হজরত মহম্মদের দাড়ি রাখা আছে ভারতের এই মসজিদের গর্ভেই?

Hazratbal Mosque Kashmir: এই মসজিদ থেকে ধ্বংসাবশেষের নিদর্শন ১৯৬৩ সালে নিখোঁজ হয়। যা নিয়ে রাজ্য পেরিয়ে গোটা দেশ সেই সময় তোলপাড় হয়ে যায়।

কাশ্মীর। ইনোভার মিউজিক সিস্টেম থেকে ভেসে আসে 'রিন্দ পোষ মাল গিন্দানে'র মনউদাসী সুর। কখনও বা বৃদ্ধ মৌলবী সাহেবের গুরুগম্ভীর কণ্ঠে উচ্চারিত হয় আমির খসরু সাহেবের 'ফির্দৌস বুর্রে জমিনস্ত'। প্রকৃতির শহর, সংস্কৃতির শহর, কবিতার শহর, প্রেমের শহর ভূস্বর্গ। মনে করা হয়, 'কাশ্মীর' শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃত শব্দ 'কাশমীরা' অথবা 'কাশামীরা' থেকে। পুরাণ মতে, ঋষি কাশ্যপের বাসভূমি ছিল এই শ্বেতশুভ্র ভূস্বর্গ। সেখানে অবস্থিত কাশ্যপ-মীর অর্থাৎ কাশ্যপের হ্রদ অথবা কাশ্যপ-মেরু অর্থাৎ কাশ্যপ পর্বত থেকে এহেন উপত্যকানগরীর উৎপত্তি। লোককথা অনুসারে প্রচলিত, কাশ্মীর জলের থেকে শুষ্কভূমি। এছাড়াও বহু বিদেশি লোকগাথাতেও প্রচলিত আছে ভূস্বর্গের ইতিহাস। প্রাচীন গ্রিকরা এই অঞ্চলে বসবাসকালে হিমালয়ের কোলে এই উপত্যকাকে 'কাস্পেরিয়া' নামে অভিহিত করেন, যা রোমানিয়ান ভাষায় উচ্চারণ করলে দাঁড়ায় 'ক্যাশ-মীর'।

পরবর্তীতে চিনা পরিব্রাজক ও বৌদ্ধপণ্ডিত হিউয়েন সাং ভারত ভ্রমণে আসেন। তাঁর গ্রন্থে এই স্থানটিকে 'কিয়া-শি-মিলো' নামেও ব্যাখ্যা করেছেন। বহু ভাষাভাষী, সংস্কৃতি ও ধর্মের মিলনস্থল এই সুজলা-সুফলা দেশের উত্তরে অবস্থিত ভূস্বর্গ। রয়েছে বরফ ঢাকা চন্দনওয়াড়ি, যেখান থেকে তীর্থক্ষেত্র কেদার-বদ্রীর যাত্রা শুরু হয়। পাশেই জম্মু, যেখানে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৫২০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত বিখ্যাত তীর্থক্ষেত্র বৈষ্ণোদেবী মন্দির। উত্তর-পূর্বে রয়েছে মূলত বৌদ্ধ সম্প্রদায় অধ্যুষিত অঞ্চল লাদাখ ও পশ্চিমে পঞ্জাব।

আরও পড়ুন- কাশ্মীর থেকে রাশিয়া অবধি সুড়ঙ্গ! যে সাতটি গুহার রহস্যভেদ হয়নি আজও…

শ্রীনগর শহরটা মূলত গড়ে উঠেছে ডাল লেককে কেন্দ্র করে। বাঁয়ে ডাল লেককে সঙ্গী করে পথ চললে এখনও দৃষ্টিগোচর হয় মুঘল সাম্রাজ্যর কিছু অসাধারণ নিদর্শন। মুঘলবাগগুলি এখনও জাহাঙ্গীর ও রাজরক্তের অপার্থিব সৌন্দর্যপ্রীতির সাক্ষ্য বহন করে। উপর থেকে নেমে আসা ঝর্না বেয়ে সেই প্রাচীনকাল থেকে বয়ে চলেছে ৪০০ বছরের ভারত ও তার সমৃদ্ধ ইতিহাস। বাগের উপরমহলের বৃষ্টিস্নাত ছাদে দাঁড়িয়ে যতদূর চোখ যায়, হ্রদ হিমালয়ের পাদদেশ ছুঁয়েছে। রঙিন শিকারায় ভেসে চলা যৌবন ও প্রেমালাপের নান্দনিক দৃশ্যায়ন ভুলিয়ে দেয় ভূস্বর্গকে ঘিরে থাকা বুলেট রাজনীতি। এখনও সাম্প্রদায়িক নেতাদের নেক নজর থেকে বঞ্চিত নিশাত্ বাগ, শালিমার বাগ কিংবা পরিমহলের ভাস্কর্য। কিছু জায়গায় চলছে রক্ষণাবেক্ষণ পর্ব। আশঙ্কা হয়, নতুন প্রজন্ম এগুলো কী নামে প্রত্যক্ষ করবে? ইতিহাস মুছে ফেলার রাজনৈতিক আঁচ ধীরে ধীরে গ্রাস করছে শিক্ষাক্ষেত্র ও শৈশবকে। বাতাসে মিশছে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প।

স্মৃতিচারণরত ভারাক্রান্ত মনে আরও কিছুটা এগোলে, কাশ্মীরের সবচেয়ে বিখ্যাত মসজিদগুলির মধ্যে একটির সন্ধান মেলে। যার সামনে দাঁড়ালে মন ভালো হতে বাধ্য। সামনের উঠোনে সশব্দে ডানা ঝাপটে উড়ে আসে একঝাঁক পারাবতকূল। এক কাশ্মীরি মহিলা ক্রমাগত দানা ছড়িয়ে তাদের ভোজন অভিযান অব্যাহত রাখেন। তারপর চৌকাঠ পেরিয়ে মসজিদে প্রবেশ। মনে করা হয়, ডাল লেকের উত্তরতীরে এই মসজিদের গহিনে নাকি আজও শায়িত আছে হজরত মহম্মদের দাড়ির অংশবিশেষ। বৃষ্টিস্নাত বিকেলে হজরতবাল মসজিদ থেকে ভেসে আসে আজানের ধ্বনি। হ্রদ পেরনো হিমশীতল শনশন হাওয়া পুলওভার ভেদ করে কাঁপিয়ে দেয় শরীর। প্রার্থনাকক্ষের এককোণে তাকালে দেখা যায়, প্রার্থনা করছেন এক পিতা আর তাঁর ছোট্ট সন্তান। পিতাকে অনুসরণ করার তীব্র প্রচেষ্টাকে উপেক্ষা করেই মাঝেমাঝে নিস্তব্ধতা ভেঙে দিচ্ছে শৈশব। চোখে চোখ পড়লে যার হাসি চওড়া হয়। এক বৃদ্ধ মৌলবী প্রার্থনা শেষে সবার হাতে খেজুর দিয়ে গেলেন। তাঁর বক্তব্য অনুসারে, এই মসজিদ ১৭০০ শতকের গোড়ার দিকে শাহজাহানের নির্দেশে পুননির্মিত হয়। যে কাঠামোটি বর্তমানে দেখা যায় তার ভিত্তি সেযুগেই স্থাপিত।

আরও পড়ুন- ‘হাউজফুল’ কাশ্মীর! ৩২ বছরে কী কী ঘটল কাশ্মীরের সিনেমাহলে?

এই মসজিদ থেকে ধ্বংসাবশেষের নিদর্শন ১৯৬৩ সালে নিখোঁজ হয়। যা নিয়ে রাজ্য পেরিয়ে গোটা দেশ সেই সময় তোলপাড় হয়ে যায়। দেশে কিছু জায়গায় বিছিন্নভাবে সাম্প্রদায়িক হিংসার পরিস্থিতিও তৈরি হয়। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর নির্দেশে তদন্ত কমিশন গঠন হয়। সিবিআই তদন্তের পরে সেই ধ্বংসাবশেষ পুনরুদ্ধার হয়। স্বাভাবিকভাবেই পরবর্তী নির্বাচনী প্রচারে এ নিয়ে রাজনৈতিক হাওয়া সরকারের পক্ষেই থাকে। পরবর্তীতে অনেকে অনুমান করেন, রাজনৈতিক স্বার্থে এটি 'চুরি করানো' হয়েছিল। যদিও ক্ষমতাসীন শাসক দল ও রাজনীতিবিদরা এই অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেন। এই ঘটনার পরে পুনরুদ্ধারের কৃতিত্ব নিয়ে সরকার ক্ষমতায় আসে। ধর্মের সুড়সুড়ি ও বিভাজন তো আসলে বহুকাল যাবৎই শাসকের নির্বাচনী অস্ত্র। বিভিন্ন সময়ে শাসকের পরিচয় ও সিংহাসন পরিবর্তিত হয়। শাসকের রূপ একই থাকে। থাকে চিরপরিচিত শাণিত অস্ত্রের ব্যবহার। গণতান্ত্রিক দেশে জনগণ 'জনস্বার্থে' নতুন শাসকের হাতে হাতিয়ার তুলে দেন। শাসক যন্তরমন্তর ঘরে ঢুকিয়ে ভুলিয়ে দেয় ভাস্কর্য, ইতিহাস, শিল্পকার্য, প্রেমের নিদর্শন। জনগণের স্মৃতি নিতান্তই দুর্বল, সে বিষয়ে শাসক অবগত। তারা জানে দাঙ্গাকারীর চেহারা স্মৃতিতে ক্ষণস্থায়ী প্রভাব ফেললেও, দাঙ্গার ক্ষতর তীব্রতা বড়ই যন্ত্রণাদায়ক। ইতিহাস প্ররোচনামূলক উক্তি বিস্মৃত হয়, মনে রেখে দেয় প্রাণহানির সংখ্যা। মুখোশের আড়ালে থেকে যায় দেশের প্রকৃত 'গদ্দার'রা, স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে থাকে বুক পেতে গুলি খাওয়া হতভাগ্যর আপনজন।

আবারও মৌলবী সাহেবের সঙ্গ নিলে প্রত্যক্ষ করা যায় দেওয়ালে উল্লিখিত সন-তারিখ ও ঐতিহাসিক ইতিবৃত্ত। গোটা ভারতবর্ষ দক্ষিণি সিনেমাকে আপন করে নিলেও, কাশ্মীরে এখনও বলিউডি রাজত্বই কায়েম। কিছুদিন আগে মুক্তিপ্রাপ্ত পাঠান নাকি ভালোই ব্যবসা করেছে ভূস্বর্গে। বেতাবভ্যালিতে আজও লোকমুখে ঘোরে সানি দেওলের শুটিং প্রসঙ্গ। গাড়ির সারথি গর্ব করে দেখিয়ে দেয় বজরঙ্গি ভাইজানের শুটিং স্পট। মৌলবী সাহেবও উল্লেখ করেন ফানাহ্, হায়দার, মিশন কাশ্মীরসহ বহু বিখ্যাত সিনেমাতেই হজরতবাল মসজিদের কথা উল্লেখ আছে।

কাশ্মীরের অলিতে গলিতে কান পাতলে শোনা যায় এমনই বহু ঐতিহ্যশালী আখ্যান। আমরা বিস্মৃত হই, ১৪০ কোটি সহনাগরিক, ভুলে যাই 'অহরহ তব আহ্বানও প্রচারিত' বাণী। ভুলে যাই দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। প্রকট হয় হিংসা, পাশাপাশি থেকেও বাড়তে থাকে দূরত্ব। পাল্লা দিয়ে বাড়ে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ। রাজনৈতিক দলদাসেরা হিংস্র শ্বাপদের মত বাঁকা হাসি হাসে। ধুলো উড়িয়ে চলে যায় সাঁজোয়া গাড়ির ঝাঁক, উড়ে যায় পায়রার দল। বৃষ্টিস্নাত দিনে জমে থাকা কাদায় বাড়তে থাকে ভারীবুটের ছাপ। হঠাৎই এক শিশু টিউলিপ হাতে হাসিমুখে সামনে দাঁড়ায়। বৃষ্টিভেজা উঠোনে ছড়িয়ে দেয় দানা। স্বচকিতে দেখি, উপরের তারে আবারও সদলবলে ভিড় জমাচ্ছে পারাবতকূল। বাষ্প জমে চশমার কাঁচে। দৃষ্টি ঈষৎ ঝাপসা। সন্ধ্যা নামছে। রাতে ঠান্ডা বাড়ে। অপেক্ষা বাড়ে নতুন ভোরের। মোবাইলে আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানান দেয় আগামীর ভোর রৌদ্রজ্জ্বল হবে, দেখা দেবে মেঘমুক্ত পরিষ্কার নীল আকাশ। সোনালি রোদ আলতো করে ছুঁয়ে যাবে সাদা বরফের রাশি। ভূস্বর্গের নিজস্ব ভোর হবে কবে? কোনও পূর্বাভাসেই এই সদুত্তর মেলে না কেবল।

 

চিত্র সৌজন্যে- লেখক

More Articles