কলকাতা ফুটবলের দুয়োরানি মহামেডান স্পোর্টিং

Mohammedan Sporting Club History: ভারতের প্রথম ক্লাব হিসেবে বিদেশ থেকে খেতাব জিতে এনেছিল মহামেডান স্পোর্টিং। ১৯৬০ সালে ঢাকার মাটিতে দাপটের সঙ্গে তারা জিতে নেয় আগা খান গোল্ড কাপ।

এক রাজার দুই রানি। সুয়ো আর দুয়ো।

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ক্ষীরের পুতুল'-এর এই লাইন পড়লে মহামেডান স্পোর্টিংয়ের কথাই আমার মনে হয়। গৌরবোজ্জ্বল এক ইতিহাস তাদের অহংকার। সমর্থকদের বুকের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে আবেগের আগ্নেয়গিরি। প্রবল জনসমর্থন খেলার সময়ে বাড়তি অ্যাড্রিনালিন ঝরায় ফুটবলারদের। তবু, কোনও এক অজানা কারণে রেড রোডের ধারের ক্লাবটিই হয়ে রইল দুয়োরানি।

ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগান কলকাতা ফুটবলের সুয়োরানি। প্রচারের সব আলো ইস্ট-মোহনের উপরে। তাদেরকে নিয়েই সংবাদপত্রের পাতায় কালি খরচ হয়। দুই দলের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে কৌতূহলী হয়ে ওঠেন ভিন দেশের সাংবাদিকও। লাল-হলুদ আর সবুজ-মেরুনের ছটায় ম্লান সাদা-কালো।

অবশেষে সুপ্ত 'ভিসুভিয়াস' জেগে উঠেছে। কলকাতার দুয়োরানিও সমাদৃত হচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। এক নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হচ্ছে কলকাতার তিন প্রধানের নাম। সাপ-লুডোর আই লিগ থেকে আইএসএলে উত্তরণ ঘটেছে শতাব্দীপ্রাচীন মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের। আগামী মরসুমে এই শহরের তিনটি ক্লাব, ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান ও মহামেডান স্পোর্টিং আইএসএলে খেলবে। বহুদিন পরে কলকাতা আবার 'ফুটবলের মক্কা'য় পর্যবসিত হয়েছে।

সাদা-কালো রংও যে হাজার ওয়াটের আলো ছড়াতে পারে এবং সেই আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যেতে পারে, তা ভুলেই গিয়েছিল কলকাতা। মহামেডান স্পোর্টিং হয়ে গিয়েছিল তৃতীয় শক্তি। তৃতীয় প্রধান। জোয়ার নেই সেই ক্লাবে। ভাটার টানে ক্রমশ পিছিয়ে পড়তে থাকে তারা। ২০২৪-এর এই মহামেডান স্পোর্টিং ফিনিক্স পাখির কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। ফিনিক্স পাখির রয়েছে পুনর্জন্ম আর অমরত্বের বৈশিষ্ট্য। ধ্বংসস্তূপ থেকে সে নতুন প্রাণ পায়। মহামেডান স্পোর্টিংও ঠিক সেরকমই।

আরও পড়ুন- মুরগির মাংস খেলেই ম্যাচে হার! ফুটবলের বিচিত্র কুসংস্কারের এই ইতিহাস অজানাই

১৮৮৯-তে জন্ম নেয় মোহনবাগান। তার দু'বছর আগে ১৮৮৭ সালে তৎকালীন খান বাহাদুর নবাবজাদা আমিনুল ইসলামের নেতৃত্বে মালদহের মৌলবী মহম্মদ ইয়াসিন ও আরও কয়েকজন মিলে মুসলিম যুবকদের জন্য তৈরি করেছিলেন জুবিলি ক্লাব। আর্থিক সঙ্কটের জন্য এক বছরের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায় সেই ক্লাব। নতুন ক্লাব তৈরি করে তার নামকরণ হয় ক্রিসেন্ট ক্লাব। কয়েকদিন পরে ক্রিসেন্ট ক্লাব নাম বদলে হয় হামিদিয়া ক্লাব। ১৮৯১ সালে তৈরি হয় মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। আজকের মহামেডান স্পোর্টিংয়ের পথচলা শুরু তখন থেকেই। ১৯২৭ সালে ট্রেডস কাপের ফাইনালে ওঠায় পরের বছর মহামেডান স্পোর্টিং প্রথমবার কলকাতা লিগের দ্বিতীয় ডিভিশনে খেলার সুযোগ পায়।

১৯৩৩ সালে দ্বিতীয় ডিভিশনে রানার্স হয়ে কলকাতা লিগের প্রথম ডিভিশনে উত্তরণ ঘটে মহামেডান স্পোর্টিংয়ের। ১৯৩৪ থেকে ১৯৩৮ পর্যন্ত চলে সাদা-কালোর সোনার দৌড়। টানা পাঁচবার কলকাতা লিগ জিতে ইতিহাস তৈরি করে মহামেডান। ক্লাবের প্রতিটি জয়ের পরে ধ্বনি উঠত ‘আল্লাহু আকবর’। লেখা হতো ছড়া,

‘মহমেডান স্পোর্টিং তুমকো লাখোঁ লাখোঁ সালাম
হাম আব দেশ কা বাদশা বনে, অউর সব হ্যায় গুলাম।’

ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগানের আগে বুট পরে খেলে মহামেডানই। মরসুমে প্রথমবার একশোর বেশি গোল করার রপকথাও তাদেরই। ১৯১১ সালে মোহনবাগানের আইএফএ শিল্ড জয় কেবল খেলার মাঠের জয় ছিল না। একটা ফুটবল ম্যাচ আর স্বাধীনতা সংগ্রাম মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছিল। ব্রিটিশ দলকে খেলার মাঠে মাটি ধরানোর ইতিহাস রয়েছে মহামেডান স্পোর্টিংয়েরও। ১৯৪০ সালে প্রথম ভারতীয় ক্লাব হিসেবে ডুরান্ড কাপ জেতে তারা। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর রয়্যাল ওয়ারউইকশায়ার রেজিমেন্ট দলকে ১-২ গোলে হারিয়ে গর্বের ইতিহাসে নতুন পালক জোড়ে মহামেডান স্পোর্টিং। এখানেই শেষ নয়।
দেশের বাইরেও বিজয়কেতন ওড়ায় সাদা-কালো।

ভারতের প্রথম ক্লাব হিসেবে বিদেশ থেকে খেতাব জিতে এনেছিল মহামেডান স্পোর্টিং। ১৯৬০ সালে ঢাকার মাটিতে দাপটের সঙ্গে তারা জিতে নেয় আগা খান গোল্ড কাপ। রেড রোডের ধারের ক্লাব তাদের জার্সির মতোই। কখনও মেঘ, কখনও রৌদ্র। এহেন মহামেডান স্পোর্টিংই পথ হারিয়েছিল। সংবাদপত্রে ধীরে ধীরে কমতে থাকে তাদের জন্য বরাদ্দ করা জায়গা। অন্তর্দ্বন্দ্ব, কোচ তাড়ানো, স্পনসরের অভাব, ব্যর্থতা নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছিল। আই লিগে অবনমনের রক্তচক্ষু দেখে নেমে যেতে হয়েছে। আবার লড়াই করে উঠে এসেছে প্রথম ডিভিশনেও।

তাঁবুর ভগ্নপ্রায় অবস্থা দেখে এক সাংবাদিক বলে উঠেছিলন, ''মহামেডানের তাঁবুর যা অবস্থা, তাতে যে কোনও সময় অজগর সাপ বেরিয়ে পড়বে।'' সংবাদমাধ্যমে মহেঞ্জোদারোর সঙ্গে তুলনা হতো মহামেডান স্পোর্টিংয়ের। একাধিক গোল হজম করে একাধিক বার আত্মসমর্পণ করেছে তারা। অবহেলার উপাখ্যানও কম লেখা হয়নি। ইস্ট-মোহনের ম্যাচ ডার্বির আখ্যান পেয়েছে। মহামেডানের সঙ্গে দুই প্রধানের ম্যাচ হয়ে গিয়েছে মিনি ডার্বি। মহামেডান স্পোর্টিং কর্তারাও এমন অবহেলায়, অনাদরে অভিমানী হয়েছেন। রাজা আসে-যায়, রাজা বদলায়, নীল জামা গায়ে, লাল জামা গায়ে, এই রাজা আসে ওই রাজা যায়, জামা কাপড়ের রং বদলায়! দিন বদলায় না! মহামেডানও বদলায় না। এটাই হয়ে গিয়েছিল দস্তুর।

এই প্রতিবেদন লেখার সময়ে স্মৃতিতে উঁকি দিচ্ছে প্রায় ১৮ বছর আগের এক সকাল। সেবার ডগলাস-মাইক ওকোরো-সহ বেশ কয়েকজন ফুটবলার ক্লাব বদলান। ময়দানে তা নিয়ে চলছিল জোর আলোচনা। মহামেডান স্পোর্টিংয়ের নতুন কোচ সুভাষ ভৌমিক। সবাই বলাবলি শুরু করেছেন, ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে বনিবনা হয়নি সুভাষের। তাই নিজে এসেছেন সাদা-কালোয়, সঙ্গে এনেছেন ডগলাসদের। সুভাষ সরে যাওয়ায় ব্রাজিলের কার্লোস পেরেরাকে কোচ করে আনে ইস্টবেঙ্গল।

কলকাতা লিগের ইস্টবেঙ্গল-মহামেডান ম্যাচের পারদ চড়তে শুরু করেছিল অনেক আগে থেকেই। ময়দানে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছিল এই ম্যাচটায় ঝামেলা হতে পারে। ইস্টবেঙ্গলকে সহজে ছাড়বেন না সুভাষ। লাল-হলুদের কর্তারাও ভিতরে ভিতরে ফুটছেন। দলবল নিয়ে সুভাষ ভৌমিকের ক্লাব ছাড়া মেনে নিতে পারেননি তাঁরা। লাল-হলুদ ছেড়ে আসা ফুটবলারদের 'বিদ্রোহী' নাম দিল মিডিয়া।

আরও পড়ুন- বাম পকেটে কালীর ছবি রাখতেন শৈলেন মান্না, ফুটবলে যেভাবে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠলেন ‘মান্নাদা’

ম্যাচের আগেরদিন প্রিভিউয়ে মিডিয়ার ঢল নামে রেড রোডের ধারের ক্লাবে। মাইক ওকোরো সাদা-কালোর অধিনায়ক। তাঁর সামনে বুম ধরলেন এক বৈদ্যুতিন মাধ্যমের সাংবাদিক। সেই সাংবাদিকের একটা প্রশ্নেরও জবাব দিলেন না ওকোরো। ইস্টবঙ্গল ক্লাবের দিকে আঙুল দেখিয়ে সেই সাংবাদিককে নাইজেরিয়ান গোলমেশিন বললেন, ''তোমরা সবাই ওই ক্লাবে যাও। একদিনও আসো না এখানে। কাল ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে খেলা বলে আজ এসেছো। আমি একটা কথাও বলব না।'' ম্যাচটা হারতে হয়েছিল মহামেডানকে।

গত কয়েক বছরে অবশ্য পুরোদস্তুর বদলে গিয়েছে মহামেডান স্পোর্টিং। তাঁবু ঝাঁ চকচকে হয়েছে। অতীতের বদনামও অনেকটাই মুছে ফেলেছে। এগিয়ে এসেছে স্পনসর। দল নিয়ে সদর্থক চিন্তাভাবনা করছে তারা। তিন প্রধানে পাঁচ বছর করে খেলা এশিয়ান স্টার খ্যাত গোলকিপার অতনু ভট্টাচার্য বলছেন, ''দুর্দান্ত সাফল্য বললেও কম বলা হবে। আমি বলব ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের থেকেও মহামেডান স্পোর্টিংয়ের কৃতিত্ব অনেক বেশি। রীতিমতো লড়াই করে আইএসএল খেলার ছাড়পত্র পেল মহামেডান।''

লাজংয়ের মাঠে সাদা-কালোর আকাশছোঁয়া সাফল্য দেখে মনে হচ্ছিল অন্ধকার রাতের শেষে আলো ঝলমলে এক সকালেরই দেখা মেলে। ব্যর্থতা কখনই চিরসঙ্গী হয় না। সাফল্যও এসে ধরা দেয়। শুধু হাল ছাড়লে চলবে না। লড়ে যেতে হবে। ঠিক মহামেডান স্পোর্টিংয়ের মতো।

More Articles