ক্যান্সারে কাবু, তবু দু'হাত তুলে আশীর্বাদ! যেভাবে কল্পতরু হয়েছিলেন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব

Kalpataru Day: দুই হাত তুলে সকলকে আশীর্বাদ করলেন ঠাকুর, “তোমাদের চৈতন্য হোক

বেলা পড়ে এসেছে। তিনটের দাগ ঘড়ির কাঁটা প্রায় ছুঁই ছুঁই। ছুটির দিন। তার আমেজে গৃহী-ভক্তেরা জড়ো হয়েছে কাশীপুর উদ্যানবাটির বাগানে। যদি কোনও ভাবে ঠাকুরের দর্শন মেলে। কিছুদিন হয়েছে শ্যামপুকুর থেকে তাঁকে সরিয়ে আনা হয়েছে এই বাড়ির দোতলার একটি ঘরে। সেই ঘরে সন্ন্যাসী-ভক্তদের সেবায় আছেন ঠাকুর। গলায় ক্যান্সার তখন জাঁকিয়ে বসেছে। খেতে পারেন না কিছুই তেমন। কেশব সেন ঘোষণা করে ফেলেছেন ঠাকুরকে ‘গ্লাস-কেসে’ রেখে দিতে হবে। সকলের স্পর্শ-কলুষেই নাকি ঠাকুরের এই রোগ। তাই গৃহীদের কপালে তখন দৈব আশীর্বাদের স্পর্শ জুটছে না।

হঠাৎ রামকৃষ্ণ উঠে বসলেন দোতলার ঘরে। “আমার কাপড়-জামা দাও, আমি পরব সাজব, যাব আমি বাগানে বেড়াতে।” পরণে লালপেড়ে ধুতি, গায়ে বনাতের জামা, কাপড়ের টুপি দিয়ে কান পর্যন্ত ঢাকা, লতাপাতা আঁকা মোজা চটি-জুতো— ঠাকুর গৃহী-ভক্তদের টানে চলেছেন বাগানে। “আমি তোমাদের একজন। আমি তোমাদের ঘরের মানুষ। তোমাদের আত্মার আত্মীয়।” ঘরে সন্ন্যাসী সেবকদের ফেলে খোলা আকাশের নিচে নেমে এলেন তিনি।

১৮৮৬ সালের পয়লা জানুয়ারি। বেশ শীত পড়েছে কাশীপুরে। আর ঠান্ডা লাগিয়ে ফেলা বালক ঠাকুরের যেন স্বভাব হয়ে গিয়েছে। আর হবে নাই বা কেন। যা বরফ খেতে ভালোবাসেন ঠাকুর! দক্ষিণেশ্বরে যেইই যেত বরফ নিয়ে যেত। ঠাকুর ছেলেমানুষের মতো খুশি। শরবৎ করে দিলে তো দিলে, নইলে সাদা জলেই বরফ ফেলে ঢুক ঢুক করে খেয়ে ফেলেন। কুলপি খান, হিম লাগিয়ে ফেলেন। সেই রকমই কোনও খেয়াল হয়তো। সন্ন্যাসী সেবকেরা কেউ এলে না সঙ্গে। ঘর-দোর বিছানা বালিশ পরিষ্কার করতে বসলে। 

আরও পড়ুন- কল্পতরু রামকৃষ্ণের সামনে সেদিন কেঁদে ফেলেছিলেন গিরিশ

ফটক আর বসতবাড়ির মাঝ বরাবর পশ্চিম দিক ঘেঁষে দর্শনপ্রার্থীরা ভিড় জমিয়েছেন। তাঁদের নিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন গিরিশ ঘোষ, তাঁর ভাই অতুল, রাম দত্ত, অক্ষয় সেনেরা। গিরিশ ঘোষ ইতিমধ্যে সবার কাছে ঠাকুরকে চৈতন্যদেবের পরবর্তী অবতার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেই ফেলেছেন, হঠাৎ ঠাকুরের গলা শোনা গেল, “তুমি যে এত সব বলে বেড়াচ্ছ, কী দেখেছো তুমি?” ঠাকুর! এই অসময়ে! হ্যাঁ তাই তো। সকলেরই যে হাত জোড়া। অকালে দেবদর্শন করে গিরিশ হাঁটু মুড়ে বসে পড়লেন মাটিতে। হাতজোড় করে নিবেদন করলেন, “আমি আর কী বলতে পারি, প্রভু! ব্যাস-বাল্মিকী যার ইয়ত্তা করতে পারেনি, সেখানে আমি কী, আমি কতটুকু!” দুই হাত তুলে সকলকে আশীর্বাদ করলেন ঠাকুর, “তোমাদের চৈতন্য হোক।”

মুহূর্তে প্রণামের হরির লুঠ পড়ে গেল। বহুদিনের অতৃপ্ত গৃহী-ভক্তেরা চাতকের মতো ভিড় করে এলেন তাঁর চারিদিকে। প্রকারান্তে নিজের অবতারত্বের কথা যেন স্বীকার করে নিয়েছেন ঠাকুর। ভক্তিতে সবার মাথা নুয়ে পড়েছে প্রায়। স্পর্শাঞ্জলির তর্পণ। কেশব সেনের সেই বহুদিনের গ্লাস-কেস টুকরো টুকরো হয়ে গেল নিমেষেই। রাম দত্ত অঞ্জলি অঞ্জলি ফুল দিতে লাগলেন। অক্ষয় সেনের হাতে ছিল দু'টি জহুরি চাঁপা। তিনি তাইই নিবেদন করলেন ঠাকুরের পায়। ঠাকুর তাঁর বুক ছুঁয়ে দিলেন। অক্ষয় সেন সমস্ত শরীরে এক অলৌকিক চৈতন্যের ঢেউ খেলে গেল। “ওরে, কে কোথায় আছিস, এইবেলা চলে আয়। মুঠো মুঠো অভয় কুড়িয়ে নে, আশ্বাস কুড়িয়ে নে। চৈতন্যের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। কুড়িয়ে নে ভারে-ভারে। জ্ঞান বৈরাগ্য ভক্তি বিবেক–এমন দিন আর পাবি না রে!” চিৎকার করে অক্ষয় ডাকতে থাকলেন বাকিদের। সে এক হুলুস্থুলু কাণ্ড।

আরও পড়ুন- মুসলিম সম্প্রদায়ের ফুল বেল পাতায় পূজিত হন দুর্গা, অমলিন রামকৃষ্ণের স্মৃতিধন্য এই পুজো!

ছুঁলেন নবগোপালকে, অতুলকে, হরমোহনকে, বৈকুণ্ঠ কিশোরীকে। ভাইপো রামলাল পিছনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছিল সকলের তো একরকম হল, “আমার কি গাড়ু গামছা বওয়া সার হল?” এই কথা যেই না মনে হওয়া ওমনি পিছন ফিরে ঠাকুর বললেন, “কীরে রামললাল এত ভাবছিস কেন? আয় আয়”। গায়ের চাদর খুলে ভাইপোর বুকে আশীর্বাদের হাত বুলিয়ে দিলেন রামকৃষ্ণ। বহুদিন পরে কমলকৃষ্ণ মিত্রকে সেই সব কথা বলতে গিয়ে রামলাল চটোপাধ্যায় হু হু করে কেঁদে উঠবেন। সেই জ্যোতি, সেই অকল্পনীয় দৈবসুধা তখনও তাঁর মানসচক্ষে ভাসছে।

কেউ স্তোত্র পড়ল, কেউ বা ছুঁড়ে দিল ফুল, কেউ ভক্তিরসে চোখের জলে আপ্লুত। রুটি বেলবার আয়োজন করছিল রাঁধুনি বামুন, তাকে হিড় হিড় করে টেনে আনলেন গিরিশ। “ওরে, কাতর প্রভু অকাতর হয়েছেন কৃপাবিন্দু নিয়ে যা পাত্র ভরে।” সেই রাঁধুনিও কৃপা পেল। হরিশ, উপেন্দ্রও এসে পড়ল সঠিক সময়। দু'হাত ভরে যে যা কৃপা প্রার্থনা করলেন তাঁকে তাই দান করলেন ঠাকুর। ঠাকুর সেদিন সাক্ষাৎ কল্পতরু।

অমৃত কুম্ভের সন্ধানে যে সমুদ্র মন্থন হয়, সেই মন্থনে নাকি অন্যান্য নানা জিনিসের সঙ্গে উঠে এসেছিল এক আশ্চর্য গাছ, নানা পুরাণ গাছটির নামের ব্যাপারে একমত, পারিজাত। এই পারিজাত ইন্দ্রের কাননের প্রধান গাছ। ‘হরিবংশ পুরাণ’ একেই কল্পতরু বলে উল্লেখ করেছে। এর কাছে যা চাওয়া হয়, পাওয়া যায় তাইই। কল্পতরু উৎসব তাই ইচ্ছেপূরণের উৎসব। হাজার হাজার বঞ্চনা আমরা বয়ে চলি অহরহ। এই বঞ্চনাদের ভিড়েও কোথাও স্বপ্ন বাস করে। তাই পয়লা জানুয়ারি তারিখটিতে কাতারে কাতারে ভক্ত জড়ো হন কাশীপুর উদ্যানবাটিতে। রামকৃষ্ণের জন্মস্থান কামারপুকুরেও প্রতিবছর মহাসমারোহে পালন করা হয়ে থাকে এই উৎসব। আদ্যাপীঠ, দক্ষিণেশ্বরেও ঠাকুরকে স্মরণ করেন ভক্তরা। গভীর রাত থেকে পুজোর জন্য পড়তে থাকে লাইন। সকাল থেকেই পুজো-অর্চনা, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। জায়গায় জায়গায় আলোচনা সভা। এই একটি দিন রামকৃষ্ণের আশীর্বাদকে উৎসব করে তুলতে পেরেছে বাঙালি। আক্ষরিক অর্থেই।

 

তথ্যঋণ-

 

  • অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, সকলের রামকৃষ্ণ, প্রথম সংস্করণ ১৩৬১
  • কমলকৃষ্ণ মিত্র, শ্রীরামকৃষ্ণ ও অন্তরঙ্গ প্রসঙ্গ, প্রথম সংস্করণ ১৩৩৯
  • Aajbangla. 2021. “আজ কল্পতরু উৎসব, জানেন কি এই বিশেষ কথাটির তাৎপর্য কি? - Aaj Bangla Bengali News.” Aaj Bangla. January 2, 2021.
  • Roychowdhury, Subhadip. 2021. “ঠাকুর কেন হয়েছিলেন কল্পতরু? » সংবাদ সমাচার.” 
  • “কল্পতরু উত্‍সব.” n.d. EI Samay ১লা জানুয়ারি ২০১৫. 
  • “পয়লা জানুয়ারি কল্পতরু হয়েছিলেন রামকৃষ্ণ.” n.d. আনন্দবাজার পত্রিকা অনলাইন, ৩১সে ডিসেম্বর, ২০১৯
 

More Articles