প্লেগের মরা দেহ ঘাড়ে তুলে সৎকার করেছিলেন, বাংলা থিয়েটারের এই চরিত্র আজও বিস্ময়
Bengali Theatre and Plague: ক্লাসিক থিয়েটার থেকে লোক ডেকে, নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বৃদ্ধার প্লেগে মারা যাওয়া সন্তানকে সৎকার করিয়েছিলেন অমরেন্দ্র
ভয়াবহ কোভিড মহামারীতে আমরা এবং পৃথিবীর সবাই আতঙ্কিত ছিলাম দুটো বছর। বছর চারেক অতিক্রান্ত হয়েও সেই আতঙ্ক এখনও তাড়া করে বেড়ায়। কোভিডের একাধিক ঢেউয়ের পরপরই বিবিধ রোগের মহামারী হয়ে যাওয়ার আশঙ্কার কথা খবরে আসতে থাকে। ডেঙ্গু নিয়েও ভয়াবহ চিন্তা প্রতিবছরই আতঙ্কে রাখে মানুষকে। কয়েক শতাব্দী আগে মহাকবি উইলিয়াম শেক্সপিয়র এমনই এক মহামারীকালে জন্ম নেন, বিউবনিক প্লেগ। সেই ঐতিহাসিক নিয়তির কথা পৃথিবীর কাছে বিস্ময়। মহামারী যে এই বাংলায় প্রথম হলো এমনটা তো নয়, আমাদের বাংলায় উনিশ শতকে প্লেগের প্রকোপ এসে পড়ে। তার সঙ্গে আবার সম্পৃক্ত হয়ে যায় বাংলা থিয়েটার! বাংলা সংস্কৃতির এক অনন্য নজির সেই ঘটনা।
১৮৯৮ সাল, মার্চ মাস। কলকাতায় দেখা দিল মারাত্মক প্লেগ। সেই রোগ এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ল যে মানুষজন কলকাতা ছেড়ে অন্যান্য জায়গায় পাড়ি জমাতে লাগলেন। সাহিত্য সম্পাদক, সমালোচক সুরেশচন্দ্র সমাজপতি লিখলেন, কলকাতায় ভীষণ মড়ক। যে বাড়িতে প্লেগ হচ্ছে সে বাড়ি উজাড় হয়ে যাচ্ছে। বাপ ছেলেকে, স্বামী বৌকে, ছেলে মা-বাবাকে ছেড়ে পালাচ্ছে। সবাই সবাইকে ভয় পাচ্ছে। প্লেগের মড়া কেউ পোড়াতে চাইছে না। এমনকী আত্মীয় হলেও পোড়াতে যেতে চাইছে না।
এই সময় কলকাতার থিয়েটারের কী অবস্থা? সব কিছুর সঙ্গেই কীভাবে যেন থিয়েটারের একটা যোগ থেকেই যায়, এক অদ্ভুত মানবিক যোগ। মে মাস নাগাদ যখন প্লেগের প্রকোপ খুব বেড়ে গেল তখন স্টার থিয়েটার বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্লেগের ভয়ে গিরিশচন্দ্র ঘোষ কলকাতা ছেড়ে রামপুর-বোয়ালিয়ায় চলে গেলেন। অমরেন্দ্রনাথ দত্ত কিন্তু থিয়েটার চালিয়ে যেতে লাগলেন। শুধু মঞ্চে নয়, এবার জনগণের পাশে, জনগণের জন্য। থিয়েটারে যে 'Act' শব্দটা ব্যবহার করা হয়, তার অর্থ 'to do something', তার বাস্তব রূপায়ণ ঘটল।
আরও পড়ুন- অনুবাদ না করা মানে জানলা বন্ধ ঘরের মধ্যে দমবন্ধ হয়ে মরা
এখন প্রশ্ন হলো, এমন অবস্থায় অমরেন্দ্র থিয়েটার চালালেন কী করে? অমরেন্দ্র জোরকদমে কাজ করে যাচ্ছিলেন। ২৫ ডিসেম্বর, ১৮৯৭ তে 'কাজের খতম', ৮ জানুয়ারি- ১৮৯৮ তে 'পাণ্ডবের অজ্ঞাতবাস', ৮ মার্চ -১৮৯৮ দোলের দিন 'দোললীলা', সঙ্গে আলিবাবা তো আছেই। এতকিছুর পরে ৪ এপ্রিল রবিবার সেই প্রথম থিয়েটারে হীরালাল সেনের সঙ্গে মিলে 'বায়োস্কোপ' দেখানো হলো। তখন তো আর সিনেমা বলা হতো না। বায়োস্কোপ তো আলাদা মাধ্যম, তার শ্যুটিং, অভিনেতা, আরও কত কী কাণ্ড চলে! আআন্দাজ করাই যায়, সেই সময়ে কী পরিমাণ ব্যস্ততা ছিল তাঁর।
এত ব্যস্ততার মাঝেও থিয়েটার, বায়োস্কোপের পাশাপাশি তিনি প্রাণের মায়া ত্যাগ করে প্লেগ রোগীদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন। টাকা দিয়ে সাহায্য করতে লাগলেন, মৃতদেহ সৎকারের ব্যবস্থা করতে লাগলেন। অনেকের প্রতিপালনের ভার নিলেন। সকল মানুষ তাঁকে 'গরিবের মা বাপ' বলে হৃদয়ে গ্রহণ করলেন। তাঁর এইসব কাজ দেখে তখনকার বিখ্যাত কাগজ 'নায়ক'-এ প্রতিবেদন প্রকাশ হয়, অতুলনীয় হৃদয়ের অমরেন্দ্রনাথ অপরাজেয়, বলা ভালো অদ্বিতীয়। তবে এই বাংলাতে তখন তাঁকেও কিছুটা বাঁকা চোখে দেখা শুরু হলো। যতই হোক, রোগ ছোঁয়াছুঁয়ি করা লোক!
নাচ-গান, নতুন নাটক, অন্যদের থেকে বেশি টিকিট কী করে বিক্রি হবে সেসব নিয়ে ভাবলে সমস্যা ছিল না, মানুষের উপকার করতে লেগে পড়াতে অমরেন্দ্রর সমস্যা বাড়ল। জমিদার বাড়ির ছেলে ছিলেন, তবু সেই জমিদারিপনার রোগগ্রস্ত মানসিকতা তাঁর জন্মায়নি। মানুষের প্রতি ভালোবাসা ছিল তাঁর অগাধ।
একদিন থিয়েটার করে বেরিয়ে ফুটপাতে একজনকে দেখলেন শীতে কাঁপছে, শাল খুলে দিয়ে দিলেন। লোকদেখানো দান নয়, অন্তর থেকে দান। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মাইনে-বোনাস বাড়িয়ে দিলেন। দর্শকদের বই উপহার দিতে শুরু করলেন থিয়েটারের প্রসারের উদ্দেশ্যে। ব্যবসা নয়, থিয়েটার ও জনসমাজকে একবিন্দুতে নিয়ে আসার চেষ্টা করলেন অমরেন্দ্র।
আরও পড়ুন- অভিনয় দেখে জুতো ছুঁড়ে মেরেছিলেন বিদ্যাসাগর, বাংলা থিয়েটারের ধ্রুবতারা অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি
সুরেশচন্দ্র সমাজপতি আরও লিখলেন,
"আত্মীয়জন প্লেগ হইলে ভয়ে আত্মীয়ের সেবা করিতেছে না; প্লেগের মড়া হইলে অন্য লোক দূরের কথা আত্মীয় লোকে আত্মীয়ের দাহ করিতেছে না। এইরূপ যখন অবস্থা, সেই সময়ে অমরেন্দ্রনাথ অর্থ সাহায্যও করিয়াছেন, তদ্ব্যতীত নিজের থিয়েটারের অভিনেতাদের লইয়া প্লেগে মরা বহু মড়া ঘাড়ে করিয়া তাহাদের সৎকার করিয়াছেন। অল্পদিন গত হইল যখন দামোদরের ভীষণ বন্যায় বর্দ্ধমান জেলা ডুবিয়া যায়... অমরেন্দ্রনাথ নিজের মোটরে চড়িয়া, চিড়া মুড়কীর বস্তা ও কাপড়ের বস্তা লইয়া বন্যাপীড়িত ব্যক্তিগণকে সাহায্য করিয়াছেন।"
বন্যায় দুর্গতদের অঢেল সাহায্য করেছিলেন অমরেন্দ্র। বন্যায় সাহায্য করেছিলে রাজবালাও। ১৯২০ সালের বন্যায় ইন্দুবালার মা রাজবালার নেতৃত্বে মেয়েদের নাটকের দল নাটক করে, টিকিট বিক্রির টাকা এবং আরও অনেক সাহায্য নিয়ে বন্যাপীড়িত মানুষদের সাহায্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
'নায়ক' কাগজের সম্পাদক পাঁচকড়ি বন্দোপাধ্যায়ও অমরেন্দ্রনাথের এই মহান ভূমিকার পাশাপাশি আরও এক ঘটনার কথাও লিখেছেন। পাঁচকড়িবাবু ও অমরেন্দ্রনাথ টমটম করে বাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন। শীতকাল। ছাতুবাবুর বাজারের কাছে এক বৃদ্ধার কান্নার আওয়াজ শুনে টমটম থামিয়ে অমরেন্দ্র নেমে পড়লেন। বৃদ্ধার ছেলে প্লেগে মারা গেছে। শ্মশানে নিয়ে যাবার কেউ নেই। অমরেন্দ্র ক্লাসিক থিয়েটার থেকে লোক ডেকে, নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সৎকার করিয়ে ভোর সাড়ে চারটেয় বাড়ি ফেরেন।
এমন অবাক-করা মানুষের জন্যই তাই লেখা হয়েছিল স্তুতিকাব্য -
"মহামারী মৃত্যুরোলে নগরী মুখর -
করে'ছ রোগের সেবা, নির্ভীক অন্তর!
পলাইছে নরনারী
মৃতদেহ সারি সারি -
দেখেছি শ্মশান ঘাটে, সৎকারে তৎপর!
শীতার্ত অনাথের হেরি' করুণায় গলে',
অঙ্গবাস মুক্ত করি' তাহারে যে দিলে
তাই তব শয্যা পাশে,
তারাও কেঁদেছে বসে',
'অশ্রুগঙ্গোদকে' তুমি অমরায় গেলে!"
সাধারণ রঙ্গালয়ের সার্ধশতবর্ষের উজ্জ্বল আনন্দময় কালে এমন অন্ধকার সময়ের কথা স্মরণ করার একমাত্র কারণ, সংস্কৃতির প্রকৃত রূপকে চিনতে গেলে তার মূল আলোক বিন্দুগুলোর সামনে দাঁড়াতে হয়। হ্যাঁ, তারা সংখ্যায় নগণ্য কিন্তু চারপাশে জ্বালিয়ে রাখে অসীম উজ্জ্বল মানবিক আলোকপ্রদীপ।