৪০০ বছর ধরে বাংলায় হয় কালো দুর্গার পুজো! কোন ইতিহাস লুকিয়ে আড়ালে

আমরা সাধারণত মা দুর্গাকে গৌরবর্ণ রূপে দেখেই অভ্যস্ত। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে দু'টি এমন বাড়ি আছে, যেখানে মা দুর্গার রূপ কালো।

আর মাত্র কয়েকদিনের অপেক্ষা। তারপরেই উমা আসছেন তার বাপের বাড়ি। কৈলাস থেকে ছেলে-মেয়ে নিয়ে সপরিবারে ধরাতলে আসবেন তিনি। ঢাক, কাঁসর-ঘণ্টা, লাইটিং-এ মেতে উঠবে গোটা বাংলা। আকাশে শরতের পেঁজা তুলোর মতো মেঘ, কাশফুল এবং শিউলি ফুলের গন্ধ জানান দেবে মায়ের আগমনী বার্তার। এই সময়ের জন্য বাঙালি চিরকাল অপেক্ষা করে থাকে। সেইমতো শুরু হয়ে গিয়েছে পুজোর থিম নিয়ে প্রস্তুতি পর্ব। প্যান্ডেল হপিং থেকে শুরু করে খিচুড়ি-লাবড়া আর স্ট্রিট ফুড খাওয়া, পুজোর চারদিন যেন কোনও ডায়েটই মানা হয় না।

বারোয়ারি থেকে বনেদি কোনও পুজোই বাদ দেওয়া যায় না। এক-এক পুজোর এক এক বৈশিষ্ট্য। কোথাও মায়ের মূর্তি সাবেকি, তো কোথাও মায়ের সাজসজ্জায় রয়েছে চমক। কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গে বহু বনেদি বাড়িতে দুর্গাপুজো হয়ে থাকে। কিন্তু এমন কিছু পুজো আছে, যেখানে চমক থাকলেও সেই পুজো সম্বন্ধে আমরা অনেকেই অবহিত থাকি না। আমরা সাধারণত মা দুর্গাকে গৌরবর্ণ রূপে দেখেই অভ্যস্ত। কিন্তু কলকাতা আর পশ্চিমবঙ্গে দু'টি এমন বাড়ি আছে, যেখানে মা দুর্গার রূপ কালো। সেখানে কালো রূপেই মা দুর্গা পূজিত হয়ে আসছেন। মা এখানে কৃষ্ণবর্ণের, কিন্তু তিনি কালী নন। একটি ক্যানিংয়ের ভট্টাচার্যবাড়ির ৪৩৭ বছরের পুজো আর অন্যটি কলকাতার বেলেঘাটায় আরেক ভট্টাচার্যবাড়ির ২৯০ বছরের পুজো।

ক্যানিংয়ের ভট্টাচার্যবাড়ি
মা দুর্গার নাম নিলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক রণংদেহি মূর্তি। মহিষাসুরের বিনাশ করার জন্য যাকে আহ্বান করা হয়েছিল। সেই দেবীর যেমন তেজ, তেমনই সৌন্দর্য। দক্ষিণ ২৪ পরগনার ক্যানিং থানার ভট্টাচার্যবাড়ির দুর্গার রূপ একটু ভিন্ন। এই বাড়ির মা দুর্গার মুখের রঙ কালো। কিন্তু মুখ বাদে গোটা শরীর ঝলসানো, তামাটে রঙের। দেবী নাকি এই বাড়িতে এমন বর্ণেই পূজিত হতে চেয়েছিলেন।

আরও পড়ুন: ২,৫০০ টাকার দুর্গাপুজোর জাঁকজমক চোখ ধাঁধিয়ে দিত, সেই কলকাতা ধরা আছে প্রবাদে

ক্যানিংয়ের ভট্টাচার্য বাড়ির দুর্গাপুজো শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের পাইনখাড়া গ্রামে। ১৫৮৫ সালে, অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ৪৩৭ বছর আগে। সেসময় গৌর বর্ণেই দেবী পূজিত হতেন। মায়ের কালো রূপের পূজা হচ্ছে ২২০ বছর ধরে। দেশভাগের পর, ১৯৩৮ সালে ভট্টাচার্য পরিবার ক্যানিং চলে আসেন। মূলত জমিদারবাড়ির শোভা আর আভিজাত্য প্রদর্শনের জন্য দেবী দুর্গার আরাধনা শুরু হয়।

Durga Puja

ক্যানিংয়ের ভট্টাচার্যবাড়ির কালো দুর্গা

ভট্টাচার্যবাড়ির বর্তমান সদস্যদের থেকে জানা যায় কালো রূপের দুর্গাপুজো করার ইতিহাস। তাঁদের মতে, পুজো শুরুর কয়েক বছর পরেই ঘটে এক ভয়ংকর দুর্ঘটনা। বাড়ির দুর্গামন্দিরের পাশেই ছিল মা মনসার মন্দির। পুরোহিত মনসাপুজো করে দুর্গাপুজো করতে আসেন। তখন দেখা যায়, মনসা মন্দিরের ঘিয়ের প্রদীপের জ্বলন্ত সলতে নিয়ে উড়ে যাচ্ছে একটি কাক। ঠিক সেই সময় তার মুখ থেকে জ্বলন্ত পলতে দুর্গা মন্দিরের শণের চালের ওপর পড়লে দুর্গা মন্দির ও প্রতিমা পুড়ে যায়। এই ঘটনার পর বাড়ির সদস্যরা মনে করেন যে, মা হয়তো আর তাঁদের থেকে পুজো নিতে চাইছেন না। তাই তারা পুজো বন্ধের সিদ্ধান্ত নেন। এমন অবস্থায় এক রাতে বাড়ির গৃহকর্তা রামকান্ত ভট্টাচার্য মা দুর্গার স্বপ্নাদেশ পান যে, মায়ের পুজো যেন কোনওমতে বন্ধ না হয়। তিনি ওই পোড়া রূপেই পূজিত হতে চান। এই স্বপ্নাদেশের পর থেকেই বছরের পর বছর ধরে মায়ের পোড়া মুখ আর ঝলসানো শরীরের মূর্তিতেই হয়ে আসছে ভট্টাচার্যবাড়ির পুজো।

শুধু পোড়া রং নয়, মূর্তিতেও বৈচিত্র্য আছে। এই বাড়িতে মায়ের ডানদিকে নয়, গনেশ থাকে বামদিকে আর সঙ্গে সরস্বতী। আর মায়ের ডানদিকে থাকে লক্ষ্মী আর কার্তিক, এবং কার্তিকের পাশেই থাকেন নবপত্রিকা। আগে এই বাড়ির পুজোয় মোষবলি দেওয়ার রীতি ছিল, এখন আর সেসব হয় না। নিয়ম রক্ষার জন্য চালকুমড়ো বলি দেওয়া হয়। আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো– এই বাড়ির পুজোয় নবমীর দিন চালের গুঁড়ো দিয়ে একটি মানুষের আদলে মূর্তি বানানো হয়, তারপর তাকে বলি দেওয়া হয়। এইভাবে নিজেদের শত্রুদের বলি দেন তাঁরা। এছাড়াও যথারীতি নিয়ম মেনে দশমীতে মায়ের বিসর্জন হয়। বিসর্জনের পর মায়ের প্রতিমা জলের তলায় তিনদিন পুঁতে রাখা হয়, যাতে প্রতিমা গভীর জল থেকে ভেসে না ওঠে। এরপর সেই কাঠামো তোলা হয় লক্ষ্মীপুজোর পরের দিন।

বেলেঘাটা রামকৃষ্ণ নস্কর লেন-নিবাসী ভট্টাচার্য পরিবার
বারোয়ারি পুজোর থেকে বনেদিবাড়ির পুজোয় বেশ কিছু নিয়মের ফারাক আছে। আবার এক এক বাড়ির এক এক রকমের নিয়ম। দেবী দুর্গার বর্ণেও পার্থক্য। কোথাও গৌরবর্ণ, কোথাও শ্বেতবর্ণ, তো কোথাও রক্তবর্ণ। কিন্তু কৃষ্ণবর্ণের দুর্গাপ্রতিমা পুজো হয় বেলেঘাটার ভট্টাচার্যবাড়িতে। ২৯০ বছরের পুরনো এই পুজোর উদ্যোক্তা বাংলার শ্রী হরিদেব ভট্টাচার্য। এই পুজো শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের পাবনা জেলার স্থলবসন্তপুর অঞ্চলে। নাটোরের রানি ভবানীর আমলে প্রথমবার এই পুজোর আয়োজন হয়েছিল। নাটোরের রানি তাকে জমি দান করলে তিনি স্থলবসন্তপুরের জমিদার হয়ে ওঠেন।

উল্লেখ্য, হরিদেব ভট্টাচার্য ছিলেন কালীভক্ত। তাই এই বাড়িতে দুর্গাপুজো শুরুর আগে থেকে কালীপুজো হয়ে আসছিল। কিন্তু তিনি মায়ের স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন, এবং তারপর থেকেই মা দুর্গার পুজো শুরু হয়। তিনি আদেশ দিয়েছিলেন, তার মূর্তি যেন কালো হয়। কিন্তু হরিদেবের মনে প্রশ্ন জেগেছিল, মায়ের এই কৃষ্ণবর্ণ কেন? উত্তর খুঁজতে ভাটপাড়া, কাশীর পণ্ডিতদের সঙ্গে কথা বললেন, কিন্তু কোনওটাই মনঃপূত হলো না। একদিন গঙ্গার পাড়ে বসে আছেন, এমন সময় এক সাধু এসে বসলে হরিদেব সেই সাধুকে তার সব কথা জানান। সেই সাধু বললেন মায়ের পুজো করতে হবে ভদ্রকালীরূপে। এমন রূপেই মা আসতে চাইছেন তাঁর কাছে। সেই সাধু তাকে দিয়েছিলেন তালপত্রে লেখা এক সংক্ষিপ্ত পুঁথি, যা অনুসরণ করেই আজও পুজো হয় দেবীর।

Durga Puja

বেলেঘাটার এই কালো দুর্গার ইতিহাস চমকে দেবে

বর্তমানে ভট্টাচার্য পরিবারের একটি শাখার পুজো করে চলেছেন ৬০ বছরের কৃষ্ণা দেবী। তাঁর কাছ থেকে জানা যায়, ওপার বাংলা থেকে চলে এলেও এখানে এসে পুজো এবং নিয়মনীতিতে কিছুমাত্র ভাটা পড়েনি। বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবার বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সেইভাবে পুজোও পরিবারের মধ্যে ছড়িয়ে গেছে। শাক্তমতে পুজো হয় মায়ের। চালকুমড়ো বলি হয় নবমী ও সন্ধিপুজোতে। সকালে নিরামিষ আর রাতে আমিষ ভোগে আপ্যায়ন করা হয় মাকে। সন্ধিপুজোতে থাকে মাছভাজা, দশমীতে পান্তা ভাত, দই আর কলা। তারপর শুরু হয় মায়ের বিসর্জন পর্ব।

মায়ের গায়ের রঙ কালো হলেও তার চার সন্তানের বর্ণ শ্বেত। মহিষাসুর আবার সবুজ রঙের। ভট্টাচার্যবাড়ির পুজো সম্পন্ন হয় কালিকা-মতে। পুরোহিতের অঙ্গবস্ত্র রক্তিম আর তন্ত্রমতে মায়ের আরাধনা হয়। বাংলাদেশে যে পুজো হরিদেব ভট্টাচার্য শুরু করেছিলেন, আজ তাঁর পরিবার সেই পুজোর রসদই বহন করে চলেছে।

দেউলঘাটার কালো দুর্গা
রূপসী পুরুলিয়ার দেউলঘাটা অঞ্চলে আজও আড়াই হাজার বছরের কালো দুর্গাপুজো হয়। পুরুলিয়ার আনাচকানাচে আছে অজস্র রহস্যের হাতছানি। পুরুলিয়া জেলার আড়শা ব্লকের দেউলঘাটার এক ভগ্নপ্রায় মন্দির, যার পিছনে আছে রহস্যময় ইতিহাস। তবে দেউলঘাটায় মন্দির কারা প্রতিষ্ঠা করেছিল, তা নিয়ে আছে মতভেদ। তবে অনেকের মতে, দেউলঘাটার এই কালো দুর্গা ভারতের সবচেয়ে প্রাচীনতম দুর্গা। পাল আমলের কালো পাথরের দুর্গা। বহু প্রাচীন কালো পাথরের দশভুজা মূর্তি।

মন্দিরের পূজারির কথায়, এই দুর্গা পাল আমলের দুর্গা। বৌদ্ধ মন্দিরের আদলে তৈরি এই দুর্গা মন্দির। মায়ের মূর্তিতেও আছে চমক। মাথার ওপর চক্রস্তম্ভ এবং তলায় পরীদের মূর্তি। মায়ের দু'পাশে অষ্টমাতৃকা রূপ। মন্দিরের গায়ে রয়েছে পাথরের ভাস্কর্য। মন্দিরের দরজা গুলিও ত্রিভুজাকৃতি। একসময় তাম্রলিপ্তের বণিকেরা কংসাবতী নদীর তীরে তাঁদের নৌকো বেঁধে মন্দিরে মায়ের পুজো দিতে আসতেন। মন্দিরের পূজারির কথায়, আগে দেবীর পুজো হতো গাছের নিচে। মন্দির থাকলেও মন্দিরের ভেতর মূর্তি প্রতিষ্ঠিত ছিল না। কিন্তু ঝড়-জলে মূর্তি নষ্ট হয়ে যেতে পারে ভেবে পরবর্তীকালে এই মূর্তি মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়।

Durga Puja

দেউলঘাটার কালো দুর্গা

মন্দিরের পূজারি মিঠুবাবুর কথায়, সাধারণত দুর্গা মূর্তিতে দেবীর পা বামদিকে মহিষের ওপর থাকে কিন্তু এই মূর্তির ক্ষেত্রে তা ভিন্ন। এখানে দেবীর ডান পা মহিষের ওপর রয়েছে। একটা সময় তিনটি মন্দির ছিল। ২০০০ সালে একটি মন্দির ভেঙে যায়। কালো দুর্গার এই মন্দির কোনওক্রমে দাঁড়িয়ে আছে। নিত্যপুজো হয় এখানে। আর দুর্গাপুজোর চারদিন সাধ্যমতো পুজো করা হয়। সাবেকি নিয়মে পূজা হয়। মহালয়ার ভোরে চণ্ডীপাঠের মাধ্যমে শুরু হয় পুজো। তারপর সপ্তমী, অষ্টমী এবং নবমীতে ছাগবলি দেওয়া হয়। ওই চারদিন ভিড় যেন উপচে পড়ে এখানে, স্থানীয় মানুষ ছাড়াও ভিনদেশি পর্যটকের দলও ভিড় জমায় এখানে।

দেউলঘাটার মন্দির আর মূর্তি নিয়ে মতভেদ থাকলেও একথা স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, বাঙালির দুর্গাপুজো কত প্রাচীন।

 

More Articles