রান্না থেকে বিয়ে, সর্বত্র অপরিহার্য 'গোল্ডেন স্পাইস'! হলুদের ইতিহাস জানলে চমকে উঠতে হয়

বরাবরের মতো ভারতীয় রসনায় হলুদের জায়গা পাকাপোক্ত। তার সিংহাসন টলানো যাবে না। ব্রিটিশ এশিয়ান রান্নায় হলুদের উপস্থিতি থেকে আজকের দিনের রান্নাতেও তার একই স্থান রয়ে গেছে।

হলুদ। দিশি রান্নায় এক অন্যতম প্রধান উপাদান। মাছ ভাজবেন, একটু হলুদ তার ওপর ছড়িয়ে দিন, মাছের ঝোল, তাতেও হলুদ, মাংস রাঁধতে হলুদ লাগবেই, যে কোনও ভাজাভুজিতে তিনি আছেন, ডাল রান্না করবেন, তাও হলুদ, বিয়েতে বর-কনের গায়ে লাগাতেও হলুদ, সরস্বতী পুজোতে সকালে স্নান করতে হবে- তাও সেই হলুদ মেখে। রান্নায় তেল-নুনের মতোই হলুদও একরকমভাবে ভারসাম্য বজায়ের কাজ করে। পুজোপার্বণ থেকে শুরু করে বিয়ের অনুষ্ঠান আবার রান্না সব ক্ষেত্রে হলুদ লাগবেই লাগবে। কিন্তু কতটা জানি আমরা এই হলুদ সম্পর্কে?

পশ্চিম বিশ্বে দারুণ কদর হলুদের। সেইসব জায়গায় এটি সুপারফুড। ইদানীন্তনে পশ্চিমের নানা রেসিপিতে যোগ করা হচ্ছে হলুদ। ইউরোপ ও আমেরিকার বেশ কিছু রেস্তোরাঁয় ‘গোল্ডেন ল্যাটে’ বা ‘গোল্ডেন মিল্ক’ নামে হলুদ দিয়ে তৈরি বিশেষ ড্রিঙ্ক পাওয়া যায়। কিছু দশক আগে থেকেই তারা হলুদের গুণাগুণ ও ক্ষমতা সম্পর্কে অবগত হয়েছে। তাই এর চাহিদা এখন তুঙ্গে। কিন্তু ভারত এর গুরুত্ব বুঝেছে অনেক আগে থেকেই।

ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাচীনকালে এই মশলাটি ‘হলুদ’ বলে পরিচিতি পায় তার রঙের কারণে। সংস্কৃত শব্দ ‘হরিদ্রা’ থেকে এই শব্দের উৎপত্তি বলে ধরা হয়। জানলে অবাক হবেন, শুধু সংস্কৃত ভাষাতেই এর ৫৩টি আলাদা নাম আছে– গৌড়ি, হৃদয়াভিলাষিণী, নিশা, হেমারাগী, শিফা, শ্যামা, তমস্বিনী, বৈরাগী, বর্ণিনী, যামিনী, এমন আরও অনেক। বিভিন্ন লোকজ বিশ্বাস থেকেই এত বিচিত্র নামের উদ্ভব। অনুমান করা হয়, ভারত থেকেই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে হলুদ। তবে এই অনুমান কতটা সঠিক, তা বলতে পারি না।

আরও পড়ুন: সূক্ষ্ম মসলিনে স্পষ্ট হয়ে উঠত দেহ, কোথা থেকে এসেছিল এই শব্দ?

বলা হয়, জানুয়ারির মাঝামাঝি সময় দক্ষিণ ভারতে নবান্ন উৎসব ‘পোঙ্গল’ পালিত হয়। সেদিন গৃহস্থের বাড়িতে উনুনে দুধের হাঁড়িতে হলুদের পাতা বেঁধে ফোটানো হয়। প্রার্থনা করা হয় যে, যেন গৃহস্থ বাড়িতে সারা বছর গোলাভরা ফসল থাকে।

হলুদের সুলুকসন্ধান করলে এক বৈজ্ঞানিক গবেষণার কথা উঠে আসে। জার্মানির লুডউইগ ম্যাক্সিমিলাস বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ববিদ ফিলিপ স্টকহ্যামার এবং গবেষকদের একটি দল লেবানন, সিরিয়া, ইরাক, ফিলিস্তিন ও জর্ডন নিয়ে গঠিত লেভান্তে অঞ্চলের পুরনো শহর মেগিদ্দায় কিছু পুরনো তৈজসপত্র পায়, যেখানে হলুদের ছাপ পাওয়া যায়। আবার কিছু কঙ্কালের দাঁত থেকেও হলুদ পাওয়া গেছে। তাই সেই গবেষণা মেনে অনেকেরই দাবি, এশিয়া অঞ্চলে এই মশলা এসেছিল ৩,৭০০ বছরেরও আগে। তবে উৎপত্তি যেখানেই হোক, ধারণা করা হয় যে, প্রথমদিকে রান্নায় কীভাবে এর ব্যবহার হয়, সেই নিয়ে কারও কোনও ধারণা ছিল না। মূলত বৌদ্ধ সন্ন্যাসী বা ধর্মীয় উপাসকরা নিজের গায়ের কাপড়ের রং হিসেবে হলুদ ব্যবহার করতেন। অনেক পরে মানুষ এর ঔষধিগুণ সম্পর্কে অবগত হয়। প্রাচীন আয়ুর্বেদ শাস্ত্রেও হলুদের উল্লেখ আছে।

তবে হলুদ নিয়ে প্রচলিত মিথও শোনা যায়। আমরা সবাই জানি, বাঙালি বিয়েতে ‘গায়ে হলুদ’ অনুষ্ঠানের কথা। আর এখন শুধু বাঙালি বিয়ে নয়, অন্য সম্প্রদায়ের বিয়েতেও গায়ে হলুদ হয়ে থাকে। কিন্তু জানেন কি, কীভাবে এসেছিল এই ‘গায়ে হলুদ'-এর রীতি? অনেকে মনে করেন, গায়ে হলুদের রীতি প্রচলিত হয়েছে হিন্দু ধর্ম থেকে, কিন্তু ভারতীয় ইতিহাস অন্য কথা বলে। বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের মতে, বর্তমান বিয়ের রীতি অনেকটাই মুঘল যুগের সঙ্গে সদৃশ। আগে সূচ ছোঁয়ানো হয়নি এমন পোশাক পরে বিয়ে করতে হতো, কিন্তু জাহাঙ্গিরের স্ত্রী নূরজাহান জরির বেনারসির প্রচলন করেন। সেই শাড়ি দেখতে এতই সুন্দর ছিল যে, হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে এই শাড়ি পড়তে শুরু করেন। তেমনই কোনও ধর্মীয় কারণ নয়, হলুদের উপকারিতার জন্যই বিয়েতে এর আগমন।

বিশেষজ্ঞর মতে, কাঁচা হলুদ জীবাণুনাশক। শরীর ঠান্ডা রাখতে এবং বিভিন্ন সংক্রমণ ঠেকাতে হলুদ অপরিহার্য। আর বিয়ের দিন নানারকম মানসিক চাপ থাকে বর-কনের ওপর, তাদের শরীর ভালো রাখার জন্য এবং সংক্রমণ রুখতে হলুদ ব্যবহার হতো প্রাচীনকালে। তারই আধুনিক রূপ ‘গায়ে হলুদ’। আবার অনেকে বিয়েতে হলুদের ছোঁয়াকে মঙ্গলজনক মনে করতেন।

হলুদের গুণাগুণ নিয়ে কিছু বলাই বাহুল্য। দেখে নেওয়া যাক, স্বাস্থ্যের কতটা উপকারে লাগে হলুদ।

  • হলুদের মধ্যে আছে কারকিউমিন বলে একটি উপাদান, যা একশো রোগের প্রতিরোধ করে।
  • ক্যানসার প্রতিরোধে হলুদের গুণ অনস্বীকার্য।
    একজন সুস্থ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ হলুদের সঙ্গে গোলমরিচ মিশিয়ে খেতে পারেন।
  • কোলেস্টেরল বেড়ে গেছে আর ডাক্তার খাবারদাবারের ক্ষেত্রে একরাশ নিদান দিয়েছেন, চিন্তা কী! হলুদ আছে তো। রক্ত বিশুদ্ধ করতে, ফ্যাটি লিভার থেকে উপকারে, পেটের হজমের সমস্যায় হলুদ একদম টপে।
  • মুখ ব্রণতে ভরে গেছে, আয়নায় নিজের মুখ নিজেই দেখতে চাইছেন না? মুশকিল আসান নিয়ে হাজির হলুদ। ত্বকের বলিরেখা, বয়সের ছাপ, ব্রণ, ত্বকের তেলতেলে ভাব দূর করা সব কাজ একাই করে দেবে।
  • অনিয়মিত পিরিয়ড এবং হরমোনের মাত্রা বৃদ্ধি রোধ করে হলুদ।
  • বিভিন্ন কাটাছেঁড়া, ব্যথা উপশম এবং কোনও ক্ষতস্থানে অ্যান্টিসেপটিক হিসেবে কাজ করে হলুদ।
  • রক্তশূন্যতা দূর করতে অনেকে আবার কাঁচা হলুদের রস খেয়ে থাকেন।
  • শিশুদের লিউকেমিয়া, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে হলুদ রীতিমতো উপকারী।
  • গলা ব্যথা, গলা জ্বালা করলে গরম দুধে হলুদ মিশিয়ে খেয়ে নিন।
  • হলুদের মধ্যে থাকা কারকিউমিনে অ্যাসপিরিনের মতো গুণাগুণ থাকায় তা মানসিক অবসাদ দূরে রাখতে সাহায্য করে।
  • হলুদের অন্য আরেক উপাদান পলিফেনল ‘ক্রনিক’ রোগ সারাতে সাহায্য করে।

আমাদের বাংলায় রান্নায় যেভাবে হলুদ ব্যবহার হয়, মহারাষ্ট্র, গোয়ায় আবার রান্নায় হলুদ পাতা ব্যবহার করা হয়। তাতে নাকি অন্য গন্ধ আসে। কীটনাশক হিসেবেও হলুদের অনেক ব্যবহার। মুখে মাখার প্রসাধনী হিসেবে হলুদের ব্যবহার বহু প্রাচীন। সবশেষে বলা যায়, বরাবরের মতো ভারতীয় রসনায় হলুদের জায়গা পাকাপোক্ত। তার সিংহাসন টলানো যাবে না। ব্রিটিশ এশিয়ান রান্নায় হলুদের উপস্থিতি থেকে আজকের দিনের রান্নাতেও তার একই স্থান রয়ে গেছে। হাজার হাজার বছর আগেও এটি মূল্যবান মশলা ছিল, আছে, আর হাজার বছর পরেও তাই থাকবে।

 

 

More Articles