নতুন পার্লামেন্ট গড়তে ৮৩৬ কোটি! পুরনো সংসদ ভবন তৈরি হয়েছিল কত টাকায়?
Old Parliament Making History: ১৯১৯ সালে কাউন্সিল হাউসের ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করেন লুটিয়েন্স এবং বেকার। তারা ঠিক করেন এই ভবনটি হবে বৃত্তাকার আকৃতির।
১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পুরনো লোকসভায় শেষবারের মতো বক্তৃতা দিলেন। ঐতিহাসিক সংসদ ভবনের যাত্রা শেষ, কারণ নতুন ঝাঁ চকচকে সংসদ ভবনটি প্রস্তুত। এবার দেশের যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ হবে সেন্ট্রাল ভিস্তাতেই। ব্রিটিশ আমলের এই পুরনো সংসদ ভবনের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে হাজারো ইতিহাস। প্রধানমন্ত্রী মোদি, পুরনো ঘর ছেড়ে আসার সময় সেই ইতিহাসের খণ্ডাংশ উল্লেখও করেছেন। স্বাধীনতার আগে ইম্পেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিল নামে পরিচিত ভবনটিই পরে সংসদ ভবন হয়ে ওঠে। বিদেশি শাসকরাই এই ভবন তৈরি করেন, শ্রমিকরা ছিলেন ভারতেরই।
সংসদ ভবনের মূল পরিকল্পনাটি করেছিলেন হার্বার্ট বেকার। সাল ১৯১১, দিনটা ১২ ডিসেম্বর। ভারতের শাসক রাজা পঞ্চম জর্জ নতুন দিল্লিতে রাজ্যাভিষেক করলেন। জর্জ জানালেন, ভারত সরকারের আসন কলকাতা থেকে দিল্লির প্রাচীন রাজধানীতে স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্রিটিশরা। নতুন রাজধানীতে কাজ করার জন্য নতুন রাজপ্রাসাদও চাই! দুই স্থপতি- এডউইন লুটিয়েন্স এবং হার্বার্ট বেকার-কে তখন সংসদ ভবন, রাষ্ট্রপতি ভবন (রাষ্ট্রপতির বাসভবন), উত্তর ও দক্ষিণ ব্লক (প্রশাসনিক ভবন), রাজপথ, ইন্ডিয়া গেট, ইন্ডিয়া গেটের চারপাশে ন্যাশনাল আর্কাইভ বিল্ডিং এবং অন্যান্য ভবনের নকশা তৈরির একটি প্রধান দায়িত্ব দেওয়া হয়।
ছয় বছর ধরে চলে সংসদ ভবন নির্মাণের কাজ। তখন অবশ্য ডাকা হতো কাউন্সিল হাউস নামেই। ১৯২১ থেকে ১৯২৭ পর্যন্ত এই ভবন তৈরির কাজ হয়। ব্রিটিশ যুগে এই সংসদ ভবনটিই ছিল ইম্পেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিল বা ব্রিটিশ ভারতের আইনসভা।
আরও পড়ুন- নতুন সংসদ ভবন জুড়ে পদ্মফুল আর ময়ূর! চোখ ধাঁধানো বিলাসের বহরে অবাক দেশ
পুরনো সংসদ ভবন কীভাবে তৈরি হয়েছিল?
১৯১৯ সালে কাউন্সিল হাউসের ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করেন লুটিয়েন্স এবং বেকার। তারা ঠিক করেন এই ভবনটি হবে বৃত্তাকার আকৃতির। অনেকে বলেন, এই দুই স্থপতি রোমানদের ঐতিহাসিক স্মৃতিস্তম্ভ, কলোসিয়ামের কথা মাথায় রেখেই নকশাটি করেছিলেন। অনেকে আবার বিশ্বাস করেন, বৃত্তাকার আকৃতিতে এই ভবন তৈরির নেপথ্যে রয়েছে ভারতীয় এক মন্দির। মধ্যপ্রদেশের মোরেনা জেলার মিতাউলি গ্রামে অবস্থিত চৌসঠ যোগিনী মন্দির থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই নাকি ব্রিটিশরা এই ভবন গড়েন। তবে হার্বার্ট বেকার সত্যিই সেই মন্দিরে গিয়েছিলেন কিনা, সেই মন্দিরের কথা জানতেন কিনা বা মন্দিরের ছবি দেখেছিলেন কিনা, তা জানা যায় না।
হার্বার্ট বেকারের ধারণা ছিল, পার্লামেন্ট হাউস নির্মাণের আসল লক্ষ্য হচ্ছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শক্তি এবং প্রভাবকে তুলে ধরা এবং তাই হার্বার্ট বিশ্বাস করতেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শৈলীর মিশ্রণের মাধ্যমেই এই নতুন ভবনটি তৈরি করে এমন বার্তা দেওয়া যেতে পারে। লুটিয়েন্স নিজেও মনে করতেন ইউরোপিয় ধ্রুপদী গঠনশৈলীই শ্রেষ্ঠ। তবে তিনি এও বলতেন যে, যেহেতু এটি ভারতে গড়া হচ্ছে তাই ভারতীয় ঐতিহ্যকেই নির্মাণের ভিত্তি হতে হবে।
বেকারকে লেখা একটি চিঠিতে লুটিয়েন্স বর্ণনা করেছেন, কীভাবে ভারতীয় শৈলীতে এমন ভবন নির্মাণ করবেন। তিনি স্পষ্ট লিখেছিলেন, যদি 'হিন্দু' কাঠামোর প্রয়োজন হয় তাহলে বর্গাকার পাথর বসিয়ে বসিয়ে শিশুর মতোই বাড়ি গড়ে তুলতে হবে। তবে প্রতিটি পাথরে আলাদাভাবে এবং স্বতন্ত্রভাবে খোদাই করতে হবে, কিছু ভয়ঙ্কর আকৃতি, কিছু নকশা। যদি 'মোঘল' ঘরানায় বানাতে হয় তবে, কংক্রিটই ভরসা। সাধারণ আয়তক্ষেত্রাকার-অষ্টভুজের মতো গড়ন। গম্বুজ থাকতেই হবে। পাথর বা মার্বেল দিয়েই সারতে হবে নির্মাণ।
আরও পড়ুন- কেন স্বাধীনতার ৭৫ বছর পর দরকার পড়ল নতুন সংসদ ভবনের?
অবশেষে, দুইয়ের মিশ্রণেই গম্বুজযুক্ত ছাদ এবং খোদাই করা ফুলকারি জালি দিয়ে সাজানো হয় ভবনটিকে। সেন্ট্রাল ভিস্তার অফিসিয়াল ওয়েবসাইট জানাচ্ছে, পুরনো এই ভবন নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় মার্বেল এবং পাথর খোদাইয়ের কাজে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ প্রায় ২,৫০০ জন শ্রমিক ও রাজমিস্ত্রি নিয়োগ করে।
ঐতিহাসিক এই বৃত্তাকার সংসদ ভবনটিতে ১৪৪টি বেলেপাথরের স্তম্ভ রয়েছে, যার প্রতিটির মাপ ২৭ ফুট। সেই সময়ে, সংসদ ভবন নির্মাণের মোট খরচ ছিল ৮৩ লক্ষ টাকা। ভারতীয় শ্রমিকদের কঠোর পরিশ্রমেই সংসদ ভবনটি তৈরি হয়।
১৯২৭ সালের ১৮ জানুয়ারি ভাইসরয় লর্ড আরউইনকে এই পুরনো ভবনটির উদ্বোধনের জন্য আমন্ত্রণ জানান গভর্নর-জেনারেলের নির্বাহী পরিষদের সদস্য স্যার ভূপেন্দ্র নাথ মিত্র। পরদিনই ব্রিটিশ সরকারের কেন্দ্রীয় আইন সভার তৃতীয় অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় এই ভবনে।
ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটলে, ভারত স্বাধীন হলে ভবনটি অধিগ্রহণ করে গণপরিষদ। ১৯৫০ সালে এই ভবনটিই হয় ভারতীয় সংসদ। ২০২৩ সালে তৈরি হলো নতুন সংসদ ভবন। পুরনো ভবনটি হবে ‘গণতন্ত্রের জাদুঘর’।