ঠাকুরবাড়ির সিদ্ধি, অলিগলির বাঁদুরে রঙ! কেমন ছিল পুরনো কলকাতার দোল?
Old Kolkata Dol Utsab: যাকে আমরা আজ বলি বাদুরে রং; সোনালি, রুপোলি বর্ণে ছোট ছোট শিশিতে বিক্রি হওয়া সেই গাঢ় বাঁদুরে রঙের আর এক নাম ম্যাজেন্ডার।
আজ দোল পূর্ণিমা। রাস্তার দোকান কালো-সাদা মুখোশ, পিচকারি আর সুগন্ধি আবিরে পরিপূর্ণ। স্কুল-কলেজে বেশ কিছুদিন যাবৎ রং মাখামাখির পালা চলছে, এমন রঙিন দিনে আমরা ফিরে যাব পুরনো কলকাতার বসন্ত উৎসবে। পথচলতি সাধারণ মানুষ ঠিক কীভাবে দোল উদযাপন করত পুরনো কলকাতায়? উচ্চবিত্তের উৎসব আদৌ কি আলাদা ছিল তার থেকে?
উনিশ শতকের কলকাতায় দোল ছিল অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ। হিন্দু গৃহের শুভ উৎসব, মঙ্গল কামনা এবং তারই সঙ্গে শাক্ত-বৈষ্ণব নির্বিশেষে এই বিশেষ দিনটি উদযাপন করা হতো। হতে পারে মত পার্থক্য, সাকার-নিরাকার বা কালী-কৃষ্ণে তফাৎ, কিন্তু উৎসবের আনন্দ সবার; তাই দোলপূর্ণিমার রাতে লোক ডেকে মণ্ডা- মিঠাই খাওয়ানোর রেওয়াজ ছিল অটুট। ফুটকড়াই বা ছোলা-চিনি মিশ্রিত ছোট ছোট গোলাকার মিষ্টি কোচরে নিয়ে ঘুরে বেড়াত কমবয়সি ছেলেমেয়ের দল। এই ফুটকড়াই এখনও কলকাতার বাগবাজারে দোলের আগে বিক্রি হয়। খুব ছোট মিষ্টি, রসে টইটুম্বুর নয়, তাই অতি সহজে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে খাওয়া যায় আর সঙ্গে থাকে সাদা মুড়কি ও মঠ। আবির মেখে এইসব সুখাদ্য ঝোলায় নিয়ে সারা পাড়ায় আনন্দ ভাগ করে নেওয়া যেত। দোলের তত্ত্বে মিষ্টি পাঠানোর রীতি ছিল এ-বাড়ি থেকে ও-বাড়ি! কুমকুম আর শোলার নুটির ভেতর আবির পুরে ছুঁড়ে মারত সেকালের খুদের দল।
আরও পড়ুন- উৎসবের নামে কতদিন চলবে নিগ্রহ — রংখেলার সিনেমা ও বাস্তব
চাঁচর উৎসব পালন হতো আগের রাতে। প্রথমে আবির নিয়ে সুষ্ঠুভাবে খেলা চললেও তারপর আসত ম্যাজেন্ডার। বিশ শতকেই সম্ভবত এর আবির্ভাব। যাকে আমরা আজ বলি বাঁদুরে রং; সোনালি, রুপোলি বর্ণে ছোট ছোট শিশিতে বিক্রি হওয়া সেই গাঢ় বাঁদুরে রঙের আর এক নাম ম্যাজেন্ডার। শুধু রং কেন! কাদাজল, মাটির ডেলা সব নিয়েই চলত দোল খেলা। এ যেন এক সাময়িক বিরতি, রোজকার একঘেয়েমি কাটানোর স্বতস্ফূর্ত চেষ্টা। যদিও এই সবই অতি সাধারণ, নিম্নবিত্তদের দোল উদযাপন। বড়লোকি বৈঠকখানায় নিশ্চয়ই বাঁদুরে রং মাখানো হবে না! কেমন ছিল জোড়াসাঁকোর হোলিখেলা?
অবনীন্দ্রনাথের ভাষায় ঠাকুরবাড়ির দেউড়িতে হতো লোক সমাগম, বিশাল পাত্রে সিদ্ধি গোলা আর প্রকাণ্ড ঢোল বাজিয়ে উৎসব শুরু হতো। জোড়াসাঁকোর দারোয়ান ছিলেন মনোহর সিং, সাদা দাড়ি, লম্বা চওড়া গড়ন; দোলের দিন তাকে নির্দ্বিধায় রং মাখানো যেত। সিংজির সাদা দাড়ি রক্তিম হলে, ওই বিশেষ দিনে আপত্তির কোনও অবকাশ থাকত না। ছোটরা টিনের পিচকারি কিনে এনে, তাতে লাল জল ভরে বয়স্কদের গায়ে দিতে কুণ্ঠা বোধ করত না, ওইদিন সব বকা- ঝকা মাফ। অন্য বনেদি বাড়ির অন্দরে ঢুকে ঠাকুরবাড়ির শিশুরা বড়দের পায়ে আবির আর সমবয়সীদের মাথায় রং মাখিয়ে আসত।
আরও পড়ুন- জামা ছিঁড়ে খালি গায়ে রঙ খেলার কাছে হাজার গোলে হেরে যায় তিন আঙুলের আবিরের দোল
অবনীন্দ্রনাথ জানাচ্ছেন, তাঁদের বৈঠকখানায় কীভাবে বাড়ির প্রবীণরা দোল উদযাপন করতেন। পাতলা কাপড়ের আবরণ থেকে দেখা যেত লাল আবিরের কিয়দংশ, ফুলের গন্ধে চারিদিক মাতোয়ারা, তারই মধ্যে অতিথিরা বসতেন তানপুরা নিয়ে। গোলাপ জলের পিচকারি আর গড়গড়া থাকত তাদের আপ্যায়নে। একবার দোল উপলক্ষ্যে আসেন এক নাচিয়ে, অবনীন্দ্রনাথের ভাষায় সে এক ' অদ্ভুত নৃত্য'। ঘরের মেঝেতে রাখা আলোর ডুম, আর সেটিকেই প্রদক্ষিণ করে শুরু হলো নাচ। তার পায়ের তলায় আবির দিয়ে তৈরি আলপনার পদ্ম, শিল্পী পায়ের আঙুল দিয়ে আরও খানিকটা আঁকলেন সেই ফুল, সকলে মুগ্ধ এবং বাকরুদ্ধ। জোড়াসাঁকোর ভৃত্যমহলেও চলতো দোল খেলা, বেহারা বাজাতেন ঢোল, রাজপুত দারোয়ানরা তাদের প্রদেশ থেকে নিয়ে আসতেন নৃত্যশিল্পী, অবনীন্দ্রনাথের ভাষায় "বেশ ভদ্র রকমের নাচ (হতো) …… আমরাও দেখতুম"।
অনেকে আবার নিজেরাই মেয়ে সেজে অঙ্গভঙ্গি করতেন। দোলে চলত উড়িয়াদের লাঠিখেলা, এটিও এক প্রকার নাচ। সিদ্ধি খেয়ে সকলে প্রায় দিশাহারা; ফুল, গান-নাচ, বাদ্যযন্ত্রে চারদিক উৎসবমুখর। ছোটবেলা থেকেই অবনীন্দ্রনাথের মনে ধরেছিল এই পরিচারকদের দোল খেলা। বিলাস-বহুলতায় তার বাবামশাইয়ের রঙ খেলা কৃত্রিম প্রতিপন্ন হতো। সেই আয়োজনে কোথায় যেন একটা ঘাটতি ছিল। তিনি লিখছেন, "দেখলেই মনে হতো হোলি খেলা এদেরই (ভৃত্যদের), শখের খেলা নয়…… কৃত্রিম কিছু নেই"।
আসলে শ্রেণিবিভাজন, দোল বা যে কোনও উৎসবকেই আলাদা করে দেয়। বড়লোকদের দামি গোলাপ, আতর বা গড়গড়ার নাগাল পেতেন না অতি সাধারণ মানুষটি। আবার ম্যাজেন্ডার বা কাদামাটি মেখে পথে পথে লোকারণ্যের থেকে দূরেই থাকতে পছন্দ করতো উচ্চবিত্তের দল। যেমন আজও হয় আর কী! হাল ফ্যাশনে বড় বড় মেট্রোপলিটান ক্লাবে সেলিব্রিটি পারফরম্যান্স, দামি ভোজ আবার অপরদিকে কলকাতারই কোনও রেলের ধারের বস্তিতে রং মাখামাখির পর মাংস-ভাত ফিস্ট। সহাবস্থানে বেঁচে থাকে বাংলার উৎসব।