উত্তরে কাশ্মীর থেকে দক্ষিণে মুন্নার, ইন্টারনেটের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে ভারতের বিখ্যাত সব পোস্ট অফিস
Post Office : ভারতেই প্রথম চালু হয় ডাক ব্যবস্থা
“চিঠি দিও কিন্তু হপ্তায় দু’টো করে… না এলে কিন্তু আড়ি আড়ি আড়ি...’’, অপর্ণা আর অপুর এই প্রতীক্ষার মতোই কত প্রেমিক প্রেমিকার বিনিদ্র দুপুর কাটত চিঠির অপেক্ষায়। আর সেই কবেকার...
“রানার ছুটেছে তাই / ঝুমঝুম ঘণ্টা বাজছে রাতে,/ রানার চলেছে / খবরের বোঝা হাতে, / রানার চলেছে, রানার!” কিংবা, মেঘপিওনের ব্যাগের ভেতর যে মন খারাপের দিস্তা তার খবর রাখে কোনও ডাকপিওন?
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ডাক ব্যবস্থা বিবর্তিত হলেও সুকান্ত ভট্টাচার্যের লাইনগুলোর সঙ্গে যে দৃশ্যকল্প মাথায় আসে, তা হল- চিঠি আর সংবাদের বোঝা পিঠে নিয়ে যাওয়া এক মানুষের চেহারা, হাতে লন্ঠন, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়ে আজকের পিওন বা ডাক হরকরার চেহারা নিয়েছে। উপমহাদেশে ব্রিটিশ আমল থেকেই ডাক কার্যক্রম শুরু হয়। তখন থেকেই রানারদের কাজ— মূল বা সদর এলাকার ডাকঘরের চিঠি গ্রাম ও প্রত্যন্ত এলাকার ডাকঘরে পৌঁছে দেওয়া; এবং সেখানকার ডাকবাক্সের চিঠিগুলো সদর এলাকার ডাকঘরে নিয়ে আসা। একসময় চিঠিপত্রের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বল্লম ও লণ্ঠন হাতে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছুটে বেড়াতেন রানার।
রানার নতুন সংবাদের বোঝা কাঁধে নিয়ে গ্রামের মাঠ-ঘাট, পথ-প্রান্তর পেছনে ফেলে শহরের পানে ছুটে চলতেন। ঠিক এভাবেই জীবনের বহু বছর ধরে বহু চাওয়া পাওয়ার আশা, স্বপ্ন পেছনে ফেলে মানুষের কাছে কতই না সংবাদ পৌঁছে দিয়েছেন তাঁরা। আজ এসব অতীত। কারণ ইন্টারনেটের দাপট।
আরও পড়ুন - মাত্র ৯৫ টাকা প্রিমিয়ামে ১০ লক্ষ রিটার্ন! আজও লক্ষ্মীলাভের সেরা ঠিকানা পোস্ট অফিস
`অপুর সংসারে’ অপর্ণাকে ট্রেনে তুলে দেওয়ার সময় তিনি অপুকে বলেন, `চিঠি দিও কিন্তু হপ্তায় দু’টো করে...’’ কত প্রেমিক প্রেমিকার ঘুম না আসা দুপুর কেটেছে পিওনের হাত ধরে আসা চিঠির অপেক্ষায়। ফলে কত জীবন যৌবনের আশা-আখাঙ্খা আবেগ-ভালোবাসা নিয়ে বিলীন হয়ে গেছে চিঠি সংস্কৃতি। সেই জায়গা দখল করেছে মেইল, হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক। মোদ্দা কথা হল, এত কিছুর পরেও এই দেশের বুকে বছরের পর পর বছর চিঠি সংস্কৃতির ঐতিহ্য বহন করে চলেছে বিখ্যাত সব পোস্ট অফিসগুলো। টেলিফোন, ইমেল আসার আগে ভারতীয়দের এই পোস্ট অফিসের সঙ্গেই ছিল নিবিড় সম্পর্ক।
ভারতে ডাক ব্যবস্থার ইতিহাসের সুলুক সন্ধান পেতে যেতে হবে সেই ব্রিটিশ আমলে। তখন ওয়ারেন হেস্টিংস ব্রিটিশ ভারতের গভর্নর জেনারেল। ১৭৭৪ সালের মার্চ মাসে তিনিই প্রথম ডাক ব্যবস্থা চালু করেন কলকাতায়। পরে ১৮৮৪ সালে ভারতই এশিয়ার প্রথম পোস্টেজ স্ট্যাম্প ব্যবহার শুরু করে তৎকালীন পাকিস্তানের সিন্ধ পোস্ট অফিস থেকে।
স্বাধীনতার পর থেকে ভারতীয় ডাক দেশজুড়ে বিভিন্ন সেবা প্রদানে অগ্রণী হয়। ১৯৫৯ সালের ভারতীয় ডাক বিভাগ "Service before Self" কে নিজের আদর্শ বাক্য হিসাবে গ্রহণ করে। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়কালে আধুনিকীকরণে ব্যাপক গুরুত্ব আরোপ করে আসছে এই ডাক বিভাগ। বর্তমানে ভারত বিশ্বের বৃহত্তম ডাক পরিষেবা।
যে বিখ্যাত পোস্ট অফিসগুলো বছরের পর বছর পরিষেবা দিয়ে আসছে, এবার তার আনাচ কানাচে ঘুরে দেখা যাক। দেশের বেশ কিছু ডাকঘরের তো অস্তিত্বও মুছে গিয়েছে। তবু ভারতীয় সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে রয়ে গিয়েছে ডাকঘর। যদিও এরই মধ্যে এমন কিছু ডাকঘর রয়েছে যা পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে এখন জনপ্রিয়। যেমন শ্রীনগরের ভাসমান ডাকঘর।
১. শ্রীনগর- ভাসমান ডাকঘর
শ্রীনগরের ডাল লেকের উপর অবস্থিত এই ভারতীয় পোস্ট অফিস। দূরে থেকে দেখলে মনে হবে না যে এটা ভাসমান ডাকঘর। আর পাঁচটা সাধারণ শিকারা কিংবা হাউস বোটের মতোই কিছুটা দেখতে এই ভাসমান ডাকঘর। যদিও এই শিকারার সামনে টাঙানো রয়েছে ভারতীয় ডাকবিভাগের বোর্ড। বড় বড় অক্ষরে লেখা ‘Indian Post’। প্রায় ২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই ডাকঘর পরিষেবা দিয়ে আসছে। যদিও বর্তমানে এটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। এখন প্রিয়জনকে খুব একটা চিঠি পাঠান না কেউই।
ব্রিটিশ আমলে তৈরি হয় এই পোস্ট অফিস। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভগ্নপ্রায় অবস্থা হয়ে গিয়েছিল এই ডাকঘরের। ২০১১ সালে আবারও নতুন রূপে সাজানো হয় ডাকঘরটিকে। ২০১১-এর আগে পর্যন্ত এটি পরিচিত ছিল ‘নেহেরু পার্ক পোস্ট অফিস’ নামে। ২০১১ সালে এই নবরূপ ডাকঘরের উদ্বোধন করেন জম্মু কাশ্মীরের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা। সেই সময় থেকে এই পোস্ট অফিস পরিচিতি লাভ করে ‘ভাসমান ডাকঘর’ নামে। আর এখন এটি শ্রীনগরের অন্যতম দর্শনীয় স্থান।
২. হিক্কিম পোস্ট অফিস
ভারতের এক দুর্গম পাহাড়ে অনুষ্ঠিত বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ডাকঘর এইটি। ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় হিমাচল প্রদেশের অন্তর্গত লাহালু ও স্পিটি জেলা; এই দুই জেলার মধ্যভাগে অবস্থিত স্পিটি উপত্যকা। এই উপত্যকায় বেশ কয়েকটি গ্রাম রয়েছে, যা ভারতের সবচেয়ে উঁচু বসতিপূর্ণ গ্রাম। শুধু ভারত নয়, এ গ্রামগুলো বিশ্বেরও সবচেয়ে উঁচু বসতভূমি। নানা কারণেই এই দুর্গম পাহাড়ি গ্রামগুলো বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, এখানে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু পোস্ট অফিস অবস্থিত। পোস্ট অফিসটির অবস্থান হিক্কিম গ্রামে। শুধু তা-ই নয়, এই হিক্কিম গ্রামকে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু ভোটকেন্দ্র হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। হিক্কিম গ্রামের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৫,৮৭২ মিটার। হিক্কিমে কোনো টেলিফোন বা মোবাইল সংযোগ নেই। তবে একটি স্কুল রয়েছে সেখানে। কিন্তু স্কুলের ছাত্রসংখ্যা মাত্র ৫ জন। দুর্গম পাহাড়ের পথ হলেও অনেক ভ্রমণপিপাসু পর্যটক সেখানে ঘুরতে যান। কেননা হিক্কিমে গেলে একইসঙ্গে নয়নাভিরাম পাহাড়, বরফ, ঝর্ণা, দুর্গম পথ অতিক্রম করা যায়, তার সঙ্গে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু বসতিপূর্ণ গ্রাম ও সবচেয়ে উঁচু পোস্ট অফিস দেখার অভিজ্ঞতাও অর্জন করা যায়।
৩. কলকাতার প্রথম পোস্ট অফিস
ভারতের ডাক ব্যবস্থার ইতিহাসে কলকাতার নাম লেখা হয়েছে সবার আগে। কারণ ১৭৭৪ সালে এখানেই প্রথম পোস্ট অফিস তৈরি করেন ওয়ারেন হেস্টিংস। তখন ডাক পরিষবা সীমাবদ্ধ ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অফিসারদের মধ্য। এরপর ১৮৬৮ সালে শহর পেল তার নিজস্ব জিপিও। সাধারণের দাবি মেনে তৈরি হল পোস্ট অফিস।১৮৬৮ সালে পুরনো ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের একাংশে এই ডাকঘরটি স্থাপিত হয়। পূর্বে পুরনো কেল্লার অবস্থান নির্দেশ করে এখানে একটি পিতলের পাত বসানো থাকত। ভারত সরকারের স্থপতি ওয়ালটার বি. গ্রেনভিলের নকশা অনুযায়ী ম্যাকিনটশ বার্ন এই ভবনটি নির্মাণ করে। বর্তমানে এখানে একটি ডাক সংগ্রহশালা, ডাকটিকিট সংগ্রহের লাইব্রেরি ও সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা অবলম্বনে নির্মিত একটি "রানার" ভাস্কর্য আছে।
৪. মুন্নার- প্রাচীনতম পোস্টাল নম্বর
মুন্নার দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতের কেরালার ইদুক্কি জেলার একটি শহর ও পাহাড়ি অঞ্চল। মুন্নার পশ্চিমঘাট পর্বতমালার মাঝামাঝি সমুদ্র সমতল থেকে ১,৬০০ মিটার (৫,২০০ ফুট) উচ্চতায় অবস্থিত। মুন্নারকে "দক্ষিণ ভারতের কাশ্মীর" বলা হয় এবং মধুচন্দ্রিমার জন্য এটি একটি প্রিয় গন্তব্য। এখানে ডাক ব্যবস্থা যথেষ্টই উন্নত। পোস্টাল নম্বর ৯ (পিবি)-এর জন্য এই এলাকা বিখ্যাত। প্রাচীনতম পোস্টাল নম্বরের কারণে মুন্নারের স্থানীয়দের বাইরের এলাকাবাসীর সঙ্গে ডাক যোগাযোগে সুবিধা হয়।
আরও পড়ুন - পায়রা, ঘোড়া থেকে পোস্ট অফিস! ভারতের ডাকব্যবস্থা যে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এল
৫. নাগপুর – হেরিটেজ পোস্ট অফিস
নাগপুরেরে জিপিও-এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঐতিহ্য। অবস্থান মহারাষ্ট্রে। এই জিপিও বাড়িটি ভিক্টোরিয়ান স্টাইলে তৈরি। শহরের একেবারে প্রাণকেন্দ্র, এর ঠিকানা। এর বিশেষ নির্মাণশৈলী পর্যটকদের চোখ টানে। ইটের গাঁথুনি, স্টিলের স্তম্ভ, বিম, রিব সবমিলিয়ে কংক্রিটেও ঐতিহ্য। বাইরের দিকে রয়েছে বিরাট বারান্দা। ১৯৯৪ সালে ভারত সরকার এই জিপিও-কে জাতীয় হেরিটেজ ঘোষণা করেন। এখানে পোস্টমাস্টারদের আবাসন রয়েছে। রয়েছে পার্সেল হাব, বিনোদন ক্লাব এবং ক্যান্টিন।
৬. মুম্বই- বৃহত্তম পোস্ট অফিস
এটিই দেশের বৃহত্তম পোস্ট অফিস। শুধু তাই নয়, সারা পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ পোস্ট অফিসও এই মুম্বই জিপিও। ১৭৯৪ সালে মুম্বইয়ে এই পোস্ট অফিস নির্মাণ হয়। তখন পোস্টার মাস্টার ছিলেন চার্লস এলফিনস্টোন। ইন্দো সারাসেনিক স্থাপত্য অনুযায়ী এই জিপিও নির্মাণ করা হয়। ১২০,০০০ স্কোয়ার ফিটের এই বিশাল বাড়িটি তৈরি করতে সময় লেগেছিল টানা ৯ বছর। এখানে একটা বিসনেস হল আছে, ১০১টা কাউন্টার আছে। রয়েছে একটি সেন্ট্রাল হলও। শহরের ছোটখাটো পোস্ট অফিসগুলো সবই এখান থেকে নিয়ন্ত্রিত হয়।
কথিত আছে কলকাতার দুর্গাপুজোর সঙ্গেও জড়িত ছিল এই বহু প্রাচীন ডাক ব্যবস্থা। শোভাবাজারে নবকৃষ্ণ দেবের বাড়ির দুর্গাপুজোর সময় রুপোর তবক এসেছিল জার্মানি থেকে, তাও ডাকযোগে। সেই থেকেই নাকি ‘ডাকের সাজ’ কথাটা চালু হয়। সত্যি মিথ্যে বিচারের ভার অবশ্যই ইতিহাসের। তবে ডাক ব্যবস্থা যে ভারতীয় তথা বাঙালি সংস্কৃতির এক অপরিহার্য ও অবিচ্ছেদ্য অংশ, সে বিষয়ে কোনও দ্বিমত নেই এই ইন্টারনেটের যুগেও।