বাংলায় অবহেলিত পড়ে থাকে দেবী চৌধুরাণীর মন্দির, উপন্যাস যেখানে বাস্তবে নেমে আসে

Devi Chaudhurani Temple: মন্দিরের দায়িত্বে রয়েছেন বছর পঞ্চাশের এক মুসলিম মহিলা, মমতাজ মহম্মদ। বছর পঞ্চাশের মমতাজ খেপি মায়ের পুজো করেন দেবী চৌধুরাণীর মন্দিরে।

বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে দেবী চৌধুরাণী কাল্পনিক এক চরিত্র। লেখক নিজেই উপন্যাসটিকে ইতিহাস বলতে চাননি। কিন্তু চরিত্রটি অত্যন্ত আন্তরিক এবং তার পটভূমি সত্য ইতিহাস নির্ভর। কাজেই চরিত্রটি হাতছাড়া করতে চায়নি বাঙালি। খোঁজ চালিয়ে গিয়েছেন অনেকেই। ঠিক কোন আদলে চরিত্রটির নির্মাণ? ভবানী পাঠক মজনু শাহের বিদ্রোহের ছোঁয়া গঙ্গা পেরিয়ে নদিয়া মায় দুর্গাপুর পর্যন্ত পৌঁছল কী করে? কেন পশ্চিমবঙ্গের মোট তিনটে কোণে বাস্তব দেবী চৌধুরাণীর মন্দিরের খোঁজ পাওয়া যায়? দেবী সিংহ চরিত্রটি কি বাস্তব? এইখানে দেবী চৌধুরাণীর নেপথ্যে বাস্তবের ছাপ থাকার একটা সম্ভাবনার উপর আলো পড়ে। সরু একফালি আলো। কিন্তু ঐতিহাসিকেরা আরও উৎসাহী হয়ে ওঠেন।

পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপুর, নদিয়া এবং জলপাইগুড়ি— এই তিন স্থানে দেবী চৌধুরাণীর মন্দির রয়েছে। এই তথ্য থেকেই বাঙালি জীবনে উপন্যাসটির প্রভাব খানিক আঁচ করা সম্ভব। এদের মধ্যে জলপাইগুড়ির দাবিই সবথেকে বেশি। তিন তিনখানা মন্দির রয়েছে এই জলপাইগুড়িতেই।

জলপাইগুড়ি শহর ছাড়িয়ে গোশালা মোড় হয়ে বড় রাস্তায় উঠলে ঠিক ডান হাতে একটা মন্দির পড়ে। আগে হয়তো নির্জন ছিল, এখন বাইপাস গায়ের উপর এসে ওঠায় সে নির্জনতা বা গা ছমছমে ব্যাপার আর নেই। রাস্তার গা ঘেঁষে মন্দিরের পাঁচিল। ভিতরটা একটু অন্ধকার। ইতিউতি গাছের গোড়ায় কিছু গোল করে বাঁধানো বেদী। একেবারে মাঝখানে মন্দিরের মূল দেউল। এ মন্দিরের ইতিহাস বড়ই প্রাচীন। রহস্যময় এই মন্দিরকে ঘিরে গড়ে উঠেছে কত কাহিনি। শোনা যায়, এককালে নাকি নরবলিও হত এই মন্দিরে। লোকের মুখে মুখে এই মন্দির দেবী চৌধুরাণীর মন্দির। জড়িয়ে গিয়েছে সেই ডাকাতের গল্প, ব্রিটিশের সঙ্গে লড়াই, অ্যাডভেঞ্চার—রোমহর্ষক সব ইতিহাস। ২৭৬ বছর পুরনো মন্দির নাকি এটি। শ্মশানকালীর এই মন্দিরটিতে কালীপুজোও হয় বেশ জমজমাট। পুজোর দিন মহাশোল মাছ ও বোয়াল মাছের ভোগ চড়ে। সুরা দিয়ে স্নান করেন কালীবিগ্রহ। তাঁর এক হাতে সুরার পাত্র অন্যহাতে কাটা মুণ্ডু। কীভাবে এই মন্দিরের সঙ্গে দেবী চৌধুরাণীর নাম জড়ালো তা অবশ্য জানা যায় না। কিন্তু ভৌগোলিক ভাবে এই অঞ্চলই ছিল তাঁর বিদ্রোহের ক্ষেত্র। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।

আরও পড়ুন- নজরুল এখানে বসে লিখেছেন কালীগান! লালগোলার শিকলে বাঁধা কালী আজও রহস্যে মোড়া

এপার বাংলায় দেবী চৌধুরাণীর মন্দির এই একটি মাত্র নয়। আরও রয়েছে। এটি ছাড়াও শিকারপুর চা-বাগানে আছে একখান ভবানী পাঠকের মন্দির। বেলাকোবা-রাধামালি রোডে রয়েছে মন্থনী মন্দির। আর এই সবক’টির সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে দেবী চৌধুরাণীর নাম।

মন্থনী মন্দিরের ‘মন্থনী’ বাংলাদেশের মন্থনা থেকে এসেছে বলে মনে করেন অনেকে। এই মন্থনা তথা পীরগাছার জমিদার ছিলেন শিবচন্দ্র। তাঁর পত্নীর নাম জয়দুর্গা। ইতিহাসে সরাসরি দেবী চৌধুরাণীকে নিয়ে বলা নেই কিছুই। তবে লেফটেন্যান্ট ব্রেনানের রিপোর্ট, ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টারের স্ট্যাটিস্টিক্যাল অ্যাকাউন্টস অব বেঙ্গল-রংপুর-ইত্যাদিতে পাওয়া যায় শিবচন্দ্র, জয়দুর্গা এবং ভবানী পাঠকের নাম। এবং মজার ব্যাপার এই অঞ্চলে কিছুদিন কাটিয়ে যাওয়ার পরেই বঙ্কিম উপন্যাসটি লেখেন। ভবানী পাঠকের সঙ্গে শিবচন্দ্রের যে যোগাযোগ ছিল তা রিপোর্টে পাওয়া গিয়েছে। সেই সময় রংপুর অঞ্চলের কালেক্টর হয়ে এসেছিলেন জোনাথন গুডল্যান্ড। সেই সঙ্গে দেওয়ান হিসেবে নিযুক্ত হন দেবী সিংহ। এই দুইজনের অত্যাচারে চাষিরা তো বটেই, জমিদারেরাও অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। শিবচন্দ্র মারা যাওয়ার পর জয়দুর্গা জমিদারির দায়িত্ব সামলান একা হাতে। বিশাল বরকন্দাজ বাহিনী ছিল তাঁর। ফকির মজনু শাহ, ভবানী পাঠক, জয়দুর্গা ও নুরুল দীন একজোট হয়ে বিদ্রোহ করেন কালেক্টর আর দেওয়ানের অত্যাচারের বিরুদ্ধে। চাষিরাও এই বিদ্রোহে যোগ দিলে সমস্ত উত্তরবঙ্গে এই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। ১৭৮৭ সালে গোবিন্দগঞ্জের যুদ্ধে ভবানী পাঠক মারা যান। রংপুরের তিস্তা অববাহিকা এবং জলপাইগুড়ির করলা অববাহিকা জুড়ে ছিল দেবী জয়দুর্গা চৌধুরাণীর কর্মকাণ্ড। এঁকেই যে স্থানীয় মানুষ দেবী চৌধুরাণী বলতেন, তা নিয়ে তেমন সন্দেহের কারণ থাকে না।

রায়গঞ্জ ব্লকের শিকারপুরে পাশাপাশি রয়েছে দেবী চৌধুরাণী আর ভবানী পাঠকের মন্দির দু’টি। চা বাগানের মধ্যে থাকা এই মন্দিরটির দেখভাল করেন ভোলা ওঁরাও। রয়েছেন কমল রায় নামে একজন পুরোহিতও। বহুদিন থেকেই জলপাইগুড়ির ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেছেন উমেশ শর্মা। তাঁর মতে, দর্পদেব রায়কত যখন জলপাইগুড়ির জমিদার সেসময় জলপাইগুড়ি রংপুর জেলার অধীনেই ছিল। জয়দুর্গার সঙ্গে দর্পদেবের পরিচয়ও ছিল। ইংরেজদের বিরুদ্ধে একসঙ্গেই লড়েছিলেন তাঁরা। ১৭৭৩ সালে ইংরেজদের সঙ্গে দর্পদেবের তিস্তাপক্ষের যুদ্ধ হয়। এরপর দীর্ঘ আঠেরো বছর তাঁকে বন্দি করে রাখে ইংরেজ। অনেকে মনে করেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সময় ভবানী পাঠক আর জয়দুর্গা ঘাঁটি তৈরি করেন এই শিকারপুর চা বাগানের জঙ্গলেই। সে সময় দর্পদেব এই মন্দির তৈরির কথা ভাবেন।

আরও পড়ুন-কেউ মদ‍্যপান করে উন্মত্ত, কেউ গৃহস্থের সামনে অপ্রকাশ্য! কালীতন্ত্রে কালীর নানা রূপ

হাতে কলমে অবশ্য এই মন্দির গড়ে তুলেছিলেন রেমন্ড হেলাইচ নামে এক সাহেব। ১৮৭১ সালে যোগেন্দ্রদেব রায়কত এই মন্দির সংস্কার করেছিলেন। শুরুতে এই প্যাগোডা ধাঁচের মন্দিরে বিগ্রহ ছিল কাঠের। দুই পাশে দু’টি কালী মূর্তি। সেই কালীমূর্তির পুজো সেরেই অভিযানে বেরোতেন ভবানী পাঠক। সেই বিগ্রহ আগুনে পুড়ে যাওয়ায় পরে মাটির মূর্তি তৈরি হয়। মন্দিরের পুরোহিত কমল রায় বলেন, এই মন্দিরে কালী মূর্তি ছাড়াও রয়েছে তিস্তাবুড়ি, ভবানী পাঠক, দেবী চৌধুরাণী, গঙ্গাদেবী এবং সিদ্ধপুরুষ মোহনলালের মূর্তি। মন্দির খোলে রোজ ভোর পাঁচটায়, বন্ধ হয় বিকেল পাঁচটায়। সন্ধের পর এদিকে আসতে আর সাহস করেন না কেউ। আষাঢ় ও কার্তিকের অমাবস্যায় কালীপুজো হয় এই মন্দিরে। ২০১৮ নাগাদ মন্দির আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। আবার নতুন করে তাকে গড়ে তোলা হয়েছে।

গোশালা মোড়ের দেবী চৌধুরাণীর মন্দিরটা বিখ্যাত অন্য কারণে। এ মন্দিরে নরবলি হত। শোনা যায় ১৮৯০ সালে নরবলির অভিযোগে ফাঁসি হয় মন্দিরের কাপালিক নয়নের। তারপর থেকে অবশ্য বলিপ্রথা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ২৭ নম্বর জাতীয় সড়ক গড়ে ওঠার সময় মন্দিরের খানিকটা জমি নেয় প্রশাসন। ক্ষতিপূরণের প্রসঙ্গ উঠলে জানা যায় কোনও দলিল বা প্রামাণ্য নথি মন্দির কমিটির হাতে নেই। অর্থাৎ মন্দিরটা যে দেবী চৌধুরাণির সঙ্গে সরাসরি জড়িত এমন প্রমাণও নেই। তবে আছে সম্প্রীতির এক অদ্ভুত নিদর্শন। এই মন্দিরের দায়িত্বে রয়েছেন বছর পঞ্চাশের এক মুসলিম মহিলা, মমতাজ মহম্মদ। বছর পঞ্চাশের মমতাজ খেপি মায়ের পুজো করেন দেবী চৌধুরাণীর মন্দিরে। পঞ্চমুণ্ডির আসনে পুজো পান আউশ গ্রামের খেপি মা। সেই পুজোর সব দায়িত্বই মমতাজের উপর। তবে মমতাজই প্রথম নন। এর আগেও মন্দিরে মুসলমান উপাসক ছিলেন। মন্দিরের প্রধান পুরোহিত সুভাষ চৌধুরী জানান, মন্দিরের প্রথা অনুযায়ীই পুজো হয়। এর আগেও একজন মুসলমান ব্যক্তির কাঁধে এই দায়িত্ব ছিল। তাঁর পর মমতাজই সেই ভার নিয়েছেন। পুজোর ফুল-বেলপাতা আনা থেকে ঠাকুরের বাসন মাজা– সমস্তই তিনি করেন। এই বিরল সম্প্রীতির নিদর্শনের কারণেই দেবী চৌধুরাণীর এই মন্দিরটি বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে।

More Articles