যিশু ও মহম্মদ হিন্দু! সাধুদের উদ্ভট মন্তব্যের নেপথ্যে হিন্দু ধর্মের ভেতরের লড়াই?
Hindu Fundamentalism: ট্র্যাড এবং রায়তাস আসলে কী এবং কীভাবে হিন্দু ডানপন্থীদের তারা ভাগ করছে?
আদতে খ্রিস্টান নয়, বরং হিন্দু ছিলেন যিশুখ্রিস্ট। এরকমই একটি অবাস্তব দাবি নিয়ে এবারে বিতর্কে কেন্দ্রবিন্দু পুরীর গোবর্ধন পিঠের শংকরাচার্য স্বামী নিশ্চলানন্দ সরস্বতী। তিনি আরও দাবি করেছেন, ভারতে নাকি দশ বছর কাটিয়েছিলেন যিশুখ্রিস্ট, তার মধ্যে তিনি পুরীতেই তিন বছর থেকেছিলেন এবং সেই সময় হিন্দু ছিলেন তিনি। পরে তাঁকে ধর্মান্তরিত করা হয় বলে দাবি করেছেন তিনি। তবে এই মন্তব্যের পাশাপাশি তিনি দাবি রেখেছেন, এর পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর কাছে যথেষ্ট যুক্তি এবং প্রমাণও রয়েছে।
নিশ্চলানন্দের দাবি, বাইবেলে যিশুর জীবনের ১০ বছরের কোন উল্লেখ নেই। কারণ সেই সময় তিনি ছিলেন ভারতে এবং সেই সময়ে তিনি হিন্দু ছিলেন। দশ বছর ভারতে থাকার সময় বৈষ্ণব ধর্মের বিশ্বাসী ছিলেন যিশুখ্রিস্ট। পাশাপাশি পুরীতে গিয়ে শঙ্করাচার্যের কাছ থেকে ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন বলেও দাবি রেখেছেন এই শংকরাচার্য। শুধু যিশুই নয়, তার বাবা-মাও হিন্দু ছিলেন বলে দাবি করেছেন পুরীর এই সন্ন্যাসী।
তবে এখানেই তিনি থেমে থাকেননি। নবী মহম্মদও হিন্দু ছিলেন বলেই দাবি তাঁর। স্বভাবতই এই ধরনের কথায় তুমুল আলোচনা শুরু হয়েছে নানা মহলে। পুরীর শংকরাচার্য মনগড়া মিথ্যা কথা বলছেন বলে অভিযোগ করেছেন অনেকে। ভুবনেশ্বরের আর্চবিশপ জন বড়ুয়া বলছেন, "এইরকম কথা আগে কেউ কখনও বলেননি। বাইবেলে এই ধরনের কথা লেখা নেই। যিশু হিন্দু ছিলেন, এই কথা কোথাও লেখা নেই। যদি তিনি সত্যি হিন্দু হয়ে থাকেন এবং পরবর্তীকালে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন তাহলে খ্রিস্টধর্মের সূচনা হলো কোথা থেকে?"
আরও পড়ুন: হাহাকার, মৃত্যু, কান্না! ফিরে দেখা নোটবন্দির বিভীষিকাময় দিনগুলো
যদিও হিন্দু ধর্মের ধর্মগুরুদের এই ধরনের মন্তব্য এই প্রথম নয়। ভারতে এই ধরনের আশ্চর্য মন্তব্য করার লোকের কোনও কমতি নেই। এর আগেও বহু ধর্মগুরু মহিলাদের ঋতুস্রাব থেকে শুরু করে করোনাভাইরাস নিয়ে এমন কিছু মন্তব্য রেখেছেন, যার কোনও ভিত্তি নেই। স্বামীনারায়ণ ভুজ মন্দিরের স্বামী কৃষ্ণদাসের একটি ভিডিও কিছুদিন আগে ভাইরাল হয়, যেখানে তাঁকে বলতে শোনা যায়, যদি কোনও মহিলা ঋতুস্রাব চলাকালীন সময়ে রান্না করেন, তাহলে তিনি পরের জন্মে কুকুর হবেন। এছাড়াও যদি আপনি এই মহিলার হাতের খাবার খান, তাহলে আপনার পরবর্তী অবতার ষাঁড় হবে।
এই ঘটনার পরেই গুজরাতের ভুজের একটি শিক্ষা সংস্থানের ৬৮ জন পড়ুয়াকে তাদের পোশাক খুলতে বাধ্য করা হয়। প্রশাসন এটা দেখতে চাইছিল, মেয়েদের পিরিয়ডস চলছে কি না। পরবর্তীতে সেই ব্যক্তিদের আটক করা হলেও, এই ধরনের ঘটনা ঘটার পিছনেও একটা কারণ আছে। এই কারণটি হলো, এই শিক্ষা-সংস্থাটি চালাচ্ছিলেন ভূজের স্বামীনারায়ণ মন্দিরের ভক্তরাই। তাই যদি সেই মন্দিরের গুরু এরকম মন্তব্য করেন, তাহলে তার চ্যালারা সেরকম কাজ তো করবেনই।
ইশা ফাউন্ডেশনের জাগ্গী বাসুদেব অর্থাৎ সদগুরু একবার বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেছিলেন, যদি কোনও মহিলার যমজ সন্তান হয় এবং তার মধ্যে একটি হয় ছেলে এবং অন্যটি হয় মেয়ে, তাহলে ওই মহিলার দুটি স্তন আলাদা আলাদা দুধ তৈরি করবে।
আবার ইয়েতি নরসিংহানন্দ এদের থেকে অনেকটাই এগিয়ে। তিনি আবার সরাসরি উত্তরাখণ্ড পুলিশকেই অভিশাপ দিয়ে বসেছেন। ট্যুইটারে অ্যারেস্ট ইয়েতি নরসিংহানন্দ ট্রেন্ডিং চললেও কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলো না। তবে এই প্রথম নয়, এর আগেও তাঁর মুখে এরকম কথা শোনা গিয়েছে। হিন্দু বাদে অন্য ধর্মের মানুষকে হত্যা করার উপদেশের পাশাপাশি আরও অনেক মন্তব্য তিনি করেছেন। হরিদ্বারে জেনোসাইড কনফারেন্স, মহিলা রাজনীতিবিদদের রক্ষিতা বলা, সব কিছুই করেছেন তিনি। কিন্তু, এইরকম মন্তব্য এই ধার্মিক ব্যক্তিরা করেন কেন? আসলে তাঁদের লক্ষ্য একটাই, হিন্দু ধর্মচর্চার শীর্ষে পৌঁছনো।
এতদিন পর্যন্ত 'অন্ধ ভক্ত', 'টুকরে টুকরে গ্যাং'-এর মতো কিছু বিষয় প্রচলিত থাকলেও, এবারে হিন্দু ধর্মের মধ্যেই তৈরি হয়েছে দু'টি আলাদা গ্রুপ। একটি নাম হলো ট্র্যাডস, এবং অপরটির নাম হলো রায়তাস। বলতে গেলে এই দু'টি গ্রুপের মধ্যে একেবারে সাপে-নেউলে সম্পর্ক। কিন্তু, এই দুটো গোষ্ঠী আসলে কারা এবং কীভাবে হিন্দু ডানপন্থীদের তারা ভাগ করছে?
প্রথমে জানা দরকার, এই ট্র্যাডস কারা। ভারতে যতই বিকাশের নামে রাজনীতি হোক না কেন, প্রতিটি রাজনৈতিক দলই শেষ পর্যন্ত আইডেন্টিটি পলিটিক্সের ওপরই ভরসা করে থাকে। তাই বিকাশ হোক বা না হোক, আইডেন্টিটি পলিটিক্স সবসময়ই জীবিত রয়েছে ভারতে। আর যদি বিকাশ নাও হয়ে থাকে, তবুও ধর্মের নিরিখেই ভারতের রাজনৈতিক দল পাবে ভোট। কিন্তু এই আইডেন্টিটি পলিটিক্স আজ শুধুমাত্র ধর্মের মধ্যে সীমিত নেই। বুল্লি বাই অ্যাপ্লিকেশন কাণ্ডের পর জানা গিয়েছে, ভারতীয় হিন্দু ডানপন্থী গোষ্ঠীর মধ্যেই দু'টি আলাদা গ্রুপ তৈরি হয়ে গিয়েছে। এবং এই দু'টি গ্রুপের নাম TRADS ও RAITAS। সুল্লি ডিলস ও বুল্লি বাই অ্যাপ বানানোর মূল কারণটাও এইটাই ছিল, স্থানীয় মুসলিম মহিলাদের চুপ করিয়ে দেওয়া।
এই বুল্লি বাই কান্ডের পরেই এই ট্র্যাড বিষয়টা সামনে আসলেও, এখন হিন্দু ধর্মের মধ্যে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছে এই বিষয়টি। একটু ভালোভাবে খোঁজ করলে দেখা যাবে ইন্টারনেট দুনিয়ায় এই বিষয়ক বহু আর্টিকেল রয়েছে। যেগুলিতে সরাসরি লেখা রয়েছে, TRAD বা TRADITIONAL একটি 'প্রগতিশীল' গ্রুপ, যাকে এখন আপনারা কোনওভাবেই সরিয়ে দিতে পারবেন না। ফেসবুক-ট্যুইটারের মতো সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্ম থেকে শুরু করে বহু সোশ্যাল মিডিয়া মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছেন এই ট্র্যাডিশনালরা। আর হিন্দু ধর্মকে মাথায় তুলে অন্য ধর্মের মানুষকে এবং ধর্মবিশ্বাসের অবমাননা করাই এই TRADS-এর প্রধান লক্ষ্য।
এই ধরনের গ্রুপ মূলধারার রাজনীতি এবং সংবাদমাধ্যমকে সরিয়ে রেখে অনলাইন মাধ্যমে মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ করে থাকে। পাশাপাশি, ধর্ম এবং জাতির নিরিখে ক্রমাগত উত্তেজক মন্তব্য ছড়িয়ে দেয় সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে। এই ট্র্যাডস অনলাইন মাধ্যমে শুরু হলেও, আজ প্রকাশ্যেই এই ধরনের চর্চা চলছে ভারতে। শংকরাচার্য থেকে শুরু করে নরসিংহানন্দ- সকলেই এই ট্র্যড গ্রুপের সদস্য হয়ে উঠতে শুরু করেছেন ধীরে ধীরে।
Trads ও Raitas- এদের দু'জনেরই লক্ষ্য হিন্দু রাষ্ট্র, তবে দুই দলের মধ্যে রয়েছে কিছুটা তফাৎ। যেখানে রায়তাস চাইছে হিন্দু একত্রিত হয়ে অন্য ধর্মের উপরে প্রভাব বিস্তার করুক, সেখানেই ট্র্যাডিশনালরা চাইছেন মনুস্মৃতি ফিরিয়ে আনতে। ট্র্যাডিশনালরা ব্রাহ্মণ আধিপত্য এবং পিছিয়ে পড়া শ্রেণির বিনাশও চাইছেন একইভাবে। পাশাপাশি অন্য ধর্মের প্রতি অপমান তো রয়েছেই। এই কারণেই, তাদের মন্তব্যে বারংবার উঠে আসে খ্রিস্টান অথবা মুসলিম ধর্মের বিরুদ্ধাচরণ। তবে, এমনিতে পিছিয়ে পড়া শ্রেণির বিনাশ চাইলেও, ভোটের জন্য কিন্তু দলিতদের হিন্দু বলতে তাদের কোনও অসুবিধা নেই। নিজেদের পোস্টের মধ্যে পিছিয়ে পড়া শ্রেণিকে আরশোলা অথবা উইপোকা হিসেবে দেখালেও, ভোট পাওয়ার সময় কিন্তু এই পিছিয়ে পড়া দলিত শ্রেণিভুক্ত মানুষরাই হয়ে ওঠে হিন্দু।
তবে, ট্র্যাডরা কিন্তু অনেক সময় মোদিরই বিরোধিতা করে থাকে। তার দু'টি কারণ রয়েছে, প্রথমত মোদি ওবিসি শ্রেণিভুক্ত, ফলে, হিন্দু ধর্মের ধ্বজাধারী হিসেবে মোদিকে সামনে রাখা তাদের জন্য অপমানজনক। পাশাপাশি, তারা মনে করে, মুসলিমদের প্রতি মোদি কিছুটা হলেও নরম, তাই এরা কিন্তু মোদিকে সরাসরি মওলানা মোদি বলেও ডেকে থাকেন। অন্যদিকে, রায়তা-রা কট্টরপন্থী মোদিভক্ত। হিন্দু দেশপ্রেমিক হিসেবে দাবি করলেও, তারা অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে আলোচনায় প্রস্তুত। অন্যদিকে, তারা নিজেরাও মনে করে, ট্র্যাড আসলে একটি গর্হিত নীতি, যা ভারতের ভবিষ্যৎকে আরও খারাপ দিকে নিয়ে যাবে।
২০১৯ সালে বিজেপির ভোট শেয়ার ২০১৪ সালের থেকে ছিল অনেকটাই বেশি। ২০১৪ সালে যেখানে বিজেপি ভোট পেয়েছিল ৩১ শতাংশ, সেখানেই ২০১৯ সালে বিজেপি ভোট পেয়েছিল ৩৭ শতাংশ। রিপোর্ট অনুসারে, ২০১৯ সালে বিজেপির এই ভোট শেয়ার বৃদ্ধি মূলত সেই সমস্ত গ্রুপের মাধ্যমে হয়েছিল, যারা এতদিন পর্যন্ত সরাসরি বিজেপির ভক্ত ছিল না। ২০১৪ সালে মাত্র ২৪ শতাংশ দলিত ভোট বিজেপির দিকে গিয়েছিল। সেখানেই ২০১৯ সালে ৩৪ শতাংশ দলিত ভোট বিজেপির দিকে যায়। ২০১৪ সালে ৩৪ শতাংশ ওবিসি ভোট যেখানে বিজেপির দিকে গিয়েছিল, সেখানেই ২০১৯ সালে ৪৪ শতাংশ ওবিসি ভোট বিজেপি দখল করতে পারে। আর উচ্চবর্ণের ভোট যেখানে ২০১৪ সালে ৪৭ শতাংশ গিয়েছিল বিজেপির দিকে, সেখানেই ২০১৯ সালে ৬১ শতাংশ উচ্চ বর্ণের ভোট বিজেপির দিকে যায়।
তবে, এখন এই ট্র্যাডিশনালদের অবাধ বৃদ্ধি শুরু হয়েছে ভারতে। বলতে গেলে কোনও শক্তি তাদের আটকাচ্ছে না। এদের চিন্তাধারা এতটাই ডানপন্থী এবং এতটাই কট্টরপন্থী যে, তাদের এই চিন্তাধারা হয়তো ওবিসি কিংবা দলিতদের আরও ভয় পাইয়ে দিতে পারে। তাদের জন্য ইয়েতি কিংবা শংকরাচার্যের মতো মানুষ হিরো। এরা এতটাই ডানপন্থী যে, তাদের কাছে মোদিও কিছুই নন। মনে হতে পারে, এই কয়েকজন মাত্র এই গ্রুপের সদস্য, কিংবা অল্প লোকই এরকম চিন্তাধারা রাখে। তবে ব্যাপারটা একেবারেই সেরকম নয়। এদের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনও অভিযোগ দায়ের করা হয় না। এদের ফলোয়ারের সংখ্যাও কিন্তু কম নয়। হয়তো প্রকাশ্য মঞ্চে, এই নেতাদের মন্তব্য সরাসরি হিন্দুত্ববাদী এবং ততটা হিংসক নয়, তবে, নেটমাধ্যমে এবং নিজেদের কমিউনিটির মধ্যে তাদের বক্তব্য যে কতটা কট্টরপন্থী, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।