিন্ডের ডেপুটি হয়েছেন বিজেপি সরকারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র পদ্মনবিস। পারেনি বিরোধীরা। কংগ্রেস, এনসিপি-সহ একাধিক বিরোধী রাজনৈতিক দলের কৌশলের মধ্যেও বারবার ভেঙেছে ঘর।/ ঠিক এই পরিস্থিতিতে লোকসভা নির্বাচনের আগে খানিকটা মোদি বিরোধীদের একজোট হওয়ার চেষ্টা, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আবার বিরোধী ঐক্যে ফাটলের আবহেই হঠাৎ খেলা ঘুরিয়ে দেন বিহারীবাবু নীতিশ কুমার (Nitish Kumar) । ফের 'পাল্টি' খান তিনি। গেরুয়া-বন্ধু জনতা দল ইউনাইটেডে-র প্রধান, বিহার সরকারের মুখ্যমন্ত্রী রাতারাতি বদলে ফেলেন মত। বিহারে আকস্মিক পতন হয় বিজেপি-র। একদা লালুপ্রসাদ যাদব, তেজস্বী যাদবদের রাজনৈতিক বন্ধু, পরে শত্রু নীতিশ কুমার রাতারাতি বদলে দেন গো-বলয়ের অন্যতম রাজ্য বিহার সরকারের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। এখানেই লোকসভা নির্বাচন এবং গুজরাত বিধানসভা নির্বাচনের আগে প্রথম বড় ধাক্কা খায় বিজেপি! 'অপারেশন লোটাস' গো-হারা হারে বিহারে এসে। যেখান থেকেই সূত্রপাত হয় বিরোধী-খেলার নতুন চালের।
এবার সামনে এল ঝাড়খণ্ড। জনমুক্তি মোর্চা এবং কংগ্রেসের সরকার ভাঙানোর চেষ্টার অভিযোগ উঠল বিজেপি-র বিরুদ্ধে। বঙ্গের হাওড়া থেকে গাড়ি থেকে উদ্ধার হয় বিপুল পরিমাণ টাকা। সঙ্গে ধরা পড়েন ঝাড়খণ্ডের তিন বিধায়ক। কিন্তু খেলা জমেনি। আদিবাসী অধ্যুষিত রাজ্যে মোদি-বিরোধী দলের সরকার ভাঙানোর কৌশল চলেছে নিরন্তর। অভিযোগ উঠেছে, টাকা দিয়ে বিধায়ক কেনার! একের পর এক রাজনৈতিক যুদ্ধে জড়িয়েছে বিজেপি, হেমন্ত সোরেনের দল। যদিও বহু চেষ্টার অভিযোগের পরেও বিজেপি ভাঙতে পারেনি সরকার। ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনের বিরুদ্ধে একের পর এক আক্রমণ শানিয়েছে বিজেপি। তাঁকে পদ থেকে সরানোর আর্জিও করা হয়েছে। কিন্তু ঝাড়খণ্ডের এই রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেই পাল্টা চাল দেন হেমন্ত। নিজের আস্থা প্রমাণ করতে বিধানসভায় বিশেষ অধিবেশন এবং আস্থা ভোটের আবেদন জানান তিনি। ঝাড়খণ্ড বিধানসভার অধ্যক্ষের পৌরহিত্যে সোমবার অনুষ্ঠিত হয় আস্থা ভোট। বিজেপি বিধায়কদের অনুপস্থিতিতে ৮১ আসনের বিধানসভায় ৪৮ বিধায়কের ভোট পান হেমন্ত। জয়লাভ করেন শিবু-পুত্র। বিহারের পর ফের ঝাড়খণ্ডেও ধাক্কা খায় বিজেপি।
আরও পড়ুন: প্রতিপক্ষ গোটা বিজেপি নয়, অভিযোগেই প্রমাণ লড়াইটা আসলে অভিষেক বনাম শুভেন্দুর
এই ঘটনার ঠিক কয়েক দিন আগের ঘটনাক্রমে যদি চোখ বোলানো যায়, স্পষ্টতই চোখে পড়ে দিল্লির পরিস্থিতি। ১ সেপ্টেম্বর ৮০ আসনের দিল্লি বিধানসভায় আয়োজিত হয় আস্থা ভোট। ৭২ বিধায়কের আম আদমি দলে-র সরকার ৬৮ বিধায়কের সমর্থনে জয়লাভ করে। অরবিন্দের প্রতি আস্থা প্রমাণিত হয় ফের। যদিও ঝাড়খন্ড (Jharkhand) অথবা দিল্লি (Delhi), এই দুই রাজ্যেই শুধুমাত্র বিজেপির বিরুদ্ধে সরকার ভাঙানোর অভিযোগ তুলে নিজেদের পক্ষে আস্থা প্রমাণেই নতুন চাল দিয়েছেন হেমন্ত, অরবিন্দরা। যেখানে প্রমাণ করার চেষ্টা হয়েছে, বিজেপি টাকা এবং ক্ষমতা দিয়ে বিরোধী-শাসিত রাজ্যে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করলেও তাদের রাজ্যের ক্ষেত্রে গেরুয়া-কৌশল ব্যর্থ। এই পরিস্থিতিতে আগেভাগেই নিজেদের আস্থা প্রমাণ করে রেখেছেন তাঁরা। যদিও দিল্লির মণীশ শিশোদিয়া (Manish Sisodia) এবং মাদক দুর্নীতির অভিযোগ, লুক আউট নোটিশ। আপ (AAP) বিধায়কদের ২০ কোটি টাকা দেওয়ার টোপের অভিযোগ উঠেছিল আগেই। সিবিআই (CBI) , ইডি-কে (ED) রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করছে বিজেপি, তৃণমূলের (TMC) সুরে সেই অভিযোগও করেন অরবিন্দ কেজরিওয়ালরা (Arvind Kejriwal)।
প্রসঙ্গত, পাঞ্জাবে (Punjab) বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল জয়ের পরে মোদি-অমিতের রাজ্য গুজরাতের রাজনীতিতে পা রেখেছে আম আদমি দল। সুরাত-সহ একাধিক এলাকায় উল্লেখযোগ্য প্রভাব বিস্তার করছেন অরবিন্দপন্থী নেতারা। এই প্রেক্ষাপটে আগামী ডিসেম্বরের গুজরাত বিধানসভা নির্বাচনে, বিজেপি বিরোধী হিসেবে কংগ্রেস ছেড়ে আপ-কে আপন করতে পারেন গুজরাতের (Gujarat) জনতা! এমন জল্পনা-কল্পনাও শুরু হয়েছে রাজনৈতিক মহলের অন্দরে। যা আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে পদ্মশিবিরের কাছে বড় ধাক্কা হতে পারে। বারবার মোদি-রাজ্যে কেজরিয়ালের আগমনে এই আলোচনা শুরু হয়েছে রাজনৈতিক মহলের অন্দরেও। যে পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে বিজেপি-র (BJP) তরফে তাদের রাজনৈতিক কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বী আপ-কে আটকে দেওয়ার কৌশল নেওয়া হয়েছে। যার অঙ্গ হিসেবে কেন্দ্রীয় এজেন্সির অপব্যবহার করা হচ্ছে, এই অভিযোগ করছে আপ। সেই আবহেই আস্থা ভোটের ডাক। যেখানে কটাক্ষ ছুড়েছে পদ্ম শিবির। যদিও রাজনৈতিক মহলের একাংশের মত, দিল্লির আস্থাভোট এবং অরবিন্দ জয় বিজেপির তথাকথিত 'অপারেশন' (Operation Lotus) সফল করার ক্ষেত্রে মারাত্মক অসুবিধার সৃষ্টি করেছে। যা মোদি-শাহের ভাবমূর্তি এবং গেরুয়া-শিবিরের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ, এই দুইয়ের আঙিনায় কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করেছে। যে অবস্থায় সুগ্রীবের দোসর হয়েছে ঝাড়খন্ড (Jharkhand) । যেখানে কংগ্রেস সমর্থিত হেমন্ত সোরেন-সরকার (Hemant Soren) ভাঙার চক্রান্তে সফল হওয়া যায়নি। মনিপুরে পাঁচ বিধায়ক নিজেদের দিকে নিয়ে নেওয়ার পরে অথবা রাজস্থান, পঞ্জাব, ছত্তিশগড়ের মতো রাজ্যে সরকার অথবা দল ভাঙানোর খেলার অভিযোগ জল-জঙ্গলের রাজ্যে সার্থক হয়নি। একাধিক অভিযোগ, বিজেপি-সহ বিরোধীদের হেমন্ত-বিদ্বেষের পরেও আস্থা ভোটে জয় এসেছে। কিন্তু সেখানেও প্রশ্ন তুলেছে জনপ্রতিনিধি বাঁচানোর তাগিদ নিয়ে। মহারাষ্ট্র-নাটকে (Maharashtra) অসম আর ঝাড়খন্ড-পর্বে সাহায্য করেছে কংগ্রেসের ছত্তিশগড়। ভূপেশ বাঘেল সরকারের (Bhupesh Baghel) রাজ্যে হেমন্তের বিধায়করা গিয়েছেন। সর্বোপরি সরকারি দলের বিধায়কদের রাখা হয়েছে রায়পুরে। ভোটের আগে ফিরিয়ে আনা হয়েছে তাঁদের। হেমন্ত জিতেছেন। কেজরিওয়ালের থেকেও কঠিন যুদ্ধ জয় করেছেন তিনি। আটকে দিয়েছেন রাজনৈতিক টার্গেট। ফের মুখ থুবড়ে পড়েছে বিজেপি। গেরুয়া নেতাদের অস্বীকার, দাবি পাল্টা দাবির আবহেই জমেছে রাজনৈতিক নাটক। সুদৃশ্য মঞ্চ সেজেছে নতুনভাবে।
কিন্তু প্রশ্ন উঠছে এখানেই। দিল্লি অথবা ঝাড়খণ্ড এমনকী, মহারাষ্ট্র পরিস্থিতিকে রূপকে হিসেবে ধরলে, এই সরকার ভাঙার ইতিহাস নতুন নয়। প্রতি সেকেন্ডে দেশজুড়ে এক একটি পথ দুর্ঘটনার মতোই ঘটতেই থাকে দল পরিবর্তন। আর এই পরিবর্তনের হাত ধরেই জনতার ইচ্ছা, জনতার চাহিদার অসম্মানে মুহূর্তেই খেলা জমে সরকার পাল্টে দেওয়ার। ২০১৯, ২৮ জুন। সংসদে দেশের স্বরাষ্টমন্ত্রী অমিত শাহ (Amit Shah) দাবি করেন, ৯৩ বার কংগ্রেস ৩৫৬ ধারার অপব্যবহার করে রাজ্যে রাজ্যে সরকার ভেঙেছে। আর একটি তথ্য বলছে, ১৯৫২ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত একাধিকবার নানা কারণে রাজ্যে রাজ্যে সরকার ভেঙেছে কংগ্রেস। যেমন, ১৯৫৩ সাল। পাতিয়ালা, পূর্ব পঞ্জাবে জিয়ান সিং রেয়ারয়ালা সরকার। ১৯৫৯ নাগাদ কেরলে নাম্বুরিপাদ সরকার। ১৯৬৬ সালে গোয়ার দয়ানন্দ বন্দরকর সরকার। ১৯৭১ সালে তিনবার। জানুয়ারি, মার্চ, মে। এই তিন মাসে উড়িষ্যা, কর্নাটক, গুজরাত সরকার ভাঙে কেন্দ্র। ১৯৭৩-র মার্চ এবং ১৯৭৪-র ডিসেম্বর, পরপর সরকার ভাঙে মনিপুরে। ১৯৭৬-এ তামিলনাড়ুতে করুনানিধি বিদায়। ১৯৮৪ সালে সিকিম, জম্মু ও কাশ্মীর (Jammu and Kashmir), অন্ধ্রপ্রদেশে সরকার পরিবর্তন। ১৯৯২ সালে সরকার ভাঙা, অন্য দলের মুখ্যমন্ত্রী হওয়া বা সরকার পরিবর্তনের রেকর্ড ঘটে। মেঘালয়, মণিপুর, নাগাল্যান্ড, উত্তরপ্রদেশ, হিমাচল প্রদেশ, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ; দামামা বাজায় এই রাজ্যগুলো। ২০০৯ সালে মেঘালয়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সমালোচনার মুখে ঠেলে দেয় কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন কেন্দ্র সরকারকে। অর্থাৎ সরাসরি দল ভাঙিয়ে অথবা ঘোড়া কেনাবেচার (বিধায়ক) মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের অভিযোগ কংগ্রেস শাসনে খুব একটা না উঠলেও নানা অছিলায় সরকার বদলেছে বারবার। প্রশ্ন উঠেছে কংগ্রেসের ভূমিকা নিয়েও। যা তীব্র হয়েছে মোদি-রাজত্বে। যেখানে টাকা আর ক্ষমতার বশে বন্দি করার অভিযোগ উঠেছে গণতন্ত্রকে। গেরুয়া-ফন্দিতে একের পর এক জনতার প্রতিনিধি টাকার কাছে বেঁচেছেন নীতি, আদর্শ; অভিযোগ উঠেছে এমনও। এই অভিযোগের আবহেই নেতাদের চারিত্রিক, বিশেষত একজন মানুষের ভোটে জিতে আসা জনপ্রতিনিধির চিরাচরিত টাকায় বিক্রি হয়ে যাওয়ার অভ্যাসকেও দায়ী করছেন কেউ কেউ। ওই অংশের যুক্তি, ভোট আর মানুষ এখানে গৌণ। সরকার ভাঙিয়ে নেওয়া, জোর করার অভিযোগ তুলে গলার স্বর চড়ানো এখানে অপ্রাসঙ্গিক। সবার আগে ভাবা উচিৎ, যিনি বা যাঁরা বিক্রি হচ্ছেন তাঁরা কেন এমন কাজ করছেন? তাঁদের টাকার লোভ, ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ আর ব্যক্তিগত শত্রুতা ছাড়া উন্নয়নের জন্য আর কীসের দায় রয়েছে, যার দরুন বারবার বিক্রি হচ্ছেন ওঁরা?