ফুটবলার না হোর্ডিং! জুতোর ফিতে বাঁধার নামে আসলে ব্র্যান্ড দেখাতেই চান খেলোয়াড়রা?
Football Advertisement: টিভিতে ফুটবলারদের খুব কাছ থেকে দেখানো শুরু হওয়ার পর, তাদের মাথা থেকে পা পর্যন্ত সবটাই বিজ্ঞাপনের হোর্ডিংয়ের কাজ করতে লাগল।
জ়ারার গোল
১৯৫০-এর বিশ্বকাপে হিস্পানিরা ইংরেজদের একেবারে টুঁটি চেপে ধরেছিল। সাহেবরা খেলাটা ধরতেই পারেনি, কেবল দূর থেকে গোলের দিকে কয়েকটা শট নিয়েছিল।
উইংয়ে খেলত গায়িনজ়া। মাঠের বাঁ দিকটা সে একেবারে গিলে ফেলেছিল। সেদিন ইংল্যান্ডের রক্ষণভাগের অর্ধেক খেলোয়াড়কে ধরাশায়ী করে সে গোলের সামনে চমৎকার একটা লব করল। সাহেবদের ফুলব্যাক র্যামসে তখন বলের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। সে অবিশ্যি কোনওরকমে ঘুরে বলটা ছোঁয়, কিন্তু তক্ষুনি জ়ারা এসে প্রায় তার পা মাড়িয়ে বল ছিনিয়ে নিয়ে বাঁ দিকের পোস্ট ঘেঁষে গোল করে।
তেলমো জ়ারা ঘরোয়া চ্যাম্পিয়নশিপে ছ'বার সবচেয়ে বেশি গোল করেছিল। মনঃসংযোগের ব্যাপারে হিস্পানি মাতাদোর মানোলেতের সাক্ষাৎ শিষ্য খেলত তিন পায়ে ভর করে। তৃতীয় পা-টি ছিল তার মারাত্মক হেড। খেলার মাঠে কিংবদন্তিতুল্য গোলগুলো সে হেডেই করেছে। ১৯৫০-এর বিশ্বকাপে জ়ারার ম্যাচ জেতানো গোলে অবিশ্যি তার মাথার কোনও ভূমিকা ছিল না, যদিও গোলের উল্লাসে যথেষ্ট মাথা ঝাঁকিয়েছিল। শুধু তাই নয়, কুমারী মাতা মেরির যে লকেটটা সে গলায় ঝোলাত, দু'হাতে দুমড়েমুচড়ে সেটা একেবারে শেষ করে ফেলেছিল।
সেবারের হিস্পানি দলের সর্বময় কর্তা আরমান্দো মুনোস কালেরো এককালে নাৎসিদের দলে ভিড়ে রাশিয়া আক্রমণ করতে গিয়েছিল। সে খেনেরালিসমো ফ্রাঙ্কোকে রেডিও-বার্তায় জানাল, "মহামহিম : অ্যালবিয়ন দ্বীপের বিশ্বাসঘাতক ইংরেজগুলোকে মেরে শেষ করে দিয়েছি"। এভাবেই ইংলিশ চ্যানেলে ১৫৮৮ সালে দুর্ধর্ষ হিস্পানি আর্মাডার ভরাডুবির প্রতিশোধ নেওয়া হল।
মুনোস কালেরো এই জয় উৎসর্গ করে ‘ইতিহাসের সেরা সমরাধিনায়ক’কে। পরের ম্যাচটা অবিশ্যি কাউকে উৎসর্গ করতে পারেনি। সে ম্যাচে তারা ব্রাজিলের কাছে গুনেগুনে ছ'টা গোল খায়।
আরও পড়ুন- “জয় অথবা মৃত্যু”! বিশ্বকাপ ফাইনালের আগে ফুটবলারদের টেলিগ্রাম করলেন মুসোলিনি
জ়িজ়িনোর গোল
আবার ১৯৫০-এর বিশ্বকাপের কথা বলছি। য়ুগোশ্লাভিয়ার বিরুদ্ধে খেলতে নেমে ব্রাজ়িলের মিডফিল্ডার জ়িজ়িনো জোড়া গোল করে।
ফুটবলের দেবতার বরে নিঁখুত গোল করার পর হঠাৎ বোঝা গেল রেফারি অন্যায়ভাবে সে গোল বাতিল করে দিয়েছে। ফলে জ়িজ়িনো একইভাবে আরেকবার গোল করল। একই জায়গা দিয়ে পেনাল্টি বক্সে ঢুকে এল, য়ুগোশ্লাভিয়ার রক্ষণভাগের একই খেলোয়াড়কে কাটিয়ে, সেই আগেরবারের মতোই সূক্ষ্মতায় বাঁ দিক দিয়ে হড়কে ঢুকে বলটাকে দাবড়ে টেনে নিয়ে গিয়ে গোলে পাঠাল। তারপর রাগের চোটে গোলের মধ্যে ঢুকে বারবার পা চালিয়ে বলটাকে নেটে জড়াতে লাগল।
রেফারি বুঝে গিয়েছিল যে জ়িজ়িনো আরও অন্তত দশ বার ওই একইভাবে গোল করে দেখাতে পারে। সুতরাং বাধ্য হয়েই দ্বিতীয়বারের গোলটাকে বৈধতা দিল।
মজারু
’৫০-এর বিশ্বকাপে উরুগুয়ের খেলোয়াড় খুলিয়ো পেরেসকে খেলতে দেখে ছেলেবেলায় আমি রীতিমতো চেগে উঠতাম। সবাই ওকে ‘পাতালোকা’ মানে পাগলা-পায়ের ফুটবলার বলত। আর বলবে নাই বা কেন? সে দিব্যি হাওয়ায় যেকোনও দিকে ভেসে যেতে পারত, কিন্তু তার পা যেত সম্পূর্ণ অন্য দিকে। উড়ন্ত পেরেসকে দেখে চোখ রগড়ানো ছাড়া প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের আর গতি থাকত না। পুরো ব্যাপারটা কেমন জানি অবিশ্বাস্য লাগত। শরীর যাচ্ছে একদিকে অথচ পা ঠিক তার উলটো দিকে! এমন শারীরিক টিটকিরিতে বেশ কয়েকজনকে ঘোল খাওয়ানোর পর সে আবার নীচে নেমে এসে বলের পিছু নিত। ফের একই ভঙ্গিতে আক্রমণ শানাত। আমরা গ্যালারিতে বসে অমন মজারু খেলোয়াড়ের জন্য গলা ফাটাতাম। ওর খেলা দেখে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যেত। প্রকাশ্যে আর যা যা করা যায় না, সবই হয়ে যেত।
অনেককাল বাদে ব্রাজ়িলের গ্যারিঞ্চাকে মাঠে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। গ্যারিঞ্চাও পা দিয়ে মস্করা করতে পারত। এমনও হয়েছে, হয়তো ক্লাইম্যাক্সের চুড়ো থেকে ফের বল নিয়ে পিছিয়ে গেল। অবাক হচ্ছেন তো? আরে, খেলার সুখটাকে আরেকটু লম্বা করা আর কী!
আরও পড়ুন- “যে পেনাল্টিটা আটকালাম, ইতিহাসে খোদাই করা থাকবে”, চিঠিতে লিখেছিলেন কোচ চে গেভারা
১৯৫৪-র বিশ্বকাপ
জেলসোমিনা আর জ়াম্পানো তখন সবে ফেলিনির জাদু-আঙুলের ফাঁক দিয়ে মাথা বের করে ‘লা স্ত্রাদা’-য় দেদার ছুটির মজা লুটছে, ফাঙ্গিয়ো অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে দ্বিতীয়বারের জন্য কার-রেসিংয়ে দুনিয়ার সেরা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করছে। জোনাস সাল্ক পোলিওর টিকা আবিষ্কার করছেন। প্রশান্ত মহাসাগরের এক দ্বীপে ইতিহাসে প্রথমবার হাইড্রোজেন বোমা ফাটানো হচ্ছে। ভিয়েতনামে দিয়েন বিয়েন ফু-র নির্ণায়ক যুদ্ধে জেনারেল জিয়াপ ফরাসি সেনাবাহিনীর গালে বিরাশি সিক্কার চড় কষিয়ে দিয়েছেন। আলজিরিয়া ছিল সেসময় ফ্রান্সের আরেকটি উপনিবেশ, সেখানেও স্বাধীনতার লড়াইয়ের সলতে পাকানোর কাজ শুরু হয়ে গেছে।
পার্যাগুয়েতে জেনারেল স্ত্রোয়েস্নার রাষ্ট্রপতি হয়ে বসল, নির্বাচনে সে নিজেই নিজের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। ব্রাজ়িলে বানিয়া, পেতল, টাকা আর বন্দুকের ফাঁস রাষ্ট্রপতি জ়েতুল্যু ভার্গাসের গলায় এমনভাবে এঁটে বসল যে কিছুদিনের মধ্যেই তীব্র বুলেটে তার হৃৎপিণ্ড ছ্যাঁদা হয়ে গেল। অর্গানাইজ়েশন অব আমেরিকান স্টেটসের বরাভয়ে মার্কিন বিমানবাহিনী গুয়াতেমালায় তুমুল বোমাবর্ষণ করে চলল। একই সঙ্গে উত্তুরে হানাদার বাহিনী গুয়াতেমালায় ঢুকে পড়ে গণহত্যা চালিয়ে গেল। অন্যদিকে সুইজ়ারল্যান্ডে ষোলোটা দেশের জাতীয় সুর বাজিয়ে পঞ্চম বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সমাধা হল। গুয়াতেমালায় বিজয়ী সেনাবাহিনী মার্কিনিদের জাতীয় সুর ভাঁজতে ভাঁজতে রাষ্ট্রপতি আরবেঞ্জের পতন উদযাপন করল। আরবেঞ্জের নিজ্জস মার্কসবাদী-লেনিনবাদী মতাদর্শ ধরা পড়ে গিয়েছিল ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানির জমিতে হাত দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই।
সেবার ইওরোপের এগারোটা দল আর আমেরিকার তিনটে দেশের সঙ্গে পোঁ ধরতে হাজির হয়েছিল তুরস্ক আর দক্ষিণ কোরিয়া। ব্রাজ়িল শেষ বিশ্বকাপে মারাকানার হার মানতে না পেরে এবারে নিজেদের এতকালের সাদা পোশাককে অমঙ্গুলে বলে বাতিল করে সবুজ কলার লাগানো হলুদ জার্সি পরতে শুরু করে। কিন্তু ক্যানারি পাখির গায়ের রঙে রং মেলানো জার্সি প্রথম দিকে খুব একটা কাজে আসেনি; হাঙ্গেরির সঙ্গে একটা টানটান ম্যাচে ওরা হেরে যায়, সেমিফাইনাল তো দূর অস্ত। ব্রাজ়িলের কর্মকর্তারা খেলায় পর্যুদস্ত হয়ে ফিফার কাছে ব্রিটিশ রেফারির নামে চুকলি কাটে। তাদের বক্তব্য ছিল, রেফারি নাকি ‘পশ্চিমি খ্রিস্টিয় সভ্যতার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট দুনিয়ার’ দালাল হিসেবে কাজ করেছে।
হাঙ্গেরির কাপ জেতা তখন সময়ের অপেক্ষা। আগের চার-চারটে বছর পুশকাশ, কোচিস আর হিদেরকুতির স্টিমরোলার বিশ্বফুটবলে অপরাজেয় ছিল। বিশ্বকাপের কিছুদিন আগেই তারা ইংল্যান্ডকে ৭-১ গোলে ধুয়ে দিয়েছে। কিন্তু বিশ্বকাপে আত্মতুষ্টির কোনও জায়গা নেই। ব্রাজ়িলের কড়া প্রতিদ্বন্দ্বিতা সামলে হাঙ্গেরি জীবনপণ করে উরুগুয়ে ম্যাচটাও জিতল। হাঙ্গেরির মতো উরুগুয়েও প্রবল বিক্রমে খেলেছিল সেদিন, কেউ কাউকে এক ইঞ্চি জমি ছাড়েনি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোচিসের জোড়া গোলে ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেল।
কিন্তু ফাইনালে জার্মানির সামনে হাঙ্গেরি পড়ল বেজায় বিপদে। এর আগে গ্রুপ লিগের ম্যাচে অধিনায়ক পুশকাশ চোটের জন্য মাঠের বাইরে থাকলেও তারা ৮-৩ গোলে জার্মানিকে ধরাশায়ী করেছিল। ফাইনালের দিন পুশকাশ কোনওরকমে মাঠে নেমে হাঙ্গেরির ওই অসাধারণ কিন্তু শরীর-মনে ক্লান্ত দলকে নেতৃত্ব দিতে স্রেফ এক পায়ে খেলে গেল। একসময় তারা ২-০ গোলে এগিয়েও যায়। কিন্তু শেষমেশ ৩-২ গোলে ম্যাচটা হারে। জার্মানির এটাই প্রথম বিশ্বখেতাব। অস্ট্রিয়া তৃতীয় হয়, উরুগুয়ে চতুর্থ। এগারোটা গোল করে কোচিস সর্বোচ্চ গোলদাতা হল, জার্মানির মরলক আটটা আর অস্ট্রিয়ার প্রোব্স্ত্ ছ'টা গোল করে। কোচিসের এগারোখানা গোলের মধ্যে সেরা গোলটা ছিল ব্রাজ়িলের বিরুদ্ধে। সেদিন প্রায় উড়োজাহাজের মতো বাতাসে ভেসে এসে বলটাকে মাথা দিয়ে গোঁত্তা মেরে পোস্টের কোণ ঘেঁষে গোলে ঢুকিয়ে দিয়েছিল।
আরও পড়ুন- ১১ জন ফুটবলারকেই পাহাড়ের চুড়োয় দাঁড় করিয়ে গুলি করে মেরেছিল হিটলারের দল
রানের গোল
১৯৫৪-র বিশ্বকাপের ফাইনালে সম্ভাব্য বিজয়ী হাঙ্গেরি খেলছিল জার্মানির বিরুদ্ধে।
খেলা শেষ হতে তখন আর ছ'মিনিট বাকি, দু'দলই দুটো করে গোল করেছে, সেইসময় বিশালকায় জার্মান ফরোয়ার্ড হেলমুট রান অর্ধবৃত্তের মধ্যে হাঙ্গেরির রক্ষণে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসা একটা বল ধরল। রান বুদ্ধি করে লান্তোসকে এড়িয়ে গিয়ে বাঁ পায়ে গোলার মতো শট নেয়। গোলে ঢোকার মুখে ডান দিকের পোস্টের ঠিক নীচে হাঙ্গেরির গোলকিপার গ্রশিৎশ বলটা ঠেকিয়ে দিল।
জার্মানির সবচেয়ে জনপ্রিয় ধারাভাষ্যকার হেরিবার্ট সিমারমান রানের শট দেখেই সোল্লাসে দক্ষিণ আমেরিকার ধারাভাষ্যকারদের মতো চেঁচিয়ে ওঠে, 'গোওওওওওওওওওওওওলললললললল !!!'
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এই প্রথম জার্মানিকে বিশ্বকাপে খেলতে দেওয়া হল। জার্মানরা বোঝাতে চাইছিল তারাও পারে, পুরোমাত্রায় বাঁচার অধিকার তাদেরও আছে। সিমারমানের চিৎকার ছিল ওদের সম্ভাব্য জাতীয় পুনরুজ্জীবনের প্রতীক। বহুকাল পরে সিমারমানের সেই চিৎকার ফের শোনা যায় ফাসবিন্দারের ‘মারিয়া ব্রনের বিয়ে’ ছবিতে। ওই ছবিতেও ধ্বংসস্তূপ থেকে মারিয়ার বেরিয়ে আসার ব্যর্থ চেষ্টার গল্প ছিল।
চলমান বিজ্ঞাপন
উরুগুয়ের পেনারল ক্লাব গত শতাব্দীর পাঁচের দশকের মাঝামাঝি প্রথমবার নিজেদের জার্সিতে বিজ্ঞাপন লাগানোর জন্য চুক্তি সই করে। ক্লাবের দশজন খেলোয়াড় বুকে কোম্পানির বিজ্ঞাপন সেঁটে মাঠে নামল। কিন্তু ওবদুলিয়ো ভারেলা নিজের পুরনো জার্সিটা আঁকড়ে ছিল, অনেক সাধ্যসাধনার পরও তাকে রাজি করানো যায়নি। ওবদুলিয়ো সাফ জানিয়ে দিয়েছিল, "ওসব দিন গেছে। কালোচামড়ার মানুষদের ওরা এককালে নাকে দড়ি বেঁধে হিঁচড়ে নিয়ে যেত। এখন আর ওসব চলবে না"।
আজকের দিনে ফুটবলাররা সবাই চলমান বিজ্ঞাপন।
কার্লোস মেনেম ১৯৮৯ সালে আরহেন্তিনার জাতীয় দলের জার্সি পরে একটা প্রীতি ম্যাচ খেলতে নামে। সে ম্যাচে সতীর্থদের নিয়ে মারাদোনাও ছিল। কিন্তু মেনেমের জার্সিতে এমন পেল্লাই একটা রেনো কোম্পানির লোগো সাঁটা ছিল যে টেলিভিশনে বোঝাই যাচ্ছিল না লোকটা আরহেন্তিনার রাষ্ট্রপতি নাকি রেনোর কর্ণধার।
১৯৯৪-এর বিশ্বকাপে অ্যাডিডাস আর আমব্রোর লোগোর ঠ্যালায় কোনও দেশেরই জাতীয় প্রতীক-ট্রতীক চোখে পড়ছিল না। জার্মান দলের অনুশীলনের পোশাকে প্রজাতন্ত্রের প্রতীক ঈগলের পাশাপাশি মার্সিডিজের তারা জ্বলজ্বল করছিল। ওই একই তারা জ্বলতে দেখা যায় ভিএফবি স্টুটগার্টের জার্সিতেও। ওদিকে বায়ার্ন মিউনিখ আবার পছন্দ করে ওপেলের গাড়ি। প্যাকেজিং শিল্পের বাঘ টেট্রাপ্যাক আইনট্রাখ ফ্রাঙ্কফুর্টকে পয়সা জোগায়। বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের খেলোয়াড়েরা ওরিয়েন্টালে বিমা কোম্পানির হয়ে প্রচার করে। বরুসিয়া ম্যাঞ্চেনগ্লাডবাখ প্রচার করে ডায়াবেলস বিয়র। লেভারকুসেন আর উয়রদিঙ্গেন নিজেদের জার্সিতে বায়ার কোম্পানির ট্যালসিড আর ল্যারিলিন ট্যাবলেটের লোগো লাগায়।
জার্সির পিঠে লেখা নম্বরের চাইতেও বুকে সাঁটা বিজ্ঞাপন যেকোনও খেলোয়াড়ের কাছে বেশি জরুরি। ১৯৯৩-এ আরহেন্তিনায় এক কাণ্ড হলো! জাতীয় কার-রেসিং চ্যাম্পিয়নশিপে কোনও বিজ্ঞাপনদাতাকে ভজাতে না পেরে শেষে ‘বিজ্ঞাপনদাতা চাই’ বলে দৈনিক ক্ল্যারিনে বিজ্ঞাপন দিতে হয়। বিজ্ঞাপন এসে আর কিছু করুক আর না করুক, খেলার দুনিয়ার সহজ-সরল পরিচ্ছন্নতাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। ১৯৯৩ সালেই চিলের ফুটবল মাঠে দর্শকদের গুণ্ডামি এমন লাগামছাড়া হয়ে যায় যে স্টেডিয়ামে কোহল বিক্রি নিষিদ্ধ হয়ে যায়, অথচ চিলের ফার্স্ট ডিভিশনের বেশিরভাগ দলই জার্সিতে বিয়র কিংবা পিসকোর লোগো ব্যবহার করে।
আরও পড়ুন- গোল না ঠেকানোর শাস্তি! ৪৩ বছরের সাজা ভুগেছিলেন বিশ্বকাপের গোলকিপার
আগেকার দিনে খেলোয়াড়দের অমলিন জীবনযাপনের কথা বলছিলুম বটে, কিন্তু মহামহিম পোপ তো আবার পবিত্র আত্মাকে অলৌকিক জাদুবলে ব্যাঙ্কে রূপান্তরিত করে ফেলেছেন। ইদানীং ইতালির লাৎজ়িও ক্লাবের জার্সিতে লেখা থাকে ‘বাঙ্কো দি সান্তো স্পিরিতো’, যেন প্রতিটি খেলোয়াড় ঈশ্বরের নিজস্ব ব্যাঙ্কের খাজাঞ্চি।
১৯৯২-এর দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে ইতালির মত্তা কোম্পানি নিজেদের হিসেব-টিসেব ভালো করে খতিয়ে দেখে জানায় মিলানের ফুটবলারদের জার্সিতে সাঁটা তাদের লোগো মোট ২২৫০ বার খবরের কাগজের ছবিতে দেখা গেছে, টেলিভিশনে ছ'ঘণ্টা। মত্তা মোট পঁয়তাল্লিশ লক্ষ ডলার দিয়েছিল মিলানকে। তাদের কেক কিংবা অন্যান্য পণ্যের ব্যাবসা বেড়েছিল দেড় কোটি ডলারেরও বেশি। ইতালির আরেকটি নামকরা সংস্থা পারমালাত, যারা দুনিয়ার চল্লিশটা দেশে দুগ্ধজাত পণ্যের ব্যাবসা করে, তাদের কাছে ১৯৯৩ ছিল সোনার ফলানোর মরসুম। সেবছর তাদের দল পারমা প্রথমবারের জন্য ইওরোপিয়ান কাপ উইনার্স কাপ জেতে। আর অতলান্তিকের এপারে, দক্ষিণ আমেরিকায়, যে দলগুলো জার্সিতে তাদের লোগো ব্যবহার করত পামেইরাস-বোকা-পেনারল সব্বাই খেতাব জেতে। ফলত, আঠারোটা কোম্পানিকে টপকে পারমালাত ব্রাজ়িলের বাজারে ঝড় তোলে এবং আরহেন্তিনা-উরুগুয়ের বাজারেও নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয়, সবই কিন্তু ফুটবলের হাত ধরে। এই বাজার দখলের খেলায় তারা লাতিন আমেরিকার বেশ কয়েকটা ফুটবল দলও খরিদ করে নেয়। ফলে ব্যাপারটা আর শুধু জার্সি দখলে সীমাবদ্ধ না-থেকে খেলোয়াড়দের পা জোড়াও তাদের কাছে বন্ধক পড়ল। এক কোটি ডলার খরচা করে তারা এডিলসন-মাজ়িনো-ক্লেবে-জ়িনোকে কিনে নেয়। এরা সবাই কোনও না কোনও সময়ে ব্রাজ়িলের জাতীয় দলের খেলোয়াড় ছিল। সেই সঙ্গে পামেইরাসের আরও সাতজন ফুটবলারকে তারা কিনল। ব্যাপারটা ভেবে দেখুন, এরপর থেকে যদি কেউ ওই খেলোয়াড়কে নিজেদের দলে পেতে চায় তাহলে কোম্পানির হেড অফিস পারমা, ইতালি এই ঠিকানায় তদ্বির করতে হবে।
টিভিতে ফুটবলারদের খুব কাছ থেকে দেখানো শুরু হওয়ার পর, তাদের মাথা থেকে পা পর্যন্ত সবটাই বিজ্ঞাপনের হোর্ডিংয়ের কাজ করতে লাগল। যখন কোনও তারকা ফুটবলার নীচু হয়ে বসে জুতোর ফিতে বাঁধে, তখন তার আঙুলের শ্লথগতি আসলে ব্যাবসাবুদ্ধিতে ঝিকিয়ে ওঠে; সে দেখাতে চায় তার পায়ে নাইকি, অ্যাডিডাস না কি রিবকের ছাপ। আরহেন্তিনা-জার্মানির মধ্যে ১৯৯০-এর বিশ্বকাপ ফাইনালের দিন অ্যাডিডাসের লোগো জড়ানো ছিল সর্বত্র- বলে, খেলোয়াড়দের জার্সি-প্যান্টে, রেফারি-লাইন্সম্যানের পোশাকেও। এমন কাণ্ড দেখে সিম্পসন আর জেনিংস নামে দুই ব্রিটিশ সাংবাদিক মন্তব্য করেছিল কেবল রেফারির বাঁশিটাই অ্যাডিডাসের কেনা নয়।