মানিকতলার 'মানিক' আসলে কে? কীভাবেই বা এল হেদুয়ার নাম?

Maniktala Name History: মানিক পীর বাদে যার নাম থেকে মানিকতলা নামের উৎস সম্ভব তাঁর নাম ছিল মানিকচাঁদ বসু (মতান্তরে মানিকরাম বসু)।

২০১৯ সালে উত্তর কলকাতার মানিকতলা এলাকার একটি বাসস্টপে একটি ব্যানার দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। কাশী প্রসাদ জয়সওয়াল স্মৃতি সমিতির পক্ষ থেকে টাঙানো সেই ব্যানারে বাসস্টপের নাম কাশী চক লেখা হয়েছিল। সমিতির সদস্যদের বক্তব্য ছিল, কাশী প্রসাদ জয়সওয়ালের আবক্ষ মূর্তির আশেপাশের এলাকার (যার মধ্যে সেই বাসস্টপ রয়েছে ) নাম কাশী চক করার দাবি জানানো হয়েছিল। কাশী প্রসাদ জয়সওয়াল একজন উকিল এবং ঐতিহাসিক ছিলেন। তিনি ১৯১০ - ১৯১৬ সাল অবধি কলকাতা হাইকোর্টে ওকালতি করেছিলেন। কথিত আছে, স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তাঁকে ইতিহাস চর্চায় উৎসাহ দিয়েছিলেন। সেই কাশী প্রসাদ জয়সওয়ালের স্মৃতি সমিতি যখন মানিকতলা এলাকায় তাঁর মূর্তির আশেপাশের এলাকার নাম বদলের দাবি জানায় তখন বহু মানুষের প্রশ্ন ছিল হঠাৎ উত্তর কলকাতার এত পুরনো এবং পরিচিত এক এলাকার নাম বদলের দরকারটা কী? বাংলাপক্ষ নামক সংগঠনের এক সদস্য এই ব্যানার প্রসঙ্গে বলেছিলেন, এই ব্যানারের মাধ্যমে মানুষের মনে এক এলাকার নাম বদলে নতুন নামের সঙ্গে পরিচয় করানোর চেষ্টা চলছে।মানিকতলার নাম বদলের চেষ্টার প্রতিবাদে মিছিলও হয়েছিল। যদিও এখনও মানিকতলা সাধারণ মানুষের কাছে নিজের পুরনো নামেই অস্তিত্ব বজায় রেখে চলেছে। তাও একটা প্রশ্ন উঠেই আসে। উত্তর কলকাতার পরিচিত এই এলাকার 'মানিক' আসলে কে?

লোকমুখে প্রচলিত বহু কাহিনির মধ্যে একটি কাহিনিতে বিশ্বাস করলে বলা যায় যে, মানিকতলা এলাকা মানিক বাবার নাম থেকেই নিজের নাম পেয়েছে। মানিকতলা এলাকার খুব কাছেই মানিক পীরের মাজার রয়েছে। মানিক পীরের মাজার থাকার কারণেই সম্ভবত লোকমুখে এলাকার নাম হয়ে যায় মানিকতলা। মানিক পীরের ব্যাপারে অবশ্য খুব বেশি কিছু জানা যায় না। তাঁর আসল নাম ছিল সৈয়দ হুসেন উদ্দিন শাহ। শোনা যায়, তিনি ঊনবিংশ শতকের শুরুতে এই এলাকায় এসেছিলেন। এই তথ্য থেকেই ফেলুদার ভাষায় একটা 'খটকা' লাগে। মানিক পীর বর্তমান মানিকতলায় এসেছিলেন ঊনবিংশ শতকের শুরুতে কিন্তু ১৭৮৪ সালের উডের ম্যাপে মানিকতলার নাম দেখতে পাওয়া যায়। তার থেকে মনে হতেই পারে যে মানিকতলা নামের উৎস মানিক পীর নিজে হতে পারেন না। মানিক পীরের আগমনের পূর্বেই মানিকতলা নিজের নাম পেয়েছিল। হয়তো একই নাম হওয়ার কারণে মানিক পীর মানিকতলা নামটি মানুষের মনে আরও দৃঢ়ভাবে গেঁথে দিয়েছিলেন। মানিক পীরের নাম যদি মানিকতলা নামের উৎস না হয়ে থাকে তাহলে মানিকতলা নিজের নাম পেল কীভাবে? বহু গল্প, তথ্যের মধ্যে দুটো প্রচলিত তথ্যকে গুরুত্ব দেওয়া যেতে পারে।

আরও পড়ুন- দক্ষিণ কলকাতার ব্যস্ততম রাস্তা! হরিশ মুখার্জি রোডের নেপথ্যের মানুষকে চিনলই না বাঙালি

প্রথম কাহিনি অনুযায়ী, এই এলাকায় মানিক পরিবার নামে এক পরিবার বসবাস করতো। তাদের এক বিরাট পুকুর ছিল। কালক্রমে লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে সেই পরিবারের নাম থেকেই এলাকার নাম হয়ে যায় মানিকতলা। যদিও এই পরিবার অথবা তাদের পুকুর সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু সহজে জানা যায় না। মানিক পীর বাদে যার নাম থেকে মানিকতলা নামের উৎস সম্ভব তাঁর নাম ছিল মানিকচাঁদ বসু (মতান্তরে মানিকরাম বসু)। ইতিহাস তাঁকে বহু ক্ষেত্রে বাংলার নবাব আলিবর্দি খাঁয়ের দেহরক্ষী হিসাবে বর্ণনা করলেও তাঁর আরও একটি পরিচয় রয়েছে। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা কলকাতা আক্রমণ এবং ইংরেজদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করার পরে আলিবর্দি খাঁয়ের নামে কলকাতার নামকরণ করেছিলেন আলিনগর। কলকাতায় জয়লাভের পরে তিনি মুর্শিদাবাদের পথে রওনা হওয়ার আগে কলকাতার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তাঁর প্রতিনিধি রেখে গিয়েছিলেন। মানিকচাঁদ মতান্তরে মানিকরাম বসু ছিলেন সেই প্রতিনিধি। তিনি যে এলাকায় বসবাস করতেন কালক্রমে সেই এলাকার নাম হয়ে যায় মানিকতলা। পরবর্তীকালে মানিক পীরের আগমনের পরে সেই নাম মানুষের মনে আরও গভীরে জমে যায়। যদিও তাঁর নাম সংক্রান্ত বহু গল্প আজও মানুষের মধ্যে ঘুরে বেড়ায় তবুও প্রকৃত ইতিহাসের সমর্থনে সাক্ষ্য খুঁজতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। যেমন, মানিকতলার কাছের এক জলাশয়ের নামের উৎসের সমর্থনে প্রমাণ খুঁজতেও বেশ ঝক্কি পোহাতে হয়।

ব্রিটিশ শাসনের শুরুর আগেই উত্তর কলকাতায় ছিল এক পুকুর। দৈনন্দিন কাজকর্মের জন্য তার জল ব্যবহার করা হলেও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেই পুকুর এঁদো পুকুরে পরিণত হয়। শোনা যায়, স্বামী বিবেকানন্দের সিমুলিয়ার বাড়িতেও সেই পুকুরের জল ব্যবহৃত হতো। হয়তো পুকুরের কিছু একটা নাম ছিল, আবার হয়তো নাম ছিলই না কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মজে যাওয়ার কারণে তাকে মানুষ এঁদো বলেই ডাকতে শুরু করে। কালক্রমে সেই এঁদো থেকেই হেঁদো অথবা বর্তমান হেদুয়া নামটি এসেছে। যদিও ইংরেজ শাসনের সময়ে এই পুকুর পরিষ্কার করিয়ে তার নতুন নাম কর্ণওয়ালিশ স্কোয়ার রাখা হয়েছিল কিন্তু মানুষের কাছে সে হেঁদো অথবা হেদুয়া হয়েই রয়েছে। বাঙালির এক বড় অংশ ইতিহাস বিমুখ হওয়ার কারণে পরিচিত এলাকার নাম বদলের বিরোধিতা করলেও সেই এলাকার নামের উৎস খুঁজতে সামান্যতম প্রচেষ্টাও করেনি। তার ফল স্বরূপই হয়তো আমাদের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে হাজার জানা অজানা গল্প। বাঙালি কি সেই ইতিহাসের প্রমাণ খুঁজবে, আদৌ?

 
তথ্য ঋণ : টাইমস অব ইন্ডিয়া, দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য স্টেটসম্যান, ব্লগস্পট।
 

More Articles