এখন ভূতের ডেরা! রায়পুর রাজবাড়ির ইতিহাস আজও বিস্মিত করবে

বাড়িটি ভৌতিক, এমন রটনা আছে। বাড়িটির ভগ্নদশা দেখলে ভূত আছে, এমন ভাবাটাও আশ্চর্য নয়।

রাইপুর। ইতিহাস-বিখ্যাত একটি নাম। বোলপুর শহরের দক্ষিণ-পশ্চিমে ইলামবাজার যেতে, অথবা বলা যায় ইলামবাজারের ধারেই বীরভূম জেলার ঐতিহাসিক গ্রাম রাইপুর। শান্তিনিকেতন থেকে মাত্র তিরিশ মিনিটের পথ এই রাজবাড়িটি।

 

রাইপুর রাজবংশের প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে দু'টি ভিন্ন মত শোনা যায়। কিছু লোকের মতানুসারে অজয় নদীর তীরে আদমপুর নামে একটি গ্রাম ছিল। সেখানে একটি জনপদ ছিল। অজয় নদে বন্যার ফলে আদমপুর ছেড়ে সকলে আরও উত্তরদিকে উঠে আসে এবং নতুন বসতি স্থাপন করে। তৎকালীন জমিদার রায়চৌধুরীদের নামানুসারে গ্রামটির নাম হয় রাইপুর। অনেকের মতানুসারে রায়পুরের সিংহ পরিবারের থেকেই এইরূপ নামকরণ হয়েছে। সিংহ পরিবারের বংশধর বিশম্ভর সিংহ বর্ধমানের মহারাজের থেকে 'রায়' খেতাব পাওয়ায়, আদমপুর পরবর্তীকালে রায়পুর বা রাইপুর নামে পরিচিত হয়। লোকমুখে শ্রুত দু'টি কাহিনি এইরকম।

 

চৌধুরী পরিবার
রায়পুর বা রাইপুর গ্রামটি গড়ে ওঠার আগে, রায়চৌধুরীরা ছিলেন আদমপুরের জমিদার। বন্যায় অজয় নদে ভাঙনের জন্য পরবর্তীকালে এরা রায়পুরে উঠে আসেন। সেখানে জমিদারির পত্তন করেন। রায়পুরে এই পরিবার গোপীনাথ জিউর মন্দির স্থাপন করেন এবং গোপীনাথ ও রাধারানির নিত্য সেবা চালু করেন। জিতানাথ দত্ত ছিলেন এই পরিবারেরই সন্তান। তিনি মুর্শিদাবাদের নবাব আলিবর্দি খাঁ-র আমলে রায়পুর গ্রামে, ১৭৪০ সালে মুর্শিদাবাদের দশ হাজার সেনার 'সেনাপতি' পদে নিযুক্ত হন। তখন বাংলা ছিল বর্গি হামলায় পর্যুদস্ত। জিতানাথ অজয় নদীর তীরে কাটোয়া থেকে জয়দেব পর্যন্ত তাঁর দশ হাজার সেনার সমাবেশ করেন এবং পাশের 'সুপুর' গ্রামের জমিদার আনন্দচাঁদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে বর্গি আক্রমণ প্রতিহত করতে সমর্থ হন। এই খবর শোনার পর নবাব আলিবর্দি খাঁ জিতানাথ দত্তচৌধুরীকে "রায়চৌধুরী" উপাধিতে ভূষিত করেন এবং পুরস্কার বাবদ নগদ একহাজার টাকা ও তাঁর বাড়ির গোপীনাথ জিউ-র নামে এক হাজার বিঘা জমি দান করেন।

 

আরও পড়ুন: বাচ্চারা কাঁপত সেই ‘ভূত’ দেখে! কলকাতায় চালু ছিল এইসব আজব খেলা

 

সিংহ পরিবার
রায়পুর গ্রামে অবস্থিত ভগ্নপ্রায় জমিদারবাড়িটি (রাজবাড়িও বলা চলে) আজও ইতিহাসের নানা সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। ব্রিটিশ-শাসিত বাংলায় যতগুলি পরিবার খ্যাতি অর্জন করেছিল, তার মধ্যে অন্যতম এই জমিদার পরিবার। ১৭৬৪ সালে মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনা থেকে সিংহ পরিবারের আদি পুরুষ লালচাঁদ সিংহ দে অজয় নদীর তীরে রায়পুর গ্রামে আসেন, এবং বর্তমানে 'মা মঙ্গলচণ্ডী'-র বাড়ি যে স্থানে, ঠিক তার নিকটেই তিনি বসবাস শুরু করেন। তিনি এক সহস্র তন্তুবায় পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে বীরভূমে এসেছিলেন। এই তন্তুবায় পরিবারগুলি পরবর্তীকালে বীরভূমের মির্জাপুর, চন্দনপুর, রায়পুর, সুখবাজার, সুরুল, সিয়ান প্রভৃতি গ্রামগুলিকে সমৃদ্ধি এনে দিয়েছিল। এই সময় তৎকালীন জমিদার চৌধুরীদের অবস্থার কিছু অবনতি হয়। ১৭৭০ সালে রাইপুরের চৌধুরীদের নিকট থেকে জমিদারি ক্রয় করে লালচাঁদ স্থানীয় জমিদার-রূপে খ্যাতি লাভ করেন।

Raipur Rajbari

 

লালচাঁদের তিন পুত্র ছিল। পঞ্চানন, রামকিশোর ও শ্যামকিশোর। ১৭৭৩ সালে লালচাঁদ ৬০ বিঘা জমির ওপর তাঁর তিন ছেলের জন্য তিনটি তিনমহলা বাড়ি তৈরি করান। এতে মোট ১২০টি ঘর ছিল। লালচাঁদের কনিষ্ঠ পুত্র শ্যামকিশোর ১৮০০ সালে 'জন চিপ'-এর অধীনে মাসিক কুড়ি টাকা বেতনে দেওয়ান পদে নিযুক্ত হন। 'চিপ কুঠি'-তে 'গরার' মোটা থানের ব্যবসা ছিল। তখনকার দিনে কাপড় আনা হতো নৌকো করে। ফলে ইউরোপীয় বাজারে এর বিপুল চাহিদা ছিল। শ্যামকিশোর, তাঁর বাবা যে হাজার হাজার তন্তুবায় পরিবারগুলোকে বীরভূমে নিয়ে এসেছিলেন, সেই পরিবারগুলোর দ্বারা উৎপাদিত কাপড় 'চিপ সাহেব'-এর কাছে জোগান দিতেন। পরিবর্তে প্রত্যেক হাজার পরিবারপিছু এক টাকা করে, দৈনিক ১০০০ টাকা 'নজরানা' পেতেন। এই ব্যবসার মধ্য দিয়েই রায়পুরের জমিদার পরিবার প্রভূত অর্থ উপার্জন করতে থাকে। এই শ্যামকিশোর পরবর্তীকালে রাজনগরের রাজার নিকট থেকে তাঁর সমস্ত সম্পত্তি এবং শ্যামবাটি, ভুবনডাঙা প্রভৃতি মৌজা কিনে নেন। শ্যামবাটি জায়গাটির নামকরণ তাঁর নামানুসারেই হয়েছিল।শ্যামকিশোরের ছিল চার পুত্র। জগমোহন, ব্রজমোহন, ভুবনমোহন এবং মনোমোহন। জগমোহনের জ্যেষ্ঠপুত্র ছিলেন বিশ্বম্ভর সিংহ। তিনি ছিলেন অত্যন্ত শক্তিশালী, বুদ্ধিমান ও তেজস্বী পুরুষ। তিনি বর্ধমানের মহারাজা তিলকচাঁদ মহতাবের দেওয়ান। তাঁর নামানুসারে একটি প্রবাদ বচন চালু ছিল- 'যাহা বিশ্বম্ভর,তাহাই রাইপুর'। বর্ধমানের মহারাজা তিলকচাঁদ তাঁকে 'রায়' উপাধি প্রদান করেন। এই রায় উপাধি থেকেই গ্রামটির নাম হয় 'রায়পুর' বা 'রাইপুর'।

 

এই পরিবারের সবচেয়ে কৃতিমান পুরুষ হলেন সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহ। তাঁর জন্যই আজ রাইপুর জমিদারবাড়ির এত নাম-ডাক। তিনি সকলের কাছে 'লর্ড এস.পি. সিংহ' নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন এই বংশেরই এক জমিদার, সিতিকণ্ঠ সিংহ, তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র। ১৮৬৩ সালের ২৪ মার্চ তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মাতার নাম মনোমোহিনী দেবী।১৮৭৭ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে তিনি বীরভূম জেলা স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস করেন। কিন্তু অত্যন্ত মেধাবী এই ছাত্রটি ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে বিএ পরীক্ষা না দিয়েই, তাঁর অগ্রজ চিকিৎসক ভ্রাতা নরেন্দ্রপ্রসন্নর সঙ্গে গোপনে ইংল্যান্ডে চলে যান 'হেনরি আর স্কিন'-এর সহায়তায়। তখনকার দিনে গোঁড়া হিন্দু সমাজে কালাপানি পার হওয়ার অপরাধে দুই ভাইকে জাতিচ্যুত করা হয়। পরবর্তীকালে তাঁরা দুই ভাই গ্রামে ফিরলে, জমিদারবাড়িতে তাঁদের প্রবেশাধিকার ক্ষুন্ন হয়। ১৮৮৬ সালে 'লিঙ্কনস ইন' থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করে সত্যপ্রসন্ন কলকাতা হাই কোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। ১৯১৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর জাতীয় কংগ্রেসের বোম্বাই অধিবেশনে সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহ জাতীয় কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯১৯ সালে ব্রিটেনের সংসদ, 'হাউস অব লর্ডস'-এর ভারতীয় সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯২০ সালে বিহার ও উড়িষ্যার গভর্নর পদে তিনি নিযুক্ত হন। তৎকালীন সরকারবাহাদুরের তরফ থেকে তাঁকে 'নাইট' উপাধি দেওয়া হয়। এর কিছুদিনের মধ্যেই সত্যপ্রসন্ন সিংহ পরিচিত হন 'লর্ড সিনহা' নামে; এবং ব্রিটিশ সরকার তাঁকে রাইপুরের 'রাজা' হিসেবে ঘোষণা করেন। সেই দিন থেকেই রায়পুরের জমিদারবাড়ি, রাজবাড়ি হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। বর্তমান কলকাতার শেক্সপিয়র সরণি এবং এলগিন রোড-ঘেঁষা একটি রাস্তার নাম 'লর্ড সিনহা সরণি' নামে পরিচিত। ১৯০২ সালে সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত তাঁর পিতা সিতিকন্ঠ সিংহের স্মৃতিরক্ষার্থে প্রতিষ্ঠিত 'রাইপুর সিতিকণ্ঠ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়' আজও জ্ঞানের আলো বিতরণ করে চলেছে।

 

একসময়ের বিশাল রাজবাড়ি আজ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এত বিশাল রাজবাড়ি সচরাচর দেখা যায় না। কুলদেবতা গোপীনাথ জিউ-র নিত্য সেবা এখনও হয়ে চলেছে। বর্তমানে রাজবাড়িটি স্থানীয় মানুষের সহায়তায় রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে। এটি এখন নানা রকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবহার করা হয়। বাড়িটি ভৌতিক, এমন রটনা আছে। বাড়িটির ভগ্নদশা দেখলে ভূত আছে, এমন ভাবাটাও আশ্চর্য নয়। কত ঘটনার মূক সাক্ষী ভগ্নপ্রায় এই বাড়ি, আজ থেকে প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো ইতিহাসের গরিমা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

 

কৃতজ্ঞতা স্বীকার: শ্যামলী দাস ও সুকেশ মন্ডল

More Articles