হিজাবের আগুনে পুড়ছে ইরান! কেমন ছিল ইরানের মহিলাদের অতীত
Hijab Protest in Iran: মাহশা হিজাব না পরে রাস্তায় বেরোন। তাই তাঁকে শিক্ষা দিতেই দেশের নীতি পুলিশ আমিনিকে গ্রেফতার করে। এরপরেই রহস্যজকভাবে কোমায় চলে যায় আমিনি।
গর্জে উঠেছে ইরানের মেয়েরা। দেশজুড়ে প্রতিবাদের আগুন জ্বলে উঠেছে ২২ বছরের মাহশা আমিনির মৃত্যুকে ঘিরে। যথাযথভাবে হিজাব না পরার অপরাধে মাহশার মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না দেশের মহিলারা। বিক্ষোভ থামাতে ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করেছে সাধারণ জনগণের উপর। গত ছ’দিনে ৩১ জন সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে অসলোর এক মানবাধিকার সংগঠন। যদিও তেহরান তা মানতে নারাজ। আন্তর্জাতিক স্তরেও সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে ইরান সরকারকে। নেট নাগরিকরাও সামিল হয়েছেন প্রতিবাদে। যদিও মৃত্যু থামাতে পারেনি সে দেশের মহিলাদের।
কী হয়েছিল মাহশা আমিনির সঙ্গে?
মাহশার পৈতৃক বাড়ি ইরানের পশ্চিম প্রান্তে কুর্দিস্তান অঞ্চলে। গত ১৩ সেপ্টেম্বর বাড়ি থেকে পরিবারের সঙ্গে বেরিয়েছিলেন রাজধানী তেহরানের উদ্দেশ্যে। সেই সময় তাঁদের গাড়ি আটকায় ইরানের নীতি পুলিশ। ইসলামিক রীতি মেনে মহিলারা পোশাক পরছেন কিনা, যথাযথভাবে হিজাব পরেন কিনা তা দেখাই এই নীতি পুলিশদের কাজ। সেদিন মাহশা হিজাব না পরে রাস্তায় বেরোন। তাই তাঁকে শিক্ষা দিতেই দেশের নীতি পুলিশ আমিনিকে গ্রেফতার করে। এরপরেই রহস্যজনকভাবে কোমায় চলে যায় আমিনি। হাসপাতালে ভর্তি করার তিনদিন পরে তাঁর মৃত্যু হয়। মনে করা হচ্ছে, পুলিশি হেফাজতে থাকাকালীন আমিনির ওপর অত্যাচারেই এই পরিণতি হয়েছে তাঁর। যদিও পুলিশ একথা মানতে নারাজ। তাঁদের বক্তব্য, আগে থেকেই হৃদরোগের সমস্যা ছিল আমিনির। অন্যান্য গ্রেফতার হওয়া মহিলাদের সঙ্গে থাকাকালীন আমিনি হঠাৎই হৃদরোগে আক্রান্ত হন। যদিও আমিনির পরিবারের সদস্যদের দাবি, কোনওরকম শারীরিক সমস্যা ছিল না তাঁর। ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসতেই পূর্ণাঙ্গ তদন্তের দাবি জানায় সে দেশের মানবাধিকার সংগঠন। সমালোচনার মুখে পড়ে পুলিশের তরফে একটি সিসিটিভি ফুটেজ প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে আমিনির সঙ্গে কথা বলার সময়ে মাঝের ১৯ সেকেন্ডের ফুটেজ নেই, যা নিয়ে ২২ বছরের আমিনির মৃত্যুকে ঘিরে রহস্য দানা বেঁধেছে।
ইরানের হিজাব আইন কী?
১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের পর থেকে সেদেশের মহিলাদের প্রকাশ্যে হিজাব পরা বাধ্যতামূলক। ইসলামিক শরিয়া রীতি মেনে দেশের মহিলারা পোশাক পরছেন কিনা তার নজরদারি করে দেশের নীতি পুলিশ। সে দেশে ইসলামিক রীতি অনুযায়ী মহিলাদের জনসমক্ষে মাথার চুল সম্পূর্ণভাবে ঢাকা ও ঢিলেঢালা পোশাক পরতে হবে। দেশের মহিলাদের শিক্ষা, চাকরির সুযোগ রয়েছে। বাড়ির মহিলারা বাড়ির ভিতরে যে কোনও পোশাক পরতে পারেন কিন্তু বাইরে বেরোলে সংযতভাবেই বেরোতে হবে।
আরও পড়ুন- সংস্কৃত থেকে রামায়ণ অনুবাদ করেছিলেন এই মুসলিম মহিলা! কেমন ছিলেন মুঘল যুগের প্রভাবশালী নারীরা?
ইরানের মহিলাদের প্রতিবাদ
তরুণী মাহশা আমিনির মৃত্যুকে ঘিরে গত শনিবার থেকেই সে দেশে প্রতিবাদে সামিল হন ইরানি মহিলারা। এখনও পর্যন্ত ইরানের প্রায় ৮০ টি শহরে আমিনির মৃত্যুর প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়েছে। দেশের উত্তর পশ্চিম প্রান্তের কুর্দিস্তান অঞ্চলেই প্রথম প্রতিবাদ শুরু হয়। ইরানের মেয়েরা মাহশার মৃত্যুর পর হিজাব পুড়িয়ে, মাথার চুল কেটে ফেলে প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন। প্রতিবাদীদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাস, পাথর এমনকী গুলিও চালানো হয়েছে। এখনও পর্যন্ত ৩১ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে অসলোর মানবাধিকার সংগঠন। তবে দেশের সংবাদ মাধ্যমের মতে ১৭ জন মারা গিয়েছেন।
তেহরান এবং কুর্দিস্তানের বেশ কিছু জায়গায় বৃহস্পতিবার বিক্ষোভকারীরা থানা এবং পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর করেন। এমনকী পুলিশের ওপর হামলা করে তাঁরা। শেষ ২০১৯ সালে গ্যাসোলিনের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সরকারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছিল দেশের জনগণ। তারপর মাহশার মৃত্যুকে ঘিরে এত বড় আকারের আন্দোলনের মুখে পড়ল খোমেইনির নেতৃত্বে গড়ে ওঠা সরকার। ইরানি মহিলাদের পোশাক বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে পথে নেমেছেন কানাডা, তুর্কি, গ্রীসের মহিলারাও। আমেরিকার হোয়াইট হাউসের তরফে জানানো হয়েছে, “ইরানের মহিলাদের নিজের পছন্দ মতো পোশাক পরার স্বাধীনতা থাকা উচিত। এই মুহূর্তে ইরানের প্রতিবাদী মহিলাদের ওপর অত্যাচার বন্ধ হওয়া উচিত।” আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও ইরানি মহিলাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
ইরান সরকারের প্রতিক্রিয়া
ইরানের সংবাদ সংস্থার তরফে জানা গেছে, দেশের সরকার বিক্ষোভকারীদের সতর্ক করে জানিয়েছে, প্রতিবাদে সামিল হওয়া আইনসম্মত নয়। তাই প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে যথাযোগ্য ব্যবস্থা নেবে প্রশাসন। তেহরানের গভর্নর জানিয়েছেন, বুধবার রাজধানী থেকে প্রতিবাদে সামিল তিনজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। কুর্দিস্তানের গভর্নর জানিয়েছেন, অশান্তি ছড়ানোর কারণে এখনও পর্যন্ত প্রায় ২৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এরমধ্যে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে পুলিশের গুলিতে।
আরও পড়ুন- দেবতার যৌনতাকে বস্ত্রে ঢেকেছে মানুষ, শ্লীল অশ্লীলের বেড়া ভেঙেছেন রহস্যময়ী লজ্জা গৌরী
একসময়ের ইরানের স্বাধীন মহিলারা
তিন দশক আগেও কিন্তু ইরানের মহিলাদের হিজাব পরা নিয়ে তটস্থ হয়ে থাকতে হতো না। বরং নিজের স্বাচ্ছন্দ্য মতোই পোশাক পরতে দেখা যেত মহিলাদের। ১৯৭৯ সালে দেশের রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল দেখা যায়। পহলভি রাজবংশের শাসক শাহ মহম্মদ রেজাকে সরিয়ে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেইনির নেতৃত্বে ইসলামিক রিপাবলিক সরকার গঠন করেন। রাজ পরিবারের ক্ষমতা শেষ হতেই বদলে যায় ইরানের সামাজিক রীতিনীতি ও আইন। অথচ রাজ পরিবারের অধীনে মহিলারা হিজাব পরার পাশাপাশি জিন্স, ছোট হাতের টপ ও মিনি স্কার্ট পরে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াতে পারতেন সে দেশে। সমুদ্র সৈকতে বিকিনি পরেও দেখা যেত সে দেশের মহিলাদের। চোখে রোদ চশমা ও পায়ে বাহারি জুতো পরতেন ইরানি মহিলারা।
১৯৭৭ সালের আগে দেশের মহিলারা তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতেন। দেশে উচ্চশিক্ষিত মহিলাদের সংখ্যা ছিল বেশ নজরকাড়া। দিব্যি চুল খুলে রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে পারতেন ইরানি মহিলারা। এখন সেলুন থাকলেও মহিলাদের আনাগোনা অনেক কমেছে। খোমেইনির নেতৃত্বে সরকার গঠনের পর সম্পূর্ণ বদলে গেছে মহিলাদের জীবন। এর আগেও একাধিকবার প্রতিবাদে নেমেছেন ইরানি মহিলারা। কিন্তু এবারে কি সরকারের কাছ থেকে নিজের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে পারবেন?